অধ্যায়-২৪

37 9 0
                                    

গত তিন দিন ধরে নীলার সঙ্গে আমার যোগাযোগ হয়নি। ওর ফোনটাও বন্ধ। কোথায় আছে‚ কী করছে কিছুই জানি না। কলেজে ওর বান্ধবীদের জিজ্ঞেস করলাম‚ কেউই ওর খবর দিতে পারে না। এককথায় নীলা বর্তমানে নিরুদ্দেশ। সবকিছু কেমন যেন গুলিয়ে যেতে লাগলো। এলোমেলোভাবে কখনো ক্যাফেটোরিয়ামে‚ কখনো লাইব্রেরিতে কখনোবা পার্কে বসে থেকে সময় কাটাতে লাগলাম। তবে কোনো লাভ হলো না। প্রতিটি মুহূর্ত যেন বুলেটের মতো হৃদয়ে এসে আঘাত হানছে। পার্কের সেই ফুচকাওয়ালা‚ রেস্তোরাঁর সেই চিলি চিকেন আর ক্যারেমেল মাফিন‚ কলেজের মোড়ের সেই সামুচা‚ টেনিস কোর্ট সবই আছে শুধু নীলা নেই। কি আর করার‚ আশায় বাঁচে চাষা। একদিন নয়তো একদিন দেখা হবেই।
মন্টু সন্ধ্যেবেলায় দুকাপ চা নিয়ে এসে হাজির হলো আমার সামনে।
"ভাই কিছু তো অন্তত বল। সারাটাদিন আমাদের সাথে কথা বলিস নি। মুখটা বাংলার পাঁচের মতো করে রেখে দিয়েছিস। নারীর টানে নিজের বন্ধুরে ভুলে গেলে চলবে?"
"কি আর বলবো‚ নাজমুলকে চা দিস নি?"
"ওই ব্যাটা বড়লোক চা খায় না‚ কফি খায়। যা-ই হোক‚ তোকে আজ একটা গল্প শোনাই-"
চায়ের কাপে একটা দীর্ঘ চুমুক দিলাম। চিনিটা বোধহয় কম হয়েছে তবে সেটা ব্যাপার না।
"আচ্ছা তুই বলতে থাক।"
"মধ্যবিত্ত ফ্যামিলির এক ছেলে একটা মেয়েকে টিউশনি করাতো। কিন্তু হঠাৎ করেই ছেলেটা মেয়েটাকে ভালোবেসে ফেলে‚ বুঝলি।"
"তারপর?"
"ও-ই যে ভ্যালেন্টাইন ডের আগে কি সব ডে হয় না.... চকলেট ডে‚ হাগ ডে‚ কিস ডে! তো চকলেট ডে এর দিন ছেলেটা ওকে একটা চকলেট দিয়েছিলো। তারপর হাগ ডে কিভাবে বানাবে সেটা আর ওর মাথার মধ্যে আসে না। তারপর..."
"তারপর কি হলো?"
"খেলনার দোকান থেকে একটা খেলনা মাকড়সা এনে হঠাৎ ওর টেবিলে ফেলে দিলো। আর ব্যাস‚ ভয়ে মেয়েটা এসে ছেলেটাকে জড়িয়ে ধরলো। কারণ মেয়েটা মাকড়সাকে যমের মতো ভয় পেত।"
"ভেরি ইন্টারেস্টিং। তবে ছেলেটা কিস ডে পালন করল কিভাবে?"
"সেটা ভেবে ছেলেটা প্রথমে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছিল। তবে সে দমে যায় নি। কারণ সে উপলব্ধি করতে পেরেছিলো যে মেয়েটারও ওর প্রতি দুর্বলতা আছে। পরেরদিন ওকে পড়াতে গিয়ে দেখলো ও সব হোমওয়ার্ক করে ফেলেছে। এই তো সুযোগ! আদর করে একটা চুমু বসিয়ে দিল কপালে। ঠোঁটে কিংবা গালে তো দেওয়ার সাহস নেই তাই কপালের উপর দিয়েই চালিয়ে দিয়েছে। মেয়েটা এতে তেমন কিছু মনে করে নি। যেভাবেই হোক কিস ডে তো হয়েছে!"
"কিন্তু দোস্ত‚ ছেলেটা ভ্যালেন্টাইন ডে কিভাবে পালন করলো?"
