-ক্লান্ত ?
নাইরা হাতের ব্যাগটা ফ্লোরের উপরে রাখলো থপ করে । কিছু জিনিস পত্র বেরিয়ে এল সেখান থেকে । ওদিকে খুব একটা লক্ষ্য দিল না । ওর চোখ মুখের দিকে তাকিয়েই মনে হচ্ছে ওর অনেক ক্লান্ত । পারলে এখনই ঘুমিয়ে পড়ে । আমার দিকে তাকিয়ে হাসলো । ক্লান্ত থাকা সত্ত্বেও ওর এই হাসিতে কোন ক্লান্তি নেই । বরং খানিকটা উজ্জ্বাল্য আছে । নাইরা বলল
-খুব ।
-বাধরুমে পানি গরম করা আছে । গোসল সেরে আসো । খাওয়া রেডি প্রায় !
-কি রান্না হচ্ছে ?
-তোমার ফেভারেট আইটেম ! চিংড়ি মাসের দো-পেয়াজো, আলু ভর্তা ডাল ।
নাইরা আবারও হাসলো । তারপর সোজা এসে আমাকে জড়িয়ে ধরলো । অনেক সময় ধরে জড়িয়েই ধরে রাখলো । মুখটা খানিকটা আমার বুকের ভেতরে ডুবিয়ে উষ্ণতা পেতে চাইছে যেন । এইকাজটা ও প্রায়ই করে । বাইরে থেকে এলে সবার আগে আমাকে জড়িয়ে ধরা চাই । তার বক্তব্য অনুসারে এতোটা সময় তোমাকে ছেড়ে বাইরে ছিলাম, তাই আগে তোমাকে জড়িয়ে ধরে থাকি কিছু সময় !
নাইরার এই ব্যাপার টা আমার সব থেকে বেশি ভাল লাগে । আমাকে এমন কিছু একটা মনে করে যেন আমি ছাড়া ওর আর কেউ নেই । এখনও ভাবতে খানিকটা অবাকই লাগে । কয়েক মাস আগে ও আমাকে ঠিক মত চিনতোও না আর আজকে আমাকে ছাড়া যেন ওর একটা দিনও চলে না । নাকটা আবারও আমার বুকের ভেতরে ঘষতে ঘষতে বলল
-ইউ নিউ, রাইট ? ইউ ওলোয়েজ নো ! আমার কখন কোন টা লাগবে কোনটাতে আমি খুশি হব সব ...
-আই ওলোয়েজ লাভ ইউ !
নাইরা আরও কিছু সময় আমার বুকে মাথা রেখে চুপ করে উষ্ণতা নিতে থাকলো । আমি বললাম
-যাও জলদি গোসলে যাও । সময় দেখেছো ? দুটো বেজে গেছে ।
-বাজুক !
-আরে বাবা রান্না এখনও শেষ হয় নি । পুড়ে যাবে তো । পোড়া চিংড়ি আবার খেতে পারতে না ।
নাইরা মাথা তুলল । তারপর অনিচ্ছা সত্ত্বেও ভেতরে দিকে পা বাড়ালো । যেতে যেতে আমার দিকে তাকিয়ে বলল
-আজকে কিন্তু আমি খুব বেশি ক্লান্ত । হাত দিয়ে খাবো না ।
আমি হাসলাম । মেয়েটা কেমন দিন দিন কেমন বাচ্চা হয়ে যাচ্ছে । মানুষের বয়স বাড়ে এর যেন বয়স কমছে । অবশ্য ও যে সময়টার ভেতরে দিয়ে গেছে সই সময়ে মানুষ খুব কমই রিকভার করতে পারে । ও যে পেরেছে সেটা অনেকটাই বড় কিছু । অবশ্য খুব একটা বড় ধরেনর দুর্ঘটনা ঘটার সময় এবং জায়গাতে আমি নিজে উপস্থিত ছিলাম । বলা চলে আমি সেদিন সেখানে উপস্থিত না থাকতাম তাহলে আজকে হয় তো নাইরা চৌধুরী এখানে থাকতো না ।
দুই
নাইরা চৌধুরী, বিখ্যাত বাবার বিখ্যাত মেয়ে । ওর বাবা এদেশের একজন নাম করা টিভি অভিনেতা, সেই সাথে এখন পরিচালক । মেয়েও হয়েছে ঠিক বাবার মত বিখ্যাত । বলা চলে আরও একটু বেশি বিখ্যাত । বাবা তো কেবল টিভিতেই অভিনয় করতো কিন্তু টিভি এবং সিনেমা দুই জায়গাতেই সমান দাপটে অভিনয় করছিলো ।
আমার সাথে ওর কিভাবে পরিচয় ?
