অধ্যায়-২৬

64 9 3
                                    


         ফেলিক্স-মারিয়ানা দম্পতির আজ বাইশতম অ্যানিভার্সারি। ছোট-খাটো একটা অনুষ্ঠানে মুখর হয়েছে পুরো অ্যাপার্টমেন্টে। অ্যাপার্টমেন্টের বাইরে কাউকে আমন্ত্রণ করা হয়নি। ফেলিক্স সাহেবের জন্ম নর্থ ক্যারোলাইনার হিলসবারোতে। শহরটি এনো নদীর তীরে আর বেশ সুন্দর শহর‚ মনোরম পরিবেশ। তবে উনি কাজ করেন এক মাল্টিন্যাশনাল ফার্মে এবং কর্মসূত্রেই এদেশে পাড়ি জমিয়েছেন।
         মারিয়ানা ফেলিক্স বয়সে রবার্ট ফেলিক্সের তুলনায় মাত্র তিন বছর পিছিয়ে। উনি একজন ফ্রেঞ্চ হলেও বেড়ে উঠেছেন মিনেসোটার রচেস্টারে। তাছাড়া চল্লিশার্ধদের মধ্যে তিনিই সবচেয়ে আকর্ষণীয় মহিলা। দেখে মনে হয় ত্রিশ কিংবা বত্রিশ হবে। উনার পার্সোনালিটি অনেক শক্তিশালী এবং এই বয়সেও যৌবনকে আঁকড়ে ধরে বসে আছেন। তিনি খুব সহজেই মানুষের সাথে মিশে যেতে পারেন।
         ফেলিক্স সাহেবের সাথে যখন মিস মারিয়ানার দেখা হয় তখন উনার বয়স ছিলো চব্বিশ। তবে তিনি আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ ছিলেন। বাবা ছোটবেলাতেই মারা যাওয়ায় অনেক দুর্দশার মধ্য দিয়ে জীবন কেটেছে তাঁর। কখনো গ্যারেজে কাজ করেছেন তো কখনো টিকিট চেকার হিসেবে। একবেলা খাবার জোটালেও আরেকবেলা কী খাবেন তার নিশ্চয়তা ছিলো না। উচ্চ মাধ্যমিকের গন্ডি পেরিয়ে উনি ইউনিভার্সিটি অব সান ফ্রান্সিসকোতে ভর্তি হন এবং ব্যাপক সফলতা লাভ করেন। তবে সেখানকার খরচ বহন করতে তাকে হিমশিম খেতে হয়। একে তো সেখানে শীত‚ তারপর শরতে সেপ্টেম্বর-নভেম্বরে কিছুটা তাপমাত্রা কমে। সে হিসেবে সারাবছরই শীতের জামাকাপড় পড়ে কাটিয়ে দিতে হয়। ফেলিক্স সাহেব তখন একটা রেস্তোরাঁয় পার্ট টাইম জব করে পড়াশোনার খরচটা চালিয়ে নেন। কখনো বন্ধুদের সাথে ঘুরতে যাওয়া‚ রেস্তোরাঁয় দুপয়সা খাওয়া এগুলো উনার জীবনের অংশবিশেষ ছিল না।
         ফেলিক্স সাহেব যে রেস্তোরাঁয় কাজ করতেন একদিন সেখানে এক দুর্ঘটনা ঘটে বসলো। রেস্তোরাঁর সামনে কয়েকজন দুর্বৃত্ত এসে এক ব্যক্তিকে গুলি করে পালিয়ে যায়। লোকটাকে পড়ে থাকতে দেখে অনেকেই ভিড় জমিয়েছে। ফেলিক্স সাহেব ভিড় ঠেলে সামনে এগিয়ে যেতে থাকেন। মৃত লোকটার পাশে এক অল্পবয়সী যুবতী মেয়ে বয়স ষোলো কি সতেরো হবে একেবারে কান্নায় ভেঙে পড়েছে। তরুণ ফেলিক্স চেষ্টা করেও তাকে কিছু বোঝাতে পারে নি।
