অধ্যায়-৬

50 10 1
                                    

"সমঝোতা ব্যাপারটা অনেকটা ব্যক্তিগত। যেকোনো একজনকেই দৌঁড়টা শেষ করতে হয়। সেভাবে বলতে গেলে দুজনের মধ্যে যে আগে মীমাংসা করতে সক্ষম হবে তার পক্ষ হতে আত্মিক শিকল তত মজবুত হবে। যখন তোমার মা রাগ করতো তখন আমি তাকে ঘুরতে নিয়ে যেতাম‚ রেস্তোরাঁয় খেতে নিয়ে যেতাম‚ তার রাগ ভাঙানোর জন্য রোমান্টিক কথোপকথন চালু করতাম‚ ফুল গিফট করতাম‚ পপকর্ন কিনে মুভি দেখতে যেতাম। মেয়েদের পটানোর যে কত উপায় আছে!" বাবা বিনোদনের পৃষ্ঠায় নায়িকাদের ছবির দিকে চোখ রেখে কথাগুলো বললেন।
"সরি বাবা‚ আমি আসলে..... ওকে চা দিয়ে আসতে ভুলে গেছি। এহ‚ রে.... চা তো একেবারে ঠান্ডা হয়ে গেছে।"
"ওকে চা নয়‚ বালতিভর্তি হুইস্কি দিয়ে আসা উচিত। তারপরেও যদি ছেলেটার কাণ্ডজ্ঞান হয়!"
"এভাবে বলবেন না‚ বাবা। আমি আপনাকে কথা দিলাম‚ একদিন নয়তো একদিন ওকে ঠিক করেই ছাড়বো। এখন আমি আসি তাহলে‚ ওকে আবার চা বানিয়ে দিতে হবে।"
বাবা বিনোদনের পৃষ্ঠা হতে চোখ সরিয়ে নাবিলার দিকে এক ঝলক তাকালেন।
"সবই‚ প্রকৃতির লীলা খেলা‚ মামণি। তাহলে তুমি এখন এসো।"
নাবিলা মিনিট দুয়েক পর আমার জন্য চা বানিয়ে আনলো।
"ওপ্স‚ আই'ম এক্সট্রিমলি সরি। আমি আসলে তোমার জন্য চা বানিয়েছিলাম। কিন্তু বাবার সাথে গল্প করতে করতে আর খেয়াল ছিলো না। পরে আবার আরেক কাপ...."
ওকে থামিয়ে দিয়ে বললাম‚
"বাবার কাছে গিয়ে আমার ব্যাপারে নালিশ করেছো তাই না।"
"আমি কেন নালিশ করতে যাবো?"
আমি মনে মনে ভাবতে লাগলাম নাহ্‚ মেয়েটা এমন করবে না। আমার ব্যাপারে ও বড্ড যত্নশীল। নাবিলা পুনরায় বলতে শুরু করলো‚
"উল্টো তোমার বাবাই আমার কাছে নালিশ করেছে।"
"তো বাবা কি নালিশ করেছে?"