সেটা এক মজার কাহিনী । বড়লোকদের যেমন অনেক জায়গায় ফ্ল্যাট থাকে ঠিক তেমনি নাইরারও অনেক জায়গায় ফ্ল্যাট ছিল । আর একটা ছিল ঠিক আমার উপরের ফ্ল্যাটে । মানে আমি যেখানে ভাড়া থাকতাম তার উপরে । ১৬ তলা বাসার একদম টপ ফ্লোরে ওর একটা ফ্ল্যাট রয়েছে । আমি অবশ্য আগে থেকেই জানতাম যে ও এখানেই থাকে মানে মাঝে মাঝে এখানে থাকতে আসে । আমার কাছে ছাদে যাওয়ার চাবি ছিল । মাঝে মাঝেই আমি ছাদে গিয়ে হাজির হতাম রাতের বেলা । তখন মাঝে মাঝে নাইরা কে দেখতে পেতাম । বিখ্যাত মানুষেরা খানকটা নিঃসঙ্গ হয়, তখন নাইরাকে দেখে আমার কেন জানি মনে হত যে মেয়েটা এতো বিখ্যাত হওয়া সত্ত্বেও খানিকটা নিঃসঙ্গই । যদিও ওর কাছে গিয়ে কথা বলা হত না ।
ওর সাথে কথা কথা বলার ঠিক তিন দিন আগের ঘটনা । দেশের মিডিয়া প্রাঙ্গনে একটা ভিডিও নিয়ে তোলপাড়া শুরু হয়ে গেল । এটা খুব একটা বড় কোন বিষয় না যে মাঝেমাঝে আমাদের এখানে ভিডিও বের হত । কিন্তু তোলপাড়ের কারন হচ্ছে ভিডিও টা ছিল সায়েম রহমানের । এই সায়েম রহমান নিজেও একজন বড় অভিনেতা । বড় পর্দা কাঁপানো নায়ক । আর সব থেকে বড় কথা হচ্ছে এই সায়েম রহমানের সাথেই নাইরার বিয়ে হওয়ার কথা ছিল । বিয়ের দিনক্ষন এমন কি কমিউনিটি সেন্টার পর্যন্ত ঠিক হয়ে গেছে তখনই ভিডিওটা বের হয়েছে । এটা নিয়ে সোস্যাল মিডিয়াতে আলোচনার শেষ নেই ।
সবাই যখন এমন রসালো আলোচনা নিয়ে ব্যস্ত তখন আসলেই কেউ জানে না নাইরার অবস্থা কেমন কিংবা ওর মনের উপর দিয়ে কি চলছে । আগেই বলেছি বিখ্যাত বাবার বিখ্যাত মেয়ে হওয়ার সাথে সাথে মেয়েটা খানিকটা বিষণ্ণও ছিল । আর যত আধুনিক আর বিখ্যাত হয়ে যাক না কেন একটা মেয়ের বিয়ে ঠিক হয়ে যাওয়ার পরে এমন ঘটনা ঘটলে সেটা মেয়েটার পক্ষে সহ্য করে করা খুব কঠিন হয়ে পরে ।
আমি ছাদে হাওয়া খাচ্ছিলাম তখনই নাইরাকে ছাদে আসতে দেখলাম । কিছুটা সময় এদিক ওদিন হাটাহাটি করলো এদিক ওদিক খানিকটা উদ্ভ্রান্তের মত । মনে যেন ঠিক মত যেন পা ফেলতে পারছে না । তারপর রেলিংয়ের কাছে গিয়ে নিচের দিকে একভাবে তাকিয়ে রইলো । আমার তখনই মনে হল মেয়েটা কোন দুর্ঘটনা ঘটাতে যাচ্ছে । আমি নাইরার কাছে গিয়ে হাজির হলাম । শান্ত কন্ঠে বললাম
-লাফ দিবেন ?
