অধ্যায়-১৬

36 9 0
                                    

আট বছর পূর্বে-

         সময়টা ঠিক নভেম্বর ২০১৩। সবেমাত্র প্রফেসর হিসেবে কলেজে যোগদান করেছি। এলাকার নামীদামী কলেজের অন্যতম হওয়ায় আমার কদরও বেশ বেড়ে গিয়েছে। বাবা ছিলেন কৃষি অফিসার। চাকরি করতেন নীলফামারী জেলায় আর আমি পড়ে ছিলাম ঢাকায়। এই বাসাতেই তখন আমি‚ মন্টু আর নাজমুল ব্যাচেলর হিসেবে একসাথে ভাড়া থাকতাম। নাজমুল হল মন্টুর দূরসম্পর্কের এক চাচাতো ভাই। বেশ ভাল আর ভদ্র ছেলে ছিল। আমার চাকরি হলেও মন্টু আর নাজমুল এখনো অব্দি চাকরির সন্ধান করতে পারে নি। একারণে প্রায়শই হতাশ দেখা যেত ওদেরকে।
         কলেজে যোগদানের পর নতুন পরিবেশে নিজেকে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছিলাম। স্থানটা একই হলেও আজ প্রফেসরের আসনে বসার সুযোগ পেয়েছি। আর কয়েক মাস পর নতুন বছরের ভর্তি কার্যক্রম চালু হবে। সেই সঙ্গে বিদায় নিবে দুই বছরের অভিজ্ঞতার সাক্ষী এক ঝাঁক স্টুডেন্ট। একসময় আমিও তাদের অন্তর্ভুক্ত ছিলাম। চাকরি করে নিজের জন্য একটা নতুন স্মার্টফোন কিনেছি। সেই সময় একটা স্মার্টফোন থাকা ছিল বিশাল ব্যাপার। ফেসবুক‚ ইউটিউবও তখন বিস্তরভাবে প্রসারিত হচ্ছিল। সে যা-ই হোক‚ জুলাই মাসে কলেজে নতুন স্টুডেন্টদের আগমন ঘটল। নতুন মুখগুলোকে আমরা প্রফেসররা মিলে বেশ উষ্ণভাবে অভ্যর্থনা জানালাম।
         কয়েকদিনের মাথায় প্রথম বর্ষের ক্লাসের একজন ছাত্র আমার সাথে ঝামেলা পাকিয়ে বসল। সেদিন পাশের বেঞ্চ থেকে একজন ছাত্রী এসে ছেলেটাকে বুঝিয়ে থামিয়ে দিল। আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম ওর দিকে।
         “তোমার নামটা কি যেন বলেছিলে?”
         “জ্বি স্যার‚ আমি নীলা।”
         “ও আচ্ছা‚ তবে বেশ ভাল বোঝাতে পার তুমি‚ যেভাবে ছেলেটাকে মানিয়ে নিলে তা দেখে আমার সত্যিই ভাল লেগেছে।”
         “ধন্যবাদ‚ স্যার।”
         “ওকে‚ তুমি এখন বসে পড়ো।”
         কী মায়াবী চেহারা‚ পাতলা গড়ন‚ রেশমি চুল‚ শুভ্র সাদা দাঁতের সেই মিষ্টি হাসি‚ ওর হালকা গোলাপি গালদুটো ধীরে ধীরে মেয়েটার দিকে আমার আকর্ষণ বাড়াতে থাকে। ওর ড্রেস আপ‚ গুছিয়ে কথা বলার ভঙ্গি‚ সরলতা সবকিছুতেই আমি আকৃষ্ট হতে শুরু করি। তখন ওর সতেরো চলছিল। তবে দিন দিন যেন আরও যুবতী হয়ে যাচ্ছে। পড়াশোনায় বেশ ভাল। শুনেছি স্কুল লাইফে প্রতিটা ক্লাসেই ও ফার্স্ট হতো। রোল এক থেকে কখনো দুইয়ে পৌঁছায় নি। এছাড়া আমার লেকচারগুলোও মেয়েটা মনোযোগ দিয়ে শুনত আর নোট করে রাখত। অমন মনোযোগী স্টুডেন্ট আর কয়জনের ভাগ্যে জুটবে!
