অধ্যায়-১০

42 10 0
                                    

আমাদের সময় এমন করলে তো প্রফেসররা একেবারে কলেজ থেকে বের করেই দিতেন। একই কলেজে পড়ে সেখানেই শিক্ষকতা করছি। এমন ভাগ্য কিন্তু সবার হয় না। মনে পড়লো কলেজ লাইফে বন্ধুদের সাথে বকা খাওয়ার সেই দিনগুলো। খুব মিস করি সেই দৃশ্যগুলো। ওদের সাথে শেয়ার করলাম সেই আনন্দময় মুহূর্তগুলো। তবে আরও যে অনেক কিছুই মিস করে সেটা তো আর শেয়ার করা যাবে না। স্মৃতিটা আমার মাথায় পুরোপুরি গেঁথে গিয়েছে। লিখতে লাগলে কতগুলো ডায়েরি যে ফুরোবে তার হিসেব নেই। কলেজ থেকে আজ দুপুর দুইটায় ছাড়া পেলাম। বাড়িতে এসে নাবিলার দেখা মিলল না। আমি আসলেই দরজা খুলে দিত মেয়েটা। মাকে জিজ্ঞেস করিনি তবুও মা বলল ও নাকি সুপারশপে গিয়েছে। তাছাড়া নতুন একটা মিক্সারও কিনতে হবে। পুরোনোটা নষ্ট হয়েছে কত দিন হলো। মাকে বললাম‚
"তুমিও সাথে গেলে না কেন?"
"আমি গেলে তোকে দুপুরের ভাতটুকু বেড়ে দিবে কে? হাভাতে কোথাকার! চটজলদি ফ্রেশ হয়ে নিয়ে খেতে বস। মুরগির ঝোল রান্না করেছি।"
"কেন মা‚ শুধু ঝোল কেন? মাংস কি পাব না?" মশকরা করে বললাম।
"চুপ কর‚ গাধা কোথাকার। মাংস দেব না তোকে কে বলেছে? মাংসও পাবি তবে নির্দিষ্ট পরিমাণের বাইরে নয়। আর হ্যাঁ‚ একটু পরেই আমি আর তোর বাবা মিলে গ্রামের বাড়িতে যাব। অনেকদিন যাওয়া হয় না। ঘুরে আসি গ্রামটা। শহুরের জীবনে থাকতে থাকতে দম বন্ধ হয়ে আসে।"
"তো কত দিন থাকবে সেখানে?"
"দিন দশেক থাকবো। তবে তুই যেন বউমাকে কষ্ট দিস না আবার। ওর আওতায় তোকে রেখে গেলাম। তোরা হলি মেইড ফর ইচ আদার।"
আমি আর কিচ্ছুটি না বলে খেতে শুরু করে দিই। মা কোত্থেকে যেন ইংরেজি ডায়ালগ দেওয়া শিখেছে তা জানি না। বাবা-মা দুজনেই ধীরে ধীরে আধুনিকায়নের এই যুগে প্রবেশ করছে। এর পর যেটা শুনলাম‚ সেটা শুনে আমার চোখ কপালে উঠে গিয়েছে।
"খেয়ে নিয়ে আমাকে একটা ফেসবুক আইডি খুলে দিস তো।"
আমার গলায় রীতিমতো পানি আটকে গিয়েছে। দমটাও বন্ধ হওয়ার পরিস্থিতি। মা পানি এগিয়ে দিয়ে বলল‚
"তোর আবার কি হলো? পানি খেয়ে নে বেশি করে।"
"মানে ইয়ে... তুমি আবার ফেসবুক অ্যাকাউন্ট খুলতে চাইছো কেন?"
"কেন বলে কি বোঝাতে চাস? আমি বুড়ি হয়েছি? আমি কি ফেসবুক চালাতে পারবো না? তোর বাবার সাথে ছবি তুলে আপলোড দেব। আমার ভাগ্নে-ভাগ্নীরাও ফেসবুক চালায়‚ তাহলে আমি চালালে প্রবলেমই বা কি।"
"না‚ প্রবলেম থাকতে যাবে কেন।"