নাইরা যেন চমকে উঠলো । আমাকে এখানে আশা করে নি নিশ্চয়ই । তবে সামলে নিলো একটু পরেই । আমার দিকে তাকিয়ে বলল
-দিলে কি করবেন ? ঠেকাবেন ?
-না না না ! ঠেকাবো কেন ? আসলে আমিও লাফ দিতেই ছাদে এসেছি । কিন্তু একা একা কাজটা করতে ঠিক সাহস হচ্ছে না । তাই একজন সঙ্গি পেলে মন্দ হত না । তাই জানতে চাইলাম ? দিবেন !
নাইরা আমার দিকে তাকিয়ে রইলো একভাবে । সিড়ি ঘরে একটা ৬০ পাওয়ারের লাইট জ্বলছে । সেই আলোতে আমরা একে ওপরকে দেখছি । নাইরা বোঝার চেষ্টা করছে আমি ওর সাথে কোন প্রকার ঠাট্টা করার চেষ্টা করছি কি না ! আমি বললাম
-কি বিশ্বাস হচ্ছে না ? চলুন এক সাথে ঝাপ দিয়েই ফেলি !
আমার গলার আত্মবিশ্বাস ভরা কথা শুনে নাইরা একটু যেন ভরকে গেল । একা একা ছাদ থেকে লাফ দেওয়ার সিদ্ধান্ত যে কেউ নিতে পারে কিন্তু চোখের সামনে আরেকজন তার সাথে ঝাপ দিয়ে রাজী হয়ে গেলে মানুষ ব্যাপারটা সহজে নিতে পারে না । নাইরাও নিতে পারছে না । আমি বললাম
-জানতে চাইবেন না আমি কেন ঝাপ দিতে যাচ্ছি ?
-কেন ?
-কোন কারন নেই । মাঝে মাঝে মানুষ কোন কারন ছাড়াই অনেক কাজ করে । অনেক দিন থেকেই ভাবছি এমন একটা কাজ করবো । কি লাভ এমন মিলিংলেস জীবন রেখে । তবে ...
-তবে কি ?
-লাফ দেওয়ার আগে একটা কাজ আমি ঠিক করেছি করবো । যেহেতু আমরা দুজনই একটু পরে মারা যাবো আমার মনে হয় একটা ছোট ইচ্ছা আমি পূরন করতে পারি ।
-কি সেটা ?
-আমার অনেক দিনের ইচ্ছে কোন সুন্দরী মেয়েকে একটা চুমু খাবো ! মরার আগে এই ইচ্ছেটা আপনি ছাড়া আর কেউ পূরন করতে পারবে না ।
এই বলে আর দেরি না করেই আমি চট করেই নাইরার গালে একটা চুমু খেয়ে ফেললাম । নাইরা কিছু সময় কি বলবে কিছুই বুঝতে পারলো না । আসলে এতো দ্রুত আমি কাজটা করেছি যে সে কিছু ভাবার সময়ই পায় নি । যখন বিশ্ময় কাটলো তখন ও ভীষন রেগে গেল । আমাকে মারতে এল হাত দিয়ে । মুখ দিয়ে ঠিক মত কথাও যেন বের হচ্ছে না ।
-আপনার সাহস তো কম না । আপনা .... আপনি ......
