লোকসমাগম একদম পছন্দ নয় মোকাররমের। কিন্তু মাহিনের মায়ের ইচ্ছায় বিয়ের জমকালো আয়োজন করা হয়েছে। উনার ছোটপুত্রের বিয়েতে কোনোরকম কমতি রাখতে চান না। গতকাল মেহেদির অনুষ্ঠান হলো ঢাক ঢোল পিটিয়ে৷ মাহিনের বাড়ির সকল নারী অতিথিরা আদ্রতার বাড়িতে ভীড় জমিয়েছে। এ বাড়িতে নারী সদস্য মাত্র তিনজন। নীহারের সময় কোথায় হাত ভর্তি করে মেহেদি দিয়ে পটের বিবি হয়ে বসে থাকার! বিয়ের কনে আদ্রতা, সে নিজেও খুব একটা আগ্রহ প্রকাশ করেনি। তবুও জোরাজুরি করে দু হাত ভর্তি করে মেহেদি পরানো হয়েছে৷ এরপর অতিথিরা সবাই আসন পেতে বসেছে মেহেদির ডালা নিয়ে৷ সারারাত গান নাচে মেতেছিলো সবাই। এদিকে দুহাতে মেহেদি দিয়ে এককোনায় মনমরা হয়ে বসেছিলো আদ্রিকা। এতো সুন্দর করে মেহেদি দিয়ে কি লাভ হলো! বিস্ময় দেখতে পারলো না তার মেহেদি রাঙা হাত। দু মিনিট ফোনে কথা বলবে সেই সুযোগও নেই।
নির্ঘুম রাত কাটিয়ে সবাই ক্লান্ত হয়ে আদ্রতার ঘরে, হলরুমে, বাইরের বারান্দায় গাদাগাদি করে শুয়ে পরেছিলো। সকাল আটটা বাজতেই বিছানা থেকে গুটিগুটি পায়ে নেমে এলো আদ্রিকা। মেঝে ভরা মানুষজন। কে কোনদিকে মাথা রেখে ঘুমাচ্ছে তার ঠিক নেই। একজনের ঘাড়ের উপর আরেকজনের পা। সেসব পেরিয়ে সাবধানে বেড়িয়ে এলো। বাইরের সোফার টেবিলে রাখা ফোন। এই সুযোগে বিস্ময়ের সাথে কথা বলে নেওয়া যায়। ঘুমকাতুরে চোখ দুটো হাতের পিঠে ঢলে বিস্ময়ের নাম্বার ডায়াল করতে যাবেই পেছন থেকে মোকাররমের রুক্ষ কন্ঠস্বর ভেসে এলো।
- সাত সকালে উঠে ফোন হাতে নিছিস কেন? ফোনে কি দরকার তোর?আমতাআমতা করে আদ্রিকা কোনোরকমে জবাব দিলো,
- সময় দেখতেছি আব্বু।
- বাড়িতে ঘড়ি নাই? ফোন দে এদিক। সারাক্ষণ ফোন একটা কোলের মধ্যে নিয়ে ঘুরে৷আদ্রিকার একমাত্র সম্বল বগলদাবা করে নিয়ে গেলো। বিস্ময়ের সাথে যোগাযোগের এই একটা পথ বাকি ছিলো। সেটাও গেলো। রাগে, দুঃখে, হতাশায় সারাটা দিন ঘরে মনমরা হয়ে বসে রইলো আদ্রিকা।
আদ্রতার গায়ে হলুদের কথা ছিলো দুপুর বারোটায়৷ সব গুছিয়ে গায়ে হলুদ যখন শুরু হলো তখন বিকাল তিনটা বাজে। হলুদ জমিন লাল পাড়ের শাড়ি পরে স্টেজে কাঠের ছোট একটি পীড়িতে বসে আছে আদ্রতা। মোকাররমকে জোর করে ধরে নিয়ে এলেন কয়েকজন মহিলা। বাবার হাতে মেয়ের দেহ প্রথম হলুদ ছুঁলো। শক্তপোক্ত আদ্রতার চোখ আদ্র হলো ক্ষণিকেই। ও ভেবেছিলো যাই হয়ে যাক, সে কাঁদবে না। অদৃষ্টের লক্ষণ মেনেই নিয়েছে। কেঁদেকেটে কি হবে! সেই প্রতিজ্ঞায় সূচনায় বিঘ্ন ঘটলো।
হতে পারে মোকাররম মানুষ হিসেবে ত্রুটিসম্পন্ন। হয়তো বাবা হিসেবেও তেমন একটা ভালো নয়। তবুও বাবা তো। পিতৃত্বের প্রথম অনুভূতি পেয়েছে যার আগমণে, সেই মেয়ের বিয়েতে একটুও কি কষ্ট হচ্ছে না? অবশ্যই হচ্ছে। কিন্তু প্রকাশ করতে পারছে না। সারাজীবন মেয়েদের এতো ধমকের উপর রেখেছে, এতো বকেছে যে এখন দুটো আদরের কথা বলতে লজ্জা লাগে। একটু একটু করে পুরো পরিবারের সাথে এতো দূরত্ব কীভাবে সৃষ্টি হয়েছে বুঝতেই পারেনি। মেয়ের গালে হলুদ ছোঁয়ার সময় হাতটা এতো কাঁপছিলো! আশেপাশের মহিলাগুলো কি কি যেনো বলছিলো? দুটো পান পাতায় হলুদ নিয়ে প্রথম দু গালে দেন, কপালে, নাকে, দু হাতে তারপর পায়ের পাতায়। আবছা আবছা শুনেছে কিন্তু এতো কিছু করতে পারলো না৷ এতো দীর্ঘ যাতনা সহ্য করা সম্ভব নয়। কোনো রকম দু গালে হলুদ ছুঁইয়ে দিলো। মাথা নিচু করে কাঁদতে থাকা মেয়েটার শরীর ভীষণ কাঁপছে। মাথায় হাত রেখে আশীর্বাদ করে দ্রুত সেখান থেকে চলে গেলো মোকাররম। ওদিকে কতো কাজ বাকি! বাবুর্চিখানায় ওরা কি করছে কে জানে?
YOU ARE READING
নোলককন্যা
Romanceধীরপায়ে সামনে এগিয়ে এলো বিস্ময়। আদ্রিকার খুব কাছাকাছি দাঁড়িয়ে ফিসফিসিয়ে বললো, - 'আমার আকাশের একটুকরো নিজস্ব মেঘ।' হঠাৎ কানের কাছে কারো আওয়াজে চমকে পিছনে তাকাতে গিয়েও থেমে গেলো আদ্রিকা। বিস্ময় তার খুব কাছাকাছি দাঁড়িয়ে আছে। এতোক্ষণের হারিয়ে যাওয়া ভয়ট...