অধ্যায়-৮

41 10 1
                                    

মাথাটা কেমন যেন ভারী ভারী লাগছে। এতদিন যে পরিমাণ অ্যালকোহল সেবন করেছি এটা তারই ফল। এখন এক গ্লাস পেলে মন্দ হতো না। মনটা একটু হালকা হয়ে যেত। বিছানা থেকে একটু উঠে বসলাম। পাশ থেকে মিষ্টি কণ্ঠে নাবিলা বলে উঠলো‚
"কিছু লাগবে? খিদে পেয়েছে বুঝি। কিছু এনে দিই।"
"না‚ তেমন কিছু না। এমনিতেই উঠলাম।"
"বুঝেছি। তোমার ঘুম আসছে না তাই না? শুয়ে পড়ো‚ আমি তোমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি।"
"খবরদার‚ আমার নিকটে আসার চেষ্টা করবে না। নাহলে কিন্তু... "
"কিন্তু কি! আমাকে খুন করবে? চড়-থাপ্পর মারবে? বাপের বাড়ি রেখে আসবে? আর কি করবে শুনি।"
"কিসব অলক্ষুণে কথা বলছো‚ আমি কি এতটাই নিষ্ঠুর নাকি!"
"আমি কি একবারও তা বলেছি? আমি চাই তুমি সেই আগের জীবনে পুনরুজ্জীবিত হও। যেখানে তুমি ওর সাথে রূপালী পর্দার মতো দিনগুলো কাটাতে‚ স্বর্ণাভ স্মৃতিগুলো‚ নিজেদের সেই অন্তরঙ্গ মুহূর্তগুলো উপভোগ করতে। এখনও সেগুলো ফ্রেমবন্দী হয়ে আছে তোমার চোখের সামনে।"
"বলে কি মেয়েটা! ও কি কিছু জেনে গিয়েছে নাকি?" আমি মনে মনে ভাবতে লাগলাম।
"চিন্তা করো না। আমি ওর জীবনধারা সম্পর্কে কিছুই জানি না। তবে তিনটে বছর তোমার কাছে থেকে সবই আন্দাজ করতে পারি। আমাদের শুধুমাত্র একটা মিউচুয়াল বোঝাপড়া করা দরকার।"
মেয়েটা আমার মনের সব কথাই পড়ে ফেলতে পারে। সৃষ্টিকর্তা এই সক্ষমতা ওকে দিয়েছে। ঠিক আমার কারণেই দিয়েছে কিনা বলতে পারবো না। নাবিলা একটু থেমে আবার বলা শুরু করলো‚
"একটাবার ভেবে দেখো তো‚ আমি এই বাড়িতে কেনো পড়ে আছি? একে তো সৎমার কাছে অনাদরে বড় হয়েছি। আমার বাবা চাইলেই তো টাকার জেরে আমাকে আরেকটা বিয়ে দিয়ে দিতে পারতেন। যদিও আমি কখনোই কারও কাছে তোমার দোষ-ত্রুটি তুলে ধরিনি। জীবনের সবচেয়ে কঠিনতম পরিস্থিতিতেও বলেছি যে আমি ভালো আছি। কারণটা কি জানো? কারণ আমি তোমাকে ভালোবাসি। তোমার উষ্ণ ছায়াতল আমাকে উদ্দীপ্ত করে।"
"তা অবশ্য ঠিকই। তবে তোমাকে তো বললামই যে ডিভোর্স দিয়ে আমায় মুক্ত করে দাও। আমি মুক্ত পাখির মতো ডানা মেলে বাঁচতে চাই।"
"মুখ দিয়ে বললেই হলো নাকি। আমি ডিভোর্স দিলে তুমি কী থাকতে পারবে এই অগোছালো জীবন নিয়ে? এখন তো সপ্তাহে দু-একবার বারে গিয়ে ড্রিংক করে আসো। আর ডিভোর্স দিলে তো প্রতিদিন মাতাল অবস্থায় বাড়ি ফিরে আসবে। তুমি তো শুধু আমার চোখের অশ্রুটুকুই দেখতে পাও। মাও যে মনে মনে কত কষ্ট পান সে খেঁয়াল কি তোমার আছে?"
