অধ্যায়-১৩

32 10 0
                                    

নাবিলা ছাদে চলে গেল। আর আমি একাই পড়ে আছি সেই তিন হাজার স্কয়ার ফিটের এই অন্ধকার ফ্লোরের উপর। কি করব বুঝে উঠতে পারছি না। ভ্যাপসা গরমের জ্বালা অবশেষে আমাকে ছাদ পর্যন্ত টানতে বাধ্য করল। উঠে পড়লাম ছাদে। ছাদটা যে বিশাল এতে কোনো সন্দেহ নেই। আজ পূর্ণিমার রাত ছিল তা খেঁয়াল করি নি আগে। ছাদে উঠে বেশ ভালভাবেই টের পেলাম। নাবিলা সেই এক কোণায় দাঁড়িয়ে দুহাত দিয়ে স্টিলের রেলিংটা ধরে আছে। নিষ্পাপ শিশুর মতো আপনমনে গুনগুন শব্দে মিষ্টি সুরে গান গাইছে মেয়েটা। খেয়েদেয়ে কাজ নেই‚ আমি কেন ওর গান শুনতে যাব! নিজের পাষাণ হৃদয়ে নিজেই ঘি ঢাললাম। আমি ছাদে হাঁটতে থাকায় অবশেষে মেয়েটা এবার আমার আগমন টের পেল। নাবিলা হাস্যচ্ছলে বলল‚
"শেষ পর্যন্ত নারীর টানে ছাদে আসতে হল তোমায়।"
"আমার নারীর প্রতি কোনো মোহ নেই।"
"সে তো বেশ বুঝেছিলাম‚ সন্ধ্যাবেলায় যখন স্কার্ট-টপস পরিহিত অবস্থায় আমার ছবি আঁকা দেখছিলে আর আমার দিকে হ্যাবলার মতো তাকিয়ে ছিলে।"
আমি এ পর্যায়ে ভাবুক হয়ে গেলাম। ইদানীং মেয়েটা বাড়িতেই সাজগোজ করছে; হালকা-পাতলা লিপস্টিক লাগাচ্ছে‚ মাশকারা দিচ্ছে‚ সামান্য মেকাপও করছে‚ নতুন শাড়ি পড়ছে‚ ওয়েস্টার্ন ধাচের কাপড়-চোপড়ও কিনছে। এগুলো তো আগে আমার নজরে আসে নি। তাহলে পাগলীটা কি আমার নজর কাড়ার চেষ্টা করছে? প্রশ্নটা হল‚ ও বুঝল কিভাবে যে আমি ওর দিকে এভাবে তাকিয়ে ছিলাম।
"কি হলো‚ পানির ট্যাংকটার দিকে এভাবে চুপ করে তাকিয়ে আছ কেন। আমার প্রশ্নের জবাব দাও আগে।"
"কোন প্রশ্ন‚ কিসের প্রশ্ন?"
আমি খানিকটা ভেবে পুনরায় বললাম‚
"ওটা আসলে... ... মানে... তেমন কিছু না।"
নাবিলা এবার একপা-দুপা করে আমার দিকে এগিয়ে আসছে। আশেপাশে লক্ষ্য করলাম গরমের জ্বালায় অনেকেই ছাদে উঠেছে হাওয়া খেতে। নাবিলা এবার আমার একেবারে সন্নিকটে চলে এসেছে।
"তোমরা ছেলেরা আসলে এমনই। নিজেদের ভালোলাগা আর ভালোবাসাকে বুকে আঁকড়ে রেখে বাইরে থেকে তা বিসর্জন দেওয়ার চেষ্টা করো।"
"ছেলেদের ব্যাপারে এত বেশি নাক গলানো আমি পছন্দ করি না।"
"তাহলে কার বিষয়ে নাক গলাবো? তোমার কলেজের ছাত্রীদের উপর।"
"ছিঃ ছিঃ কিসব জঘন্য কথা বলছো। যদিও মানছি আমি রাগী তবে আজ পর্যন্ত আমি কলেজে কোনো ছাত্রছাত্রীর উপর লাঠিচার্জ তো দূরে থাক হাত পর্যন্ত উঠাই নি। ওরা আমাকে কত রেসপেক্ট করে। হ্যাঁ ওদেরকে সামান্য বকাঝকা করি ঠিকই সেটা ওদের ভালোর জন্য। আর ছাত্রীদেরকে আমি নিজের মেয়ের মতো দেখি। আর তুমি এসব কি বলছ।"
"ভেবে দেখেছো‚ আমাদেরও একটা মেয়ে হবে। সারাক্ষণ বাবা যাব‚ বাবা যাব বলে চিৎকার-চেঁচামেচি করে দিন কাটিয়ে দেবে সোনামণিটা। ওকে কত সুন্দর সুন্দর জামাকাপড় কিনে দেব‚ পুতুল কিনে দেব‚ বুড়িটা বড় হয়ে গেলে বিয়ের জন্য গয়না গড়িয়ে দেব আরও কত কিছু দেব তাই না।"
"চুপ! আর একটা কথাও বলবে না। তুমি দিনকে দিন মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে যাচ্ছো। তোমাকে একজন ভাল সাইকিয়াট্রিকে দেখানোর প্রয়োজন।"
