অপু-গল্পঃ ভুল কিছু...

1.1K 39 4
                                    

পুরো আর্ট গ্যালরীতে একটা হুলস্থুল পড়ে গেল । আর পড়বেই না কেন, দেশের অন্যতম আর্টিস্ট বলে কথা । তার উপর অর্টিস্ট যদি বেশ সুন্দরী হয় তাহলে তো কথা নেই ।

নাদিয়ার হাসান যেন হঠাৎ করেই দেশের সবার নজরে চলে এসেছে । এটো কম সময়ে কেউ এমন নজরে এসেছে কি না কারো জানা নেই । আর ব্যাপারটা ঠিক এরকমও না যে মেয়েটার কোন লবিং কিংবা অন্য কোন কারনে এতো অল্প সময়ে এতো বিখ্যাত হয়ে উঠেছে । মেয়েটার ভেতরে আসলেই কিছু আছে, শিল্পী হওয়ার সব টুকু গুণ নিয়েই যেন সে এই পৃথিবীতে এসেছে । তার চিত্র প্রদর্শনীর শুরুর দিনেই প্রায় সব গুলো ছবি বিক্রি হয়ে যায়, এই প্রদর্শনীতেও তার ব্যতীক্রম হয় নি । আর্ট গ্যালারীর মালিক সুমন ভাই বলেছে যে ওর ছবি বিক্রির জন্য এরপর থেকে প্রদর্শনীর না, নিলাম ডাকা লাগবে । একটা ছবির জন্য নাকি দুজন গ্রাহক প্রায় হাতাহাতির পর্যায়ে চলে গিয়েছিলো ।

নাদিয়ার কেন জানি এসব এখন আর ভাল লাগে না । একটা সময় খুব পছন্দ করতো কিন্তু এতো হইচই তার ভাল লাগে না । নিজেকে গুিয়ে আপন মনেই কাজ করে যায় । এমন কি প্রদর্শনীতে আসারও তার ইচ্ছে ছিল না । সুমন ভাই তার পরিবারের অনেক কাছের মানুষ বিধায় তার অনুরোধ ফেলা যায় নি !

একের পর এক ফ্ল্যাশের আলো আর সেলফির শব্দে নাদিয়ার কেমন যেন অস্বস্থির লাগা শুরু হল । সুমন ভাইয়ের দিকে তাকাতেই সুমন ভাই এগিয়ে এল । সবাইকে বলে দিলো অনেক হয়েছে আবার পরে । নাদিয়া একটু যেন হাফ ছেড়ে বাঁচলো সবার কাছ থেকে মুক্ত হয়ে । তবে কিছু সাংবাদিক তার পিছু ছাড়লো না । ওর পেছন পেছন হাটতেই নানান প্রশ্ন করতে ব্যস্ত । নাদিয়া টুকটাক কথার জবাব দিতে দিতে নিজের সৃষ্টির দিকেই তাকাতে লাগলো । ঠিক তখনই ছেলেটার দিকে তার চোখ গেল !

কালো রংয়ের একটা শার্ট পরে আছে । সেই সাথে খাকি রংয়ের একটা প্যান্ট ! চোখকের কালো ফ্রেমের চশমাটাও দেখা যাচ্ছে । চুপ গুলো এক পাশ থেকে দেখেও বেশ স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে একেবারে এলোমেলো ! এই কটা বছরে ছেলেটা একদম পরিবর্তন হয় নি । একটুও না । ও অনেক বদলে গেছে ।
আসলেই ।

সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাব দেওয়া বাদ দিয়ে নাদিয়া ছেলেটার দিকে এগিয়ে গেল । নাদিয়ার আগমনে সবাই তার সামনে চলে গেছিলো কিন্তু এই ছেলেটা যায় নি । নাদিয়ার পাশে দাড়িয়ে পড়লো । ছেলেটা তখনও একমনেই ছবির দিকে তাকিয়ে আছে ।


এমনই একটা ছবি প্রদর্শনীর দিনই অপুর সাথে প্রথম দেখা হয়েছিলো ওর । ও তখনও চারুকলা থেকে বের হয় নি । ওরা বেশ কয়েকজন মিলে একটা চিত্র প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করেছিলো । প্রায় সব গুলো ছবি বিক্রি হয়ে গেলেও ওর সহ আরও কয়েকটা ছবি তখনও বিক্রি হয় নি । আর হবে বলেও মনে হচ্ছিলো না । অন্যান্য ছবির সামনে অনেকের ভীড় লেগে থাকলেও ওর ছবির সামনে যেন কেউ আসছিলো না ! মুখের ভাবটা ঠিক থাকলেও নাদিয়ার কেমন যেন খারাপ লাগছিলো । জীবনের প্রথম প্রদর্শনীতে এমন হলে যে কারো খারাপ লাগারই কথা । কিন্তু একদিন গ্যালারীতে গিয়ে লক্ষ্য করলো একটা ছেলে অনেক টা সময় ওর আকা ছবির সামনে দাড়িয়ে আছে । একভাবে তাকিয়েই আছে ।

যখন সেটা লম্বা একটা সময় হয়ে গেল নাদিয়া পায়ে পায়ে এগিয়ে গেল ছেলেটার কাছে । পাশে এসে দাড়ালো ! কৌতুহল নিয়েই জিজ্ঞাসা করলো
-এতো মনযোগ দিয়ে কি দেখছেন ?
ছেলেটা ছবি থেকে মুখ না তুলেই বলল
-শিল্পির মনের কষ্ট টা বোঝার চেষ্টা করছি ! ছবিটা আকার সময় শিল্পির মন খারাপ ছিল অসম্ভব । অন্য একটা প্লট নিয়ে আকতে শুরু করলেও পরে সেটা বদলে যায় এবং এতে করেই ছবিটাতে একটা অন্যরকম আবেদম ফুটে ওঠেছে ।