         নীলা তেমন একটা সাজগোজ করে কলেজে আসত না। শুধুমাত্র চোখে আইলাইনার ব্যবহার করত আর মাঝেমধ্যে ঠোঁটে হালকা মেরুন রঙের লিপস্টিক দিত তবে সেটা গভীর দৃষ্টিতে না দেখলে বোঝা যেত না। তাই বলে ক্লাসে পড়ানো বাদ দিয়ে আমি যে ওর দিকে হা করে তাকিয়ে থাকতাম সেটাও কিন্তু নয়। কলেজ শেষে যখন গেট দিয়ে বান্ধবীদের সঙ্গে গল্প করতে করতে বের হত‚ বড্ড লাজুক দেখাতো ওকে। সেইভাবে বলতে গেলে প্রথম বর্ষে খুব বেশি একটা অভিজ্ঞতা হয়নি আমার। তবে মাঝামাঝি থেকেই ওর প্রতি এক ধরনের দুর্বলতা কাজ করতে শুরু করে। মা-বাবাও অন্যত্র বিয়ের জন্য জোড়াজুড়ি করতে লাগলো। আমি বললাম যে কেবল তো চাকরিটার শুরু। আরও কিছু সময় পর বিয়ের সিদ্ধান্তটা নিলে তেমন কোনো ক্ষতি হবে না আশা করি। বাকি ছয়টা মাস সেই অর্থে স্বাভাবিকতার সাথেই কেটে গেল।
         জানুয়ারি মাসে কি যে শীত পড়ে তা তো সবারই জানা আছে। কুয়াশাচ্ছন্ন রাস্তা আর শিশির ভেজা সকাল এসময়ের এক অতি পরিচিত দৃশ্য। তার সাথে দেখা মেলে বস্তিতে থাকা কিছু শীতার্ত মানুষদের। কত কষ্ট তাদের‚ রুম হিটার তো দূরে থাক দুবেলা দুমুঠো ভাত জোটাতে পারে না। আমি এমন মানুষদের দেখলে যথাসাধ্য চেষ্টা করতাম সাহায্য করতে। কতই আর করব! আমি একা তো আর এদের কষ্ট দূর করতে পারব না।
         ২ জানুয়ারি‚ ২০১৫। বছরের প্রথম শুক্রবার। পুরোনো সিআরটি টিভিটা অন করলাম। নিউজ চ্যানেলটায় একজন রিপোর্টার বলছেন শৈত্যপ্রবাহ নাকি আরও এক সপ্তাহ বিদ্যমান থাকবে। এমন সময় মন্টু দু-কাপ চা হাতে একটা চেয়ার নিয়ে এসে আমার পাশে বসল।
         “দোস্ত‚ চায়ের কাপটা ধর। এক চুমুকে  শরীরটাকে একটু উষ্ণ করে নে। রুম হিটারটাও যেন এই শীতের কাছে হার মেনেছে।”
         “একদম ঠিক বলেছিস। নাজমুল কই? ওকে দিলি না যে?”
         “ব্যাটাকে ভোর সকালে বাজারে পাঠিয়ে দিয়েছি।”
         “এত সকালে ওকে বাইরে পাঠিয়েছিস কেন? দেখছিস না‚ কি ঠান্ডাটাই না পড়েছে।”
         “ফ্রিজে মাছ-মাংস‚ শাক-সবজি কিছুই তো নেই। এছাড়া মুদিখানার দোকান থেকেও কিছু কেনাকাটা করতে হবে‚ তাই আজ ওকে জলদিই পাঠিয়ে দিয়েছি”
         “বেচারা নাজমুল! ব্যাটাকে মাসুম পেয়ে প্রতিদিনই তুই ওকে ভুলিয়ে ভালিয়ে বাজারে পাঠিয়ে দিস। ওকে দেখে খুব মায়া হয় আমার।” এরপর মোবাইলে ক্ল্যাশ অব ক্ল্যান্স বের করে গুতোগুতি শুরু করে দিলাম।
         “কিরে আজকাল তোকে দেখি‚ মোবাইল টিপতে টিপতে একাই একাই হাসিস। ব্যাপার কি? কোনো মেয়ের খপ্পরে পড়েছিস তাই না। নাম কি রে....? ছবিটা একটু দেখা?”
         “ফাইজলামি করিস না তো। দেখ টাউন হল লেভেল তের তে আনছি। তোরটা কত?”

নিস্তব্ধতাKde žijí příběhy. Začni objevovat