"হা হা‚ হি হি।"
"দেখ মেয়েটার কাণ্ড! আবার হাসছে"
অতঃপর নাবিলা আমার বাজুতে আলতো করে ঘুষি মেরে বলল‚
"ধুর বোকা! আমি তো এমনিতেই মজা করছিলাম।"
আমি কিছু বলার আগেই মেয়েটা সিড়ি বেয়ে সেই অন্ধকার কুঠরীতে নেমে গেল। আমার আর কি করার‚ একলা বসে আছি এই নিষ্ঠুর ছাদে। আশেপাশে সামান্য উঁকিঝুঁকি মারলাম। হঠাৎই ট্যাংকের উপর সাদা লেখাটা আমার চোখে পড়ল। সেখানে বড় করে লেখা 'গাজী ট্যাংক'। গাজী নামটা দেখেই আমার গাজী আজমল স্যারের জীববিজ্ঞান বইদুটোর কথা মনে পড়ে গেল। রাতের পর রাত না ঘুমিয়ে কতই না কষ্ট করে বইদুটো পড়েছিলাম সেই কলেজ লাইফে। এখনো বইটা সাফল্যের শীর্ষে। আর এখন ছেলেমেয়েরা পড়া তো দূর‚ রাতভর মোবাইল নিয়ে পড়ে থাকে। পুরো যুগটাকেই বদলে ফেলেছে তারা।
রাস্তায় ল্যাম্পপোস্টটা জ্বলে ওঠা দেখে বুঝলাম ইলেক্ট্রিসিটি চলে এসেছে। বাঁচা গেল এবার। সিড়ি দিয়ে নিচে নেমে এসে দেখি মেয়েটা বিছানার এক কোণায় ঘুমিয়ে পড়েছে। এতদিন আমি ঘুমিয়ে পড়লেও মেয়েটা আকাশের তাঁরা গুনতে ব্যস্ত থাকত। আজ আমি ঘুমাইনি তবুও মেয়েটা ঘুমিয়ে পড়ল কিভাবে? ফ্রিজ থেকে একটা আপেল বের করে তাতে কামড় বসালাম। তারপর ডায়নিং টেবিল থেকে এক গ্লাস পানি পান করে শুয়ে পড়লাম নিত্যদিনের মতো। আজকে সন্ধ্যেবেলায় জিমেও যাওয়া হয়নি। ব্যায়াম করলে সাধারণত রাতে ঘুম ভালো হয়। তার উপর তিল্লে ব্যাগশোর বইয়ের পৃষ্ঠাগুলো মাথায় ঘুরপাক খেতে লাগল। কেন যে বইটা পড়তে গেলাম!
উফ্ একটা সিগারেট ধরালে ডিপ্রেশনটা কেটে যেত। কিন্তু দিয়াশলাই তো খুঁজে পাচ্ছি না। বিছানা থেকে উঠে বুদ্ধি করে রান্নাঘরে গেলাম আর গ্যাসের চুলায় সিগারেটটা ধরিয়ে আনলাম। হোয়াট এ ট্যালেন্ট! নিজেকে বুদ্ধিমত্তাকে নিয়ে অনেক গর্ববোধ হচ্ছে। আজকাল আর গ্যাসের চুলা জ্বালাতে দিয়াশলাইয়ের প্রয়োজন হয় না। উইলিয়াম শেক্সপিয়ার নাকি গাঁজা সেবন করে ব্রিটেনের জাতীয় কবি হয়েছেন। তাহলে এই সিগারেটই বা এমন কি জিনিস।
ঘড়িতে রাত দুটো বেজে আটত্রিশ। এত রাতেও কেন যে ঘুম আসছে না আমার। আমি আবার নাবিলার দিকে ঝুঁকে পড়ছি না তো। সেটা হতেই পারে না। আমি কখনোই নাবিলাকে আমার মন থেকে মেনে নিতে পারব না। চাইলে দুনিয়া উল্টে গেলেও না। মাথাটা কেমন যেন নিউটনের সূত্রগুলোর মত ঘুরপাক খেতে লাগল। মনের কথাগুলো কারো সাথে শেয়ার করতে পারলে ভাল হতো। মনটা হালকা করতে পারতাম। কিন্তু আমি সেই অতীতের ঘটনাবলী কারও সাথে শেয়ার করতে রাজি নই। শত চেষ্টাতেও প্রাণ ভরে কেঁদে নিজের মনটাকে হালকা করতে পারছি না। ফিলিংসগুলো পাথরের মতো বুকে এসে আঘাত হানছে। সে কষ্ট কোনো ওষুধই সারতে পারে না। টাকা-পয়সা দিয়ে ভালোবাসা কেনা যায় না। ভালবাসা কিনতে হলে সেইরকম মানসিকতা থাকা প্রয়োজন‚ একটা রোমান্টিসিজমে ভরপুর অনুভূতিকে থাকতে হয়‚ যেটা একসময় আমার ছিল। তবে এখন আর নেই।

নিস্তব্ধতাWhere stories live. Discover now