নাবিলা টেবিল থেকে এক গ্লাস পানি উঠিয়ে নিয়ে পান করা শুরু করল। অতঃপর গ্লাসটা রেখে জানালার দিকে তাকিয়ে থাকল।
"হুইস্কির ঝাঁজে প্রফেসরের পদবীটা কিভাবে ধরে রেখেছো তা জানি না। তবে ডোপ টেস্টে ধরা পড়লে তোমার এই অকাল বয়সে চাকরিজীবনের ইতি টানতে হবে।"
"জিনিস যেটা ভালো‚ দাম তার একটু বেশি।"
"ঢেউটিনের বিজ্ঞাপন দেওয়া বন্ধ করো। আর হুইস্কিই কি বা ভালো জিনিস!"
"সে তোমার বুঝে কাজ নেই। দেখ আমি আর তোমার সাথে থাকতে পারছি না। অতিষ্ঠ হয়ে গিয়েছি একেবারে।"
"থাকতে পারবে না মানে! পারতে তোমাকে হবেই। আমি শুধু তোমাকে চাই। তোমার নিকটে এসে তোমার স্পর্শটুকু, তোমার ভালোবাসাটুকু পেতে চাই। তোমার সব গ্লানি মুছে দিতে চাই। তাতে আমার যা কিছু সহ্য করতে হবে আমি তা-ই করবো।"
"পাগল হয়েছে নাকি‚ মেয়েটা!"
"এহ্‚ পাগল তো একসময় ছিলাম‚ কিন্তু এখন আর নই। দেখে নিও‚ একদিন আমি তোমাকে আপন করেই ছাড়বো। তুমি আমার আর আমি শুধুই তোমার। বাইরের কোনো শক্তিই আমাদের আলাদা করতে পারবে না।"
নাবিলার মাথায় যেন নিউক্লিয়ার চেইন রি-অ্যাকশন বিক্রিয়া ঘটছে। একবার শুরু হলে তাকে চালু রাখার জন্য আর অতিরিক্ত শক্তি দিতে হয় না। একেবারে ফ্ল্যাশব্যাক হয়ে উঠেছে সে।
"আমি তোমার কত খেঁয়াল রাখি। সুতরাং‚ তোমার উপর আমার পূর্ণ অধিকার রয়েছে।"
আমি রেগেমেগে বলে উঠলাম‚
"অধিকার ফলাতে এসেছো! টেক কেয়ার করা হচ্ছে তাই না। বের হও ঘর থেকে। আমার চোখের সামনে থেকে দূর হও।"
নাবিলা আর কোনো কিছু না বলে সোজা আমার রুম থেকে বেরিয়ে যায়। আমার সাজানো-গোছানো জীবনটা নিমিষেই ভেঙে চুরমার হয়ে গিয়েছে। তার উপর এখন সেই কাঁটা ঘায়ে নুনের ছিটে পড়ছে। নিজের মনের মধ্যে একটা অস্থিরতা কাজ করতে লাগল। মেয়েটাকে কতই না তিরস্কার করেছি‚ তারপরও বেলাশেষে চুম্বকের মতো আমার সাথে লেগে থাকে।
রাত আড়াইটা বেজে গিয়েছে। আমি একাই বিছানায় শুয়ে আছি। একাকিত্ব কতটা ভয়ঙ্কর হতে পারে সেটা সম্বন্ধে আমার আন্দাজ নেই। এ সম্পর্কে আর সাত-পাঁচ কর্ণপাত না করে ভাবলাম‚ বাড়ির বউকে এভাবে তাড়িয়ে দেওয়া ঠিক হবে না। যতই হোক তিন বছর আগে একটা ভুল করে ফেলেছি। ভুলের প্রায়শ্চিত্ত তো করতেই হবে। হারে হারে সেই মাশুল টের পেলাম। সে আর বলতে! মেয়েটাকে তো খুঁজতে হবে। কোথায় যে গেল মেয়েটা‚ কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরির পরও বাসার কোত্থাও পেলাম না। এত রাতে যদি ছাদে গিয়ে থাকে‚ কিন্তু সেখানেও পেলাম না ওকে।

নিস্তব্ধতাWhere stories live. Discover now