"গল্পটার টুইস্ট তো এখানেই। সব ডে-ই তো পালন করল কিন্তু ভ্যালেন্টাইন ডে‚ এটা তো পালন করা অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে! যে করেই হোক মেয়েটাকে একটা রেড রোজ দিতেই হবে। এমন একখানা প্রত্যয় ব্যক্ত করে ছেলেটা ওদের বাসায় গেল। কিন্তু ঐদিন যখন মেয়েটাকে পড়াচ্ছিলো‚ ওর মা পাশেই বসে ছিল। পাশ থেকে যেন উঠছিলোই না। কিন্তু কি আর করার‚ ছেলেটার জন্য নাস্তার ব্যবস্থা করতে একটু সময়ের জন্য রান্নাঘরে গেল।"
"এরপর কি ঘটল?"
"ছেলেটা মনে মনে ভাবতে লাগলো‚ এই তো সুযোগ! পাশে রেখে দেওয়া ব্যাগটা থেকে সঙ্গে সঙ্গে একটা রেড রোজ ও একটা ভ্যালেন্টাইন ডের কার্ড বের করে দিলো। পিছন থেকে এসে ওর কর্কশমার্কা ছোট ভাই চিৎকার দিল‚ আম্মু‚ আপুর স্যার আপুকে গোলাপ দিচ্ছে। অমনি‚ ওর মা রান্নাঘর থেকে ভাজাকাঠি হাতে নিয়ে ছেলেটার দিকে তেড়ে এল। আর ছেলেটা ব্যাগ ফেলে রেখেই জীবন বাঁচাতে সঙ্গে সঙ্গে পালিয়ে যায়।"
"বাহ‚ প্রেমিক বাঘ তাহলে এখন বিড়াল!"
"রাতের বেলা আর ছেলেটার ঘুম আসে নি। ও ভাবতে লাগলো‚ কেন যে এইসব মেয়েদের বাড়িতে এমন সব ছোট ভাই-ব্রাদার থাকে। ঐ বাড়ি থেকে এখনো গত মাসের বেতন নেয়া হয় নি। অপরদিকে ব্যাগটাও ফেলে এসেছে। নিতে গেলেই তো আবার ভাজাকাঠি নিয়ে তেড়ে আসবে। তার চেয়ে বরং সবকিছু ভুলে যাওয়াই বেটার অপশন।"
"তুই কি চাচ্ছিস আমি নীলাকে ভুলে যাবো? তোর ধারণা ভুল। আমি ওকে কখনোই ভুলতে পারবো না।"
"আরে ভাই‚ আমি সেটা বলতে চাইছি না। তুই শুধু দুশ্চিন্তা করা বন্ধ কর। আর আমিই বা বসে বসে তোকে জ্ঞান দিচ্ছি কেন? তোকে হাজারটা বোঝালেও তুই কিচ্ছুটি বুঝবি না।"
"দূর হয়ে যা চোখের সামনে থেকে!"
"ভালো কথা তো সবারই গায়ে লাগে।"
এভাবেই নিঃসঙ্গতার সাথে আরও দুটো দিন কেটে গেল। রৌদ্রজ্জ্বল বিকেলে কলেজের পিছনের টেনিস কোর্টে একটুখানি উঁকিঝুঁকি মেরে এলাম। অনেকেই প্র্যাকটিসে এসেছে কিন্তু নীলা নেই। মেয়েটাকে কত নিষেধ করতাম যেন রোদের মধ্যে খেলতে না আসে। কারণ রোদে ওর ফর্সা ত্বক একেবারে গোলাপি হয়ে যেত। তবে আজ কেমন যেন মনে হচ্ছে এই প্রখর রোদে একটাবার হলেও যদি ওর দেখা পেতাম। কবে যে ওর সাথে পুনরায় দেখা হবে।
সপ্তাহখানেক পর নীলা হোস্টেলে ফিরেছে। তবে কলেজে আসে নি। কারণ হিসেবে ওর হোস্টেলে ছুটে গেলাম। দরজাটা খুলতেই মেয়েটা চমকে উঠলো। এর আগে কখনো ওর হোস্টেলে আসি নি। তবে নীলার চোখের নিচে কালো দাগ পড়ে গিয়েছে। সাধারণত রাতের পর রাত না ঘুমিয়ে কান্নাকাটি করলে এমন হয়ে থাকে। নীলা কিছু না বলে ভীত হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। আমি ওর কাঁধে দুহাত রেখে বললাম‚
"কি হয়েছে‚ নীলা। এতদিন কোথায় ছিলে?"