আরও কত টা সময় আমার চিৎকার করতে লাগলো । তারপর সোজা সিড়ির দিকে পা বাড়ালো । যাওয়ার আগে বলে গেল আমাকে দেখে নেবে ....।
আমি মনে মনে হাসলাম । মেয়েটার সুইসাইড করার ঝোকটা যে আমার দিকে কনভার্ট করানো গেছে এটা দেখে ভাল লাগলো । মেয়েটা অন্তত আগামী কয়েকদিন আর ঐ দিকে পা দিবে না । আমার উপর রাগটা যতক্ষন থাকবে ততক্ষন মেয়েটার চিন্তা ভাবনা ঐদিকে যাবে না ।
তবে একটা সমস্যা অবশ্য আছে । নাইরাকে যে চুমু খেয়েছি এটা নিয়ে ও কেমন করে রিএক্ট করে সেটা একটা চিন্তার বিষয় । পুলিশ পর্যন্ত নিয়ে আসতে পারে । সেক্সচুয়্যাল হ্যারাজমেন্টের কেইসও দিতে পারে । অবশ্য এটা মেনে নেওয়া যায় যদি মেয়েটা আর সুইসাইড এটেম্ট না নেয় ।
পরদিন অফিস থেকে যখন বাসায় এসে ফ্রেস হচ্ছি তখনই কলিংবেল বেজে উঠলো । দরজা খুলে অবাক হয়ে গেলাম । নাইরা চৌধুরী দাড়িয়ে আছে । আমি একটু পেছনে তাকানোর চেষ্টা করলাম । দেখি ওর পেছনে আর কেউ নেই । আমি বললাম
-আসুন !
নাইরা কোন কথা না বলে চুপচাপ ভেতরে ঢুকলো । আমি বললাম
-আপনি একটু বসুন আমি আসছি । ভেতরে গিয়ে টিশার্ট গায়ে দিয়ে এলাম । একটু আগে কেবল তোয়ালে পরে ছিলাম । নাইরার জন্য চাও বানিয়ে নিয়ে এলাম । ও কিছুটাসময় চুকপচাপ চুমুক দিয়ে গেল । তারপর বলল
-কালকে আপনি ঐ কাজটা কেন করলেন ?
আমি একটু মুচকি হেসে বললাম
-আই থিংক আপনি ধরতে পেরেছেন আমি কেন কাজটা করেছি ? পারেন নি ?
-হুম !
-এখনও কি মাথার ভেতরে ঐ চিন্তা আছে ?
এই প্রশ্নটার উত্তর নাইরা চট করে দিল না । চুপ করে রইলো । আমি বললাম
-আমি ছোট বেলা থেকেই খানিকটা একা তাই না ?
এবারও চুপ করেই রইলো তবে আমার দিকে তাকিয়ে । আমি বলল
-অবশ্য এটা কেবল আপনি না । সব বিখ্যাত মানুষের সন্তানেরাই এমন । তারা না অন্যদের মত অন্যদের সাথে স্বাভাবিক ভাবে মিশতে পারে না অন্যেরা পারে ।
-দোষ টা কি আমার ?
-দোষটা আসলে কারই না । তবে .....।
-তবে কিছু না । আসুন একটা কাজ করা যাক ।
-কি কাজ ? আপনার একাকিত্ব দুরীকরন কর্মসূচি গ্রহন করা যাক । বিশেষ করে ঐ ব্যাপারটা ভুলানোর জন্য আপনার এই একাকীত্ব কানানো খুব বেশি জরুরী । এটা যদি আপনার ভেতরে থেকে যায় তাহলে আজ হোক কাজল হোক আপনি ঐ রকম কাজ আবারও করতে যাবেন । তখন হয়তো চুম খাওয়ার মত আর কেউ থাকবে না !
নাইরা হেসে ফেলল । আমিও হাসলাম ।
-আচ্ছা আপনার এখনও পর্যন্ত কোন কাজটা করতে ইচ্ছে হয়েছে খুব কিন্তু করতে পারেন নি ।
নাইরা কিছু সময় ভেবে বলল
-এমন অনেক কাজই আছে ।
-যে কোন একটা বলুন । যেটা এখন মনে হচ্ছে ।
-রাস্তার ধারে দাড়িয়ে ভেলপুলি খাওয়া । এমনিতে যে ভেলপুরি খাই নি তা না তবে রাস্তার ধারে দাড়িয়ে খেতে অনেক ইচ্ছে করতো ...