"থাক্‚ অকারণে কষ্ট পাবে তুমি। তোমার কষ্ট আমি সইতে পারবো না‚" বলে চায়ের কাপটা আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে নাবিলা রান্নাঘরে গেল।"
"বলে কি মেয়েটা! ওর জায়গায় আমি হলে তো সব মুখস্ত বলে দিতাম।"
গোধূলি লগ্নে চায়ের স্টলে বসে আছি। সিগারেট ধরানোর জন্য দিয়াশলাই চাইলাম। খেঁয়াল করি নি‚ সামনেই নীল বর্ণের গ্যাসলাইটার ঝুলিয়ে রাখা রয়েছে। ক্রিস্টাল ক্লিয়ার গ্যাসলাইটারের অগ্নিশিখায় সিগারেটটা ধরিয়ে নিলাম। ঠিক কবে থেকে এই নেশা শুরু হয়েছে তা জানি না। সিগারেটের ধোঁয়ার সাথে জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত কিংবা প্রতিটি পর্যায়েরই মিল পরিলক্ষিত হয়। সময়গুলো নিমিষেই যেন ধোঁয়াশা হয়ে যাচ্ছে। বদলে যাচ্ছে অনেক কিছুই। শুধু বদলায় নি আমি। এখনো সেই প্রথম দেখা‚ প্রথম প্রেমের দিয়াওনা হয়ে আছি। ওর সাথে সিনেপ্লেক্সে পপকর্ণ খাওয়ার মুহূর্তগুলো আজও অনেক মিস করি। মিস করি সেই রিকশায় ঘোরাঘুরি করা মুহূর্তগুলাকেও।
আজ রাতে একটু আগেই বাড়িতে ফিরলাম। নাবিলা জিজ্ঞেস করল‚ কোনো সমস্যা হয়েছি কিনা। আমি না সূচক মাথা নাড়িয়ে ড্রইং রুমে বসলাম‚ বাবা পত্রিকায় সুডোকু খেলছে। পুরোনো নকিয়া মোবাইলের ক্যালকুলেটরে হিসেব করে ৯×৯ সুডোকুর ছক ভরছে। বয়স হয়েছে তো তাই ক্যালকুলেটরের সাহায্য নিতে হয়। আমি টিভিতে নিউজ চ্যানেল পাল্টে 'ডোরেমন' দেখতে শুরু করলাম। বাবা বিষয়টি লক্ষ্য করলেন।
"কিরে‚ তোর চোখের কি মাথা খেয়েছে নাকি! বাচ্চাদের মতো কার্টুন দেখতে শুরু করেছিস কেন?"
"না বাবা। মানে... কলেজের এত বড় বড় ছেলেমেয়েরা এই কার্টুনটা দেখে আর বলে কিনা ওদের আচরণও নাকি অনেকটা কিসব যেন নবিতা‚ সিজুকা এদের মতো। আমি এই রহস্যটাই উদঘাটন করতে চেষ্টা করছি।"
"কার্টুন দেখে রহস্য একেবারে উদ্ধার করে দিবি! এসব ছেলেমানুষী বাদ দিয়ে বউমাকে সময় দে। খুব শীঘ্রই নাতি-নাতনিদের মুখ দেখতে চাই।"
বাবার মুখে এ কথা শুনে আমার হার্ট অ্যাটাকের উপসর্গগুলো কেমন যেন প্রকাশ পেতে শুরু করলো। এ কেমন বিচার। আমি কিছু না বলে দ্রুত রুমে গিয়ে এক গ্লাস পানি খেয়ে নিলাম। এটা কখনোই সম্ভব নয়। নাবিলাকে স্পর্শ করা... অন্তত এটা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। আমরা একই বিছানায় ঘুমাই ঠিকই তবে মা-বাবার বাধ্যবাধকতায়। মাঝখানে কোলবালিশ দিয়ে দুজন দুদিকে শুয়ে থাকি। দুজন বললে ভুল হবে আমিই এসব ছোটলোকি কাজ করে থাকি। অকারণে মেয়েটাকে প্রতি রাতে কষ্ট দিয়ে থাকি। অমন রূপবতী আর গুণবতী একটা মেয়ে; যাকে সৃষ্টিকর্তা নিজ হাতে সৃষ্টি করেছেন চাইলেই তো আমাকে ডিভোর্স দিয়ে নতুন করে সংসার বাঁধাতে পারতো। তবে কেন আমার মতো উজবুকের ঘরে এতদিন ধরে পড়ে আছে? প্রশ্নগুলো পুনরায় মাথায় ঘুরপাক খেতে লাগলো। বালিশে আধশোয়া অবস্থায় সিগারেট ধরালাম। আচমকা নাবিলা এসে হাজির হলো।