নীলা চুপটি করে দাঁড়িয়ে রয়েছে। তবে চোখের পাশ থেকে দুফোঁটা অশ্রু ওর গালের উপর গড়িয়ে পড়ল। এরপর আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে কান্না শুরু করে দিল। নীলাকে এভাবে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে দেখে আমি আতঙ্কে নির্বাক ও হতবুদ্ধি হয়ে গেলাম। সে আর বলতে! আমিও সবকিছু যেন গুলিয়ে ফেলতে লাগলাম। সবকিছু।
"নীলা কান্নাকাটি বন্ধ করো‚ প্লিজ। আর কী হয়েছে সব আমায় খুলে বলো।"
আমি ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিলাম।
"ভালো মেয়েরা এভাবে কান্না করে না। প্লিজ কান্না থামাও‚ নীলা। একটাবার জাস্ট বলো কী হয়েছে। আমিই কী অজান্তে কোনো ভুল করে ফেলেছি?"
এবারে মুখ খুললো মেয়েটা‚
"না‚ ত...তুমি আবার কী করতে যাবে? আসলে আমার চাচি..."
"কি করেছেন উনি? নাকি উনার কিছু হয়েছে? তোমার চাচা ঠিক আছেন তো?"
"আমার চাচি আর এই দুনিয়াতে নেই। উনার কোনো সন্তান-সন্ততি ছিলো না। আমাকেই উনি নিজের সন্তানের মতো দেখতেন। বাবা-মা যখন কর্মসূত্রে হ্যাম্পশায়ারে থাকত তখন তিনিই আমাকে কোলেপিঠে মানুষ করেছেন। আর আমি সেই অভিভাবককে হারিয়েছি যার ঋণ আমি কখনোই ভুলতে পারবো না। এমনকি উনার এই মৃত্যু আমি কিছুতেই মেনে নিতে পারছি না।"
"আসলেই এটা অনেক দুঃখজনক। তাছাড়া কিছুদিন আগেই তো আমায় উনার কথা বলেছিলে তাই না? কি যেন নাম? হ্যাঁ, নিলুফা চাচি।"
"হুম‚ ঠিকই ধরেছো। প্রতিটা মুহূর্তে চাচির কথা মনে পড়ছে। আমি আর নিতে পারছি না। তার উপর আবার..." বলে নীলা পুনরায় কান্না জুড়িয়ে দিলো।
"কী হয়েছে নীলা‚ আমায় খুলে বলো। আমায় সব খুলে না বললে আমি জানব কীভাবে?"
নীলা ক্রন্দনরত অবস্থায় বলতে শুরু করল‚
চাচির সৎকারের দুই দিনের মাথায় আমাদের বাড়িতে বড় খালুর ও তার ছেলে সবুজের আগমন ঘটে। চওড়া কাঁধ‚ বলিষ্ঠ দেহ হলেও নাফিসের মুখটা আমার কাছে বিদঘুটে লাগে। সে তেমন কোনো কাজকর্ম করে না। শুধু মাত্র খালুর জমি দেখাশোনা করে। কিন্তু আসল ব্যাপারটা হলো মা আমাকে ওই সবুজের সাথে বিয়ে ঠিক করে ফেলেছে সেই সঙ্গে বাবাকেও মানিয়েছে।"
"আর তুমি‚ তুমি কী করলে? রাজি হয়েছো নাকি?"
নীলা আরেক দফা কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো। কথা বলার বোধশক্তি হয়তো আর নেই। তারপরেও মেয়েটা অস্ফুটিত স্বরে বলতে শুরু করল‚
"বাবার উপর দিয়ে কিছু বলার সাহস নেই আমার। তবে মৃত্যুর আগে শেষবারের মতো হলেও তোমার ছোঁয়া পেতে চেয়েছিলাম আর আমি জানতাম তুমি আমার রুমে আমার সাথে শেষ দেখা করতে আসবে।"

নিস্তব্ধতাWhere stories live. Discover now