-ওকে চলুন !
-মানে ?
-মানে চলুন আজ এবং এক্ষুনি সেটা করবেন !
-আরে আপনার কি মাথা খারাপ হয়েছে ! মানুষজন যদি টের পায় ....
-আরে এমন ভয়ে ভয়ে চললে তো হবেই । চলুন দেখা যাক কি করা যায় ।
সেদিন নাইরা আমার সাথে সত্যি সত্যিই ভেলপুরি খেতে বের হয়ে গেছিলো । রাত বলে ব্যাপারটা অনেক সহজ হয়েছিল তবুও কেউ একউ যে ওকে চিনতে পেরে এগিয়ে আসছিল না তা না কিন্তু দ্বিধার কারনে কিছু জিজ্ঞাসা করতে পারে নি । আসলে ও যে এমন রাস্তার ধারে এসে ভেলপুরি খেতে পারে এটা কেউ ভাবতেই পারে নি ।
তারপর থেকেই নাইরার সাথে আমার যোগাযোগ বাড়তে লাগলো । শুটিং একদম বন্ধ করে দিয়েছিল, ও নাকি শুটিং করতে পারছিলোই না । অফিস থেকে ফিরে এসে দেখতাম ও আমার ঘরেই বসে আছে । টিভি দেখেতে নয়তো বই পড়তে । অফিসেও ওর ফোন আসতো আমিও সময় পেলেই ওকে ফোন দিতাম । বুঝতে পারছিলাম মেয়েটার সাথে আস্তে আস্তে জড়িয়ে যাচ্ছি কিন্তু মেয়েটাকে একা একা রেখে চলে আসতেও মন চাচ্ছিলো না !
তারপর ওকে বললাম যে আবারও ওর কাজ শুরু করা উচিৎ । অনেকটা উৎসাহেই ও কাজ শুরু করে দিল এবং আস্তে আস্তে সব ঠিক হতে লাগলো । ও নিজে নিজে রিকভার করতে লাগলো । মনে মনে একটু মন খারাপ লাগছিলো কারন জানতাম ও ঠিক হয়ে গেলে, সামলে নিলে হয়তো আমার প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়ে যাবে । কিন্তু ভুল ভাঙ্গলো কদিন পরেই ।
শুটিংয়ের কাজে ও শ্রীমঙ্গল গিয়েছিল । তিনদিনের একটা ট্যুর ছিল । তিনদিন ওর সাথে দেখা নেই । আমি নিজের মাঝেই ফিল করতে পারছিলাম যে আমি নাইরার উপর ফল করেছি । মেয়েটা প্রবল ভাবে মিস করতে শুরু করেছি । ফোনে কয়েকবার কথা হলেও না দেখে কেমন জানি লাগছিলো । তিনদিন পরের কথা । অফিস থেকে বাসায় ফিরে দেখি নাইরা ঠিক আগের মত আমার ঘরে বসে আছে । ওর কাছে আমার ঘরের একটা চাবি আমি দিয়েই রেখেছিলাম । আমাকে দেখতেই খানিকটা উড়ে চলে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরলো । এর আগে ও আমাকে কোন দিন জড়িয়ে ধরে নি । তাও এতো শক্ত করে । আমি কিছু বুঝে উঠতে পারছিলাম না । বললাম
-কি হয়েছে ?
কোন কথা না বলে নাইরা আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রাখলো । তারপর অনেকটা সময় পরে ও যখন আমাকে ছাড়লো ওর চোখের দিকে তাকিয়ে দেখি সেখান থেকে পানি পড়ছে । বললাম
-কি হয়েছে বলবা তো ?
-এই কদিন আমি তোমাকে এমন ভাবে মিস করবো বুঝতে পারি নি ।
-আমিও বুঝতে পারি নি । আসলেই পারি নি । কিভাবে দিন কেটেছে কেবল আমি জানি
নাইরা কান্না মিশ্রিত হাসি বলল
-আমরা দুজনেই দুজনের প্রেমে পড়েছি । তাই না ? তুমি কিভাবে আমাকে আটকে ফেলেছো আমি জানি না ।
-আমারও তাই মনে হচ্ছে !