         পরদিন পুলিশ এসে ঘটনাস্থল পর্যবেক্ষণ করলো। আসলে লোকটা ছিলেন মেয়েটার বাবা। তিনি ছিলেন একজন ব্যবসায়ী এবং ক্যালিফোর্নিয়া স্টেট কাউন্সিলরের ঘনিষ্ঠ জন। মিনেসোটায় বড়সড় একটা কোম্পানিতে শেয়ারও রয়েছে তাদের। বেশ সম্ভ্রান্ত পরিবার বটে। মেয়েটা পড়তো ওয়ালড্রফ হাই স্কুল নামক এক বোর্ডিং স্কুলে। লোকটা শত ব্যস্ততাকে উপেক্ষা করে মেয়েটাকে সাথে করে ঘুরতে বেরিয়েছিলেন। কে জানত যে এটাই তার শেষ দর্শন হতে চলেছে? ব্যবসায়ীক শত্রুতার জেরে হয়তো অমন নিষ্পাপ মেয়েটার বাবাকে প্রাণ দিতে হলো।
         পরবর্তীতে ফেলিক্স সাহেব জানতে পারেন মেয়েটা নাম মেলিসা। মেলিসা আলেকজান্দ্রা। ফ্রান্সের হনফ্লেয়ার‚ নরমান্ডিতে প্রকৃত আবাস হলেও পরিবার মিনেসোটায় বসবাস করেন। সেখানে থাকেন তার বড় বোন আর তার বিধবা মা। তাছাড়া এখন ব্যবসার দেখাশোনা করার জন্য বড় বোনের উপর চাপ বাড়ছে।
         মেলিসার ছিলো হালকা কোকড়ানো সোনালী চুল‚ ঢেউ তোলা চিবুক‚ পাতলা মেরুন রাঙা একজোড়া ঠোঁট। রেস্তোরাঁয় দেখা হওয়ার পরপরই মেলিসা‚ ফেলিক্স সাহেবের প্রেমে পড়ে যায়। তাদের মধ্যে চলতে থাকে দুষ্টু মিষ্টি খুনসুটি। ভার্সিটির ফল সেমিস্টার শেষ করে ফেলিক্স সাহেব‚ মেলিসার সঙ্গে রচেস্টারে ঘুরতে যান। মেলিসা সর্বপ্রথম তাকে রচেস্টার আর্ট সেন্টারে নিয়ে যায়। আর্ট সেন্টারটা একেবারে জুম্ব্রো নদীর সম্মুখেই অবস্থিত। অতঃপর তাঁরা ক্যাসেল কমিউনিটি হয়ে ক্যামেও অ্যাট দ্য ক্যাসেল রেস্তোরাঁয় খেতে বসলেন।
        জ্যাক ওহলি, দীর্ঘ পনেরো বছর ধরে রেস্তোরাঁয় মাস্টারশেফ হিসেবে কাজ করেন। তাছাড়া মিনেপোলিস‚ সেন্ট পল, ডেনভারে কাজের অভিজ্ঞতা রয়েছে তাঁর। কিন্তু অবশেষে মাতৃভূমির টানে নিজ বাড়ি রচেস্টারেই ফিরে আসতে বাধ্য হলেন। রেস্তোরাঁয় মিডওয়েস্টার্ন ফুড থেকে শুরু করে প্রায় তিন শতাধিক ভ্যারিয়েন্টের খাবারের জুড়ি মেলা ভার। চিলি কন ক্রেইন এবং টোস্টেড র‍্যাভিওলি সেখানকার মূল আকর্ষণ। মেলিসার কথামতো ফেলিক্সও এদুটোকেই বেছে নিলেন। ঠিক ঐ মুহূর্তে ফেলিক্স সাহেব পকেট থেকে একখানা গোল্ডেন রিং বের করে মেলিসার হাতে পড়িয়ে দেন। মেলিসা জানতে চেয়েছিলো যে উনি রিং কেনার টাকা কোথায় পেয়েছিলেন। অবশেষে মেলিসার জোড়াজুড়িতে তিনি বলতে বাধ্য হন। ফেলিক্স সাহেব যে রেস্তোরাঁয় কাজ করতেন‚ মাসের শেষে সামান্য কিছু টাকা জমা করে রাখতেন। রিংটা সেই টাকা থেকেই কেনা। কথাটা শুনে মেলিসা ফেলিক্স সাহেবকে প্রচুর বকাঝকা করে। কেন তার এত কষ্টে জমানো টাকাগুলো দিয়ে রিং কিনতে হবে? তবে ফেলিক্স সাহেব শুধুমাত্র একটা কথাই বলেছিলেন‚ “প্রকৃত ভালোবাসা কখনোই অর্থ দিয়ে কেনা যায় না।”
        ড্যানিকা ওহলি‚ সেন্ট ম্যারি হাস্পাতালের নিউট্রিশন স্পেশালিষ্ট এবং ক্যামেও অ্যাট দ্য ক্যাসেলের প্রধান সমন্বয়কারী। মহিলার জীবনটা অনেক বিচিত্রময়। ডেজার্ট-পেস্ট্রি থেকে শুরু করে রেড ওয়াইন সব বিষয় নিয়েই তিনি গবেষণায় ব্যস্ত থাকেন।