"কি ব্যাপার‚ কোনো দুশ্চিন্তার মধ্যে আছো বুঝি। চাইলে আমার সাথে সবকিছু শেয়ার করতে পারো।"
মেয়েটা কিভাবে আমার মনের ভিতরের কথাগুলো পড়ে ফেলতে পারল! কি করে যে ওকে কথাগুলো বলি। ভেবেই গা শিউরে উঠেছে। কথাগুলো একটাবার শুনলে কতই না কষ্ট পাবে বেচারা‚ বড্ড প্যাথেটিক স্বভাবের এককথায় বললে যাকে বলে আবেগপূর্ণ বা হৃদয়স্পর্শী।
আমি সাহস করে বলেই ফেললাম‚
"নাবিলা, আমার কথা মন দিয়ে শোনো। বাবা কঠোরভাবে বলেছেন উনি নাতি-নাতনিদের মুখ দেখতে চান। তুমি তো জানো‚ আমার পক্ষে সেটা সম্ভব নয়। এক কাজ করো‚ আমাকে ডিভোর্স দিয়ে দাও। ভালো দেখে একটা উকিল ঠিক করে আমি ডিভোর্স পেপারে স্বাক্ষর করে দিব। তুমিও দিও। আর কথা দিচ্ছি‚ তোমার সকল ভরণপোষণের খরচ আমি দেব। তুমি খালি পেপারে সই করে দিও‚" এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে হাফ ছেড়ে বাঁচলাম। নাবিলার চোখ পুরো ভিজে গিয়েছে। চোখের পানি কোমল স্নিগ্ধ গাল বেয়ে গড়গড় করে মাটিতে পড়ছে। শাড়ির আঁচল দিয়ে মুখটা ঢেকে সোজা ছুটে গেল বারান্দায়। এবার মনেহয় চোখের পানি দিয়ে বারান্দা ভাসিয়ে নিয়ে যাবে আর আমি সেই পানিতে ডুবে ডুবে মরে যাচ্ছি। টেবিলের ড্রয়ারে রাখা দিয়াশলাই দিয়ে আরেক দফা সিগারেট ধরালাম।
কাঁদতে কাঁদতে মেয়েটা এবার চোখ দুটো নষ্ট করে ফেলবে। কি যে করি! থামালে‚ কি বলে থামাবো আর থামিয়েও তো লাভ নেই। আমি নাবিলাকে কখনোই শান্তি এনে দিতে পারি নি‚ ওকে খুশি করি নি‚ ওর অনুভূতিগুলো বোঝার চেষ্টা করি নি‚ ওর দুঃখ-কষ্ট তথা মনোবেদনা অনুভব করার চেষ্টা করি নি। আর এখন মুক্ত পাখির মতো ডানা মেলে উড়ে যেতে বলছি। কিছুক্ষণ পর নাবিলা শাড়ির আঁচল নিয়ে চোখ মুছে অতঃপর নাক ঝেড়ে আমার কাছে আসলো।
"আমি তোমাকে ডিভোর্স দিতে পারব না। আমি বাবাকে সব বুঝিয়ে বলব। কেননা আমি তোমার সাথেই থাকতে চাই‚ একই ছাদের তলায়‚ একই চাহনিতে বাস করতে চাই।"
"কিন্তু আমি আর নিতে পারছি না। আমার জীবনটা একেবারে তামাতামা হয়ে গিয়েছে।"
দৃষ্টি নামিয়ে রাখে ও। নাবিলার আইফোনটা হঠাৎ বেজে উঠায় তা রিসিভ করে কানে দিয়ে পুনরায় বারান্দার দিকে এগিয়ে গেল। আমি টেবিল ল্যাম্পের পাশে রাখা মিরর কিউবটাকে কিছুক্ষণের জন্য মেলাবার ব্যর্থ চেষ্টা করলাম।

নিস্তব্ধতাOpowieści tętniące życiem. Odkryj je teraz