-আমি এই খান থেকে মুক্ত হতে চাই না । বুঝেছো তুমি ? বুঝেছো ?
-হুম
তারপর যতদিন যেতে লাগলো মেয়েটা আমাকে তত ভালবাসতে শুরু করলো । নাইরা আমাকে পাগলের মত ভালবাসতে শুরু করার পেছেন আরেকটা কারন ছিল যে আমার সাথে ও ওর ভেতরের নাইরাটাকে বের করে আনতে পারতো । আমার সাথে থাকলে ও এমন সব কাজ করতে পারতো যা ও সারা জীবন ভেবে এসেছে । দিন যত যেতে লাগলো মেয়েটা যেন আমাকে ছাড়া আর কিছু বুঝতে চাইতো না । ব্যাপারটা আমি যেমন বুঝতে পারছিলাম ও নিজেও সেটা খুব ভাল করেই বুঝতে পারছিলো ।
তিন
নাইরার জন্য আমার এই বাসায় আলাদা একটা রুম ঠিক করা আছে যদিও সেটার খুব দরকার পরে না । ওর জামা কাপড় ওর নিজের ফ্ল্যাটাট থেকে আমার এখানেই বেশি । গত ছয় মাসে ও ওর বাবা মায়ের বাসা থেকে আমার এখানেই বেশি সময় থেকেছে । এমন কি আমি যখন এখানে থাকতাম না তখনও ও এবাসায় থাকতো । নিজের ফ্ল্যাট থেকে আমার এখানে থেকে কি মজা পেত আমার জানা ছিল না । এখান থেকে সোজা স্যুটিংয়ে যেত আবার এখানে এসে হাজির হত ।
আজকে ওর গাজীপুরে শুটিং ছিল । সকাল বেলা এখান থকেই গেছে এখন আবার থেকে সরাসরি এখানে এসে হাজির হয়েছে । ওর বাবার বাসায় যায় নি কতদিন কে জানে ।
গোসল শেষ করে আমার একটা সাদা টিশার্ট পরে খাবার টেবিলে এল । আমি ওর দিকে তাকিয়ে আবারও হাসলাম । মেয়েটা আসলে দিন দিন যেন আরও ছোট হয়ে যাচ্ছে । ঘর ভর্তি ওর নিজের জামা কাপড় রয়েছে তবুও ওর আমার শার্ট আর টিশার্ট না পরলে নাকি ওর কাছে ভাল লাগে না । আমার তো মনে হয় আমার জামা কাপড় আমার থেকে ও নিজেই বেশি পরে ।
একবার জানতেও চেয়েছিলাম
-এমন কেন কর শুনি ?
জবাবে ও হেসে বলেছিল
-তোমার টিশার্ট গায়ে দিলে ওর মনে হয় তুমি যেন আমার শরীরের সাথেই লেগে আছ ।
-সেটা তো তুমি চাইলেই পারো । কেউ তো তোমাকে বাঁধা দিতেছে না ।
-ও তুমি বুঝবে না ।
আমি আসলেই বুঝি নি । কেবল হেসেছি । মনের ভেতরে একটা অচেনা আনন্দের অনুভুতি হয়েছে ।
খাবার টেবিলে দুইটা প্লেট রাখতে দেখে নাইরা বলল
-বললাম না আমি ক্লান্ত । নিজের হাতে খেতে পারবো না ।
একটা প্লেট উঠিয়ে রাখলাম ।
-খুশি ?
-হুম !
ওর মুখে খাবার তুলে দিতে লাগলাম । সেই সাথে আজকে কোথায় কি হয়েছে কেমন কে কি বলেছে সেই বিষয়ে কথা বলতে লাগলো । প্রত্যেকটা খুটিনাটি আমাকে বলতেই হবে । আমি এক সময়ে বললাম
-বাবার বাসায় যাও না কত দিন ?