মায়ের উপর দিয়ে কথা বলার সুযোগ অন্তত আমার নেই। খাওয়া শেষে মাকে খুলে দিলাম সেই ঐতিহাসিক অ্যাকাউন্ট। মার্ক জাকারবার্গ ২০০৪ সালে ঠিক কি কারণে এমন জিনিস সৃষ্টি করল তা বুঝে উঠতে পারলাম না। কোন পোঁকা যে লোকটার মাথায় জেঁকে বসেছিল সেটা কে-ই বা জানে।
মা-বাবা দুজনই বের হবেন এমন সময় মাকে বললাম‚
"মা‚ নাবিলার কাছে কি বাসার এক্সট্রা চাবি আছে?"
"হ্যাঁ‚ ও নিয়ে গেছে। একথা জিজ্ঞেস করছিস কেন?"
"না‚ মানে... এখন একটু বাইরে বের হবো তো। চলো তোমাদেরকেও এগিয়ে দিয়ে আসি।"
"বেশ‚ তবে আয় আমাদের সাথে। ব্যাগগুলো রিকশায় তুলে দে।"
আমি বুঝেছি‚ নাবিলা আর আমাকে তারা বাসায় রেখে গিয়েছেন যাতে আমাদের মাঝের দূরত্বটুকু কমে যায়। রিকশায় ব্যাগগুলো তুলে দেওয়ার পর আমি চললাম সেই পুরোনো কফি ক্লাবটায়। আজকে মন্টু এসেছে আর সঙ্গে করে মেশিন রায়হানকেও নিয়ে এসেছে। রায়হান ছিল আমাদের স্কুল লাইফের বন্ধু। টানা পাঁচটা বছর কাকতালীয়ভাবে আমার সামনের বেঞ্চে বসে পরীক্ষা দিয়েছে। তবে মেশিন নামটার উৎপত্তি ঘটেছে সেই পরীক্ষার হল থেকেই। পরীক্ষায় শেষ ত্রিশ মিনিটে এতই দ্রুত লিখতো যে পুরো ক্লাসে মেশিন ভাই নামে সমাদৃত হয়েছে। এখন সে একটা মাল্টি-ন্যাশনাল কোম্পানির ম্যানেজার পদে আছে। পরীক্ষার হলের সেই দেখাদেখি করে লেখা‚ স্যার কর্তৃক আমাদের খাতা কেড়ে নেওয়ার মতো সুমধুর সেই স্মৃতিগুলো এবং তিক্ত অভিজ্ঞতার দিনলিপিগুলো বলতে শুরু করলাম। এককথায় বলতে গেলে আমরা তিনজন ছিলাম 'থ্রি ইডিয়টস'‚ 'তিন গোয়েন্দা'র সমতুল্য। কলেজ লাইফেও প্রচুর দুষ্টুমি করেছি। ইশ‚ দিনগুলো যদি আর একটাবারের জন্য ফিরে পাতাম!
কফি হাউজের স্পিকারে জে বাভলিনের 'মি জেন্তে' গানটা বাজতে গেল। মন্টু বলে উঠলো‚
"গানটার আগাগোড়া কিচ্ছুই তো বুঝতে পারছি না‚ দোস্ত।"
"সে বুঝে তোর কাজ নেই। আগে বল ভাবির কি অবস্থা। ভাবিকে তো তুই এক মুহূর্তও চোখের আড়াল হতে দিস না।"
"ভাই‚ আজকে তোর ভাবিকে অনেক কষ্ট করে ম্যানেজ করে এখানে এসেছি। কি যে বলব‚ আজকে ওর সাথে শপিং এ যাওয়ার কথা ছিল। ওর মেকাপ সামগ্রী কিনতেই পকেটের অর্ধেক টাকা বেরিয়ে যায়।"
"হুম‚ বহুত কষ্ট হচ্ছে তাই না?"
"কি যে বলিস‚ বউ তো একটাই যে সারাজীবন আমার হাতে হাত ধরে থাকবে‚ সকল কাজেই আমার পাশে থাকবে‚ মৃত্যুর পরও শোকে কাতরাতে থাকবে। তাই তোর ভাবির পিছনে লাখ টাকা খরচ করতেও আমি দ্বিধাবোধ করবো না। ওদের সাথে ঘুরতে পারলে‚ ওদেরকে খুশি করলেই নিজের মনকে খুশি রাখা যায়‚ বুঝলি।"

নিস্তব্ধতাWhere stories live. Discover now