অপু সেইদিন আর বেশি কথা বলে নি । যাওয়ার সময় ছবিটা সেই কি নে নেয় ! নাদিয়ার প্রথম ছবিটা সেই কিনেছিলো ! আজও ছেলেটা একভাবে ওর ছবির দিকে তাকিয়ে আছে । ও পাশে আসতেই অপু বলল
-কেমন আছো ?
নাদিয়া কিছুটা সময় চুপ থেকে বলল
-এই তো ! তোমার খবর কি ?
-ভাল !

আর কোন কথা না । নাদিয়ার অনেক কথা জানতে মন চাইলো কিন্তু কেন জানি বলল না । বলতে পারলো না । খানিকটা অপরাধ বোধ নিজের ভেতরে কাজ করলো । নাদিয়া বলল
-কিনেছো এটা ?
অপু ছবি থেকে মুখ সরিয়ে নাদিয়ার দিকে তাকালো । মুখে একটু হাসি লেগে আছে । কিন্তু নাদিয়ার মনে হল অপু হাসছে না । বরং ওর চোখ বলছে ওর কষ্টের কথা । ওকে ছেড়ে যাওয়াতে ছেলেটা যে কষ্ট পেয়েছে এই ৫ বছরেও সেটা বিন্দু মাত্র কমে নি ! অপু বলল
-তোমার ছবি কেনার মত সামর্থ্য কি এখন আর আমার আছে ?

নাদিয়ার বুকের ভেতরে কেমন যেন একটা দম বন্ধ ভাব হল । মনে হল এখন এখানে থাকলে ও সত্যি সত্যিই মারা যাবে ! কোন মতে ওর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে সোজা নিজের গাড়ির দিয়ে রওনা দিল । এখানে কিছুতেই আর থাকা যাবে না । অপুর কাছ থেকে দুরে চলে যেতে হবে । ঠিক যেমন করে আগেও সে চলে গিয়েছিলো ।


ঐ ছবির কেনার পর থেকেই ওদের ভেতরে দ্রুত সম্পর্ক গড়ে উঠতে শুরু করে । মাঝে মাঝেই ওদের দেখা হতে থাকে । সেই দেখা মাঝে মাঝে থেকে শুরু করে প্রতিদিন হতে থাকলো ।

পড়া লেখা শেষ করার পর নাদিয়ার বাবা ওকে বিয়ে দিতে চাইলো তখন নাদিয়া সোজা মানা করে দিল । সে তখনও বিয়ে করতে প্রস্তুত নয় । বাবা মেয়ের ভেতরে বিবাদের কারনে নাদিয়া ঘর ছেড়ে দিলো এক প্রকার জেদ ধরেই । সোজা উঠলো অপুর বাসাতেই । অপু প্রথমে অবাক হলেও খুশি হয়ে উঠলো অনেক ।

নাদিয়ার ঐ দিন গুলোর কথা খুব ভাল করে মনে পড়ে এখনও । কি আনন্দের দিনই কাটছিলো । কিন্তু একটা পরিবর্তন ও ঠিকই বুঝতে পারছিলো । নাদিয়া ছবি আটকে পারছিলো না । কোন ভাবেই কিছু আসছিলো না । একটা পর্যায়ে ও বুঝতে পারলো যে ওর ছবি না আঁকতে পারাটা আসলে ও অপু ! এর আগেও ওর ব্যাপারটা লক্ষ্য করে দেখেছে । অপুর সাথে থাকলেই ওর আঁকাটা ঠিক আসে না ।

সিদ্ধান্তটা সহজ না । ওকে ছবি আর অপুর মাঝে যে কোন একজন কে বেছে নিতে হয়েছিলো । নাদিয়াকে আটকায় নি সেদিন অপু ! বলেছিলো তোমার যেটা মনে চায় সেটাই তুমি কর । আমার সমর্থন আছে তোমার সাথে । সারা জীবনই থাকবে !
নাদিয়া ছবিটাকেই বেছে নিয়েছিলো । ফল স্বরূপ আজকে তার এই অবস্থান । অপুর কাছ থেকে চলে আসার পর থেকে ওর যেন হাত থামতোই না । একের পর এক ছবি একেই চলতো । বিশেষ করে অপুকে ভুলে থাকার জন্য । এতো দ্রুত ওর নাম ছড়িয়ে যাবে সেটা ও নিজেও বুঝতে পারে নি । কিন্তু এতো কিছু পাওয়ার পরেও বুকের ভেতরে কি যেন একটা আটকেই আছে ! এই আটকে থাকা কেন আটকে সেটাও নাদিয়া খুব ভাল করেই জানে । কিছু পাওয়ার জন্য কিছু ছেড়ে দিতে হয় কিন্তু নাদিয়ার কাছে সেই শুরু থেকেই মনে হয়েছে যে সে যেন তার যেটা ছাড়ার কথা ছিল সেটা সে না ছেড়ে দিয়ে অন্য কিছু ছেড়ে দিয়েছে ! 

ভালবাসার অনু-গল্প সমগ্রWhere stories live. Discover now