দেখলাম ওর মুখটা একটু কঠিন হয়ে গেল । বলল
-জানি না ।
-যাবে না আর ?
-না ! কেন তুমিও কি তাড়িয়ে দিবে ? তাড়িয়ে দিলেও যাবো না । এখানেই থাকবো !
-আরে আমি কি সেই কথা বললাম নাকি ? তোমার বাবা উনি । নাকি ?
-আমার বাবা নিয়ে তোমার বেশি চিন্তা করতে হবে না ।
-আরে সম্পর্কে তো উনি আমার বাবাই হবেন নাকি ? চিন্তা করতে হবে না ?
কঠিন মুখ একটু নমনীয় হয়ে এল । নাইরা হাসলো । তারপর বলল
-তাই ?
-হুম । একদম তাই ।
নাইরা সেদিনের পর থেকে ওর বাবার সাথে কথা বলাই অনেকটা বন্ধ করে দিয়েছে । নাইরা যখন আমার সাথে মেশা শুরু করলো তখন কেউ কেউ ব্যাপারটা লক্ষ্য করা শুরু করে । একদিন ঠিক ঠিক পত্রিকায় খবর বের হয়ে যায় । যদিও আমি কে সেটা সাংবাদিকেরা বের করতে সক্ষম হয় নি তবুও অনেকটাই বাজে ভাবে সংবাদ ছেপেছে । সেটা দেখেই নাইরার বাবার মাথা খারাপ । ওনার খুব বেশি সময় লাগলো না আমার পরিচয় বের করতে । আমার বাসায় এসে হাজির । আমাকে বলা চলে এলেবারে ধমকা ধমকি শুরু করে দিল । এমন ভাবে কথা বলতে শুরু করে দিল যেন আমি স্কুলে পড়ি ওনার মেয়েও স্কুলে পড়ে ।
আরও ধমকাতে চেয়েছিল কিন্তু নাইরা চলে আসাতে একটু থামলো । ওর বাবার দিকে কঠিন চোখে তাকিয়ে বলল
-তুমি ওকে বকছো কেন জানতে পারি ?
কথার স্বরে এমন কিছু ছিল যে নাইরার বাবা নিজে চমকে গেলেন । আমিও খানিকটা চমকে গেলাম । কারন এমন স্বরে ও কোন দিন আমার সাথেও কথা বলে নি কিংবা আমিও শুনি নি ।
নাইরা বলল
-শুনো বাবা সারা জীবন তোমার কথা মত সব কাজ করেছি অন্তত একটা কাজ আমার ইচ্ছে মত করতে দাও ।তোমার পছন্দ ছেলেকেও দেখলাম কত সৎ আর চরিত্রবান ছেলে তুমি আমার জন্য খুজে নিয়ে এসেছিলে সেটা কেবল আমি কেন পুরো দেশ দেখেছে । এখন এই বিষয়টা আমার ছেড়ে দাও ।
-তার মানে তুই এই ছেলেকেই বিয়ে করবি ?
-তোমার মনে কোন সন্দেহ আছে এটা নিয়ে ?
-এতো বড় বেয়াদব তুই কিভাবে হলি ? ভুলে যাস না যে আমি তোর বাবা !
-দরকার হলে সেটাও ভুলে যাবো ....
আমি অবাক হয়ে নাইরার দিকে তাকিয়ে আছি তার থেকে বেশি অবাক চোখে নাইরার বাবা নাইরার দিকে তাকিয়ে আছে । ওনার মেয়ে যে ওনার হাত থেকে ছুটে গেছে এটা হজম করতে ওনার একটু সময় লাগলো । তারপর আমার বাসা থেকে চোলে গেল । আমি নাইরার দিকে তাকিয়ে অবাক কন্ঠে বলল
-এটা কি ছিল ?
-কিছু না !
-এভাবে কেউ কথা বলে বাবার সাথে !