        শতাধিক পার্ক এবং পঁচাশি মাইল বাইক রাইডিংয়ের জন্য উপযুক্ত রাস্তা‚ সবকিছুই ছিলো ফেলিক্স সাহেবের জন্য মনোমুগ্ধকর। ডাউনটাউনের ঠিক এক মাইল দূরত্ব নিয়ে অবস্থান করে সিলভার লেক। রচেস্টারের সবথেকে জনপ্রিয় স্থানসমূহের মধ্যে এটা অন্যতম বলা যেতে পারে।
        মেলিসার মা অসুস্থ। দীর্ঘদিন যাবৎ পারকিনসন রোগে ভুগছেন তিনি। স্বামীর মৃত্যুর পর আরও ভেঙ্গে পড়েছেন। ব্যবসার দায়ভার দুই বোনকেই নিতে হবে। দুই বছরের বড় বোন মারিয়ানার কাঁধেই চাপ পড়ছে বেশি। তবে দুজনই বয়সের দিক থেকে অপরিণত। এক্ষেত্রে বাধ্য হয়ে তাদের চাচা অ্যান্ড্রুকে ব্যবসার দেখভালের দায়িত্ব নিতে হয়।
        রাতের খাবারে আজ বেশ বড়সড় আয়োজন করা হয়েছে। তন্মধ্যে মিডওয়েস্টার্ন ফুডের ছিলো বিচিত্র সমাহার। টেবিলে এক পাশে মেলিসার মা আর আরেকপাশে মেলিসা ও তাদের সম্মানিত অতিথি। এরই মধ্যে রুম থেকে মারিয়ানার আগমন ঘটে। মারিয়ানাকে এক নজর দেখার পর ফেলিক্স সাহেব আর দৃষ্টি ফেরাতে পারেন নি। তখন তিনি ধীরে ধীরে এই একুশ বছর বয়সী তরুণীর দিকে ঝুঁকে পড়েন। মেলিসা প্রথম প্রথম কিছুটা আন্দাজ করতে পারলেও বেচারা ছিলো আলাভোলা প্রকৃতির। কিন্তু যেদিন সে পুরোটা জানতে পারে‚ সেদিন মেলিসা মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়।
        এরপর মিস মারিয়ানা সবসময়ই জীবনের প্রায় প্রতিটা পদক্ষেপেই ফেলিক্স সাহেবের পাশে থেকেছেন। তার ভিতরে রয়েছে মারিয়ানা আলেকজান্দ্রা থেকে মারিয়ানা ফেলিক্স হয়ে উঠার গল্প। শেষের দিকে যদিও মেলিসার সাথে ফেলিক্স সাহেবের সম্পর্কটা তেমন একটা ভালো ছিলো না। তবে মেলিসার মৃত্যুটাকেও তিনি মেনে নিতে পারেন নি। মারিয়ানার ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম ঘটে নি।
         ফেলিক্স-মারিয়ানা দম্পতির যমজ কন্যা ক্রিস্টিনা এবং ক্যারোলিন। নীলচে-সবুজ চোখ‚ সোনালি চুল‚ পাতলা চিবুক সব মিলিয়ে খাপে খাপ ক্রিস্টিনা ফেলিক্স ইউনিভার্সিটি অব মিনেসোটায় অর্থনীতিতে প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী। শোনা যায় বিখ্যাত রেসলার ব্রক লেসনার আর শেলটন বেঞ্জামিনও এই ভার্সিটির ছাত্র ছিলেন। ক্রিস্টিনা কয়েক মাস অন্তর বাবা-মায়ের সাথে দেখা করতে আসে।

You've reached the end of published parts.

⏰ Last updated: Feb 04 ⏰

Add this story to your Library to get notified about new parts!

নিস্তব্ধতাWhere stories live. Discover now