নাইরা সেদিন আর কিছু বলেনি । আমাকে কেবল জড়িয়ে ধরে ছিল । ওদিন আরও পরিস্কার ভাবেই বুঝতে পেরেছিলাম যে এই মেয়ে কোন ভাবেই আমাকে ছাড়া আর কিছু বুঝবে না । তারপর থেকে ওর বাবার সাথে যোগাযোগ কমে গেল । আমার সাথে সময় কাটানো আরও বেড়ে গেল বহু গুনে ।
রাতে খাওয়ার শেষ করে নাইরার আরেক আবদার এসে হাজির । আজকে সে টিভির ঘরে শোবে । বললাম যে আমরা টিভি দেখি তারপর পরে না হয় যাওয়া যাবে ঘুমাতে । না, সে শুনবে না । শেষে একটা তোষাক নিয়ে টিভির ঘরে পাততে হল ।
নাইরার সেই আগের অভ্যাস । বালিশে মাথা না রেখে আমার বুকের উপরে মাথা রেখে শুয়ে রইলো । তারপর গুটুর গুটুর করে আরও কত কথা । একটা সময়ে দেখি ওর কথা জড়িয়ে যাচ্ছে ঘুমে । আমি বললাম
-আর কথা বলতে হবে না । এখন ঘুমাও ।
-উহু । বলবো । বলতে বলতে তারপর ঘুমাবো ।
-আচ্ছা টিভি বন্ধ করে দেব ।
-না । ওটা চলুক । তোমাকে একটা কথা বলবো
-বল
-না বলবো না । আজকে না । আমি একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি ।
-কি সিদ্ধান্ত ...?
তাকিয়ে দেখি নাইরা ততক্ষনে ঘুমিয়ে গেছে ।
পরের দিন আসলেই আমার জন্য একটা চমক ছিল । অফিসে কাজ করছিলাম । এমন সময় কেমন একটা হইচইয়ের মত আওয়াজ পেলাম । খুব একটা আমলে নিলাম না । মাঝে মাঝে ক্লাইন্টদের ভীড় লেগেই যায় । কিন্তু এক কলিগ এসে আমার দিকে অদ্ভুদ চোখে তাকিয়ে রইলো । তারপর বলল
-আপনি নাইরা চৌধুরীকে চেনেন ?
তখনই খানিকটা সন্দেহ হল । বলল
-কেন ?
-ঐ মেয়ে একটু আগে অফিসে এসেছে । আপনাকে চাইছে ।
খাইছে আমারে । এই মেয়ে এখানে কেন ?
আমি জানতে চাইলাম কোথাও ?
-বসের রুমে । আপনি জানেন না বস নাইরা চৌধুরী কে কি রকম পছন্দ করেন । উনি ঠিক বিশ্বাসই করছে পারছেন নাইরা চৌধুরী তার অফিসে এসেছে এবং সেটা তার জন্য নয় তার কোন এপ্লোয়ীর জন্য !
আমি আর কোন কথা বলে বসের রুমের দিকে দৌড় দিলাম । এই মেয়ের মাথায় হঠাৎ কি চাপলো কে জানে ! গিয়ে দেখি সত্যি সত্যিই বসের রুমে বসে গল্প করছে । আমাকে ঢুকতে দেখে বস চিৎকার করে বলে উঠলো
-অপু সাহেব আপনার নামে তো লক্ষ টাকা জরিমানা হয়ে গেছে । আপনি নাইরা চৌধুরীর বয়ফ্রেন্ড এটা আমাদের কাছে লুকিয়েছেন কেন ?
ESTÁS LEYENDO
ভালবাসার অনু-গল্প সমগ্র
Romanceআমি সব সময় ভালবাসার গল্প লিখতেই পছন্দ করি । ছোট ছোট এক দুই দৃশ্যের গল্প গুলো পড়তে এবং লিখতে খুবই ভাল লাগে । এইখানে তেমন গল্প গুলোই পোস্ট হবে । প্রত্যেক পর্বে আসবে নতুন নতুন গল্প । ছোট ছোট ভালবাসার গল্প । যখনই লিখবো তখনই পোস্ট করা হবে ! ছোট ছোট গল্প...