#নীরবতা #৫

475 22 1
                                    

সকালের খাবারের পাঠ চুকেছে বেশ খানিকক্ষণ। তবে এবাড়ির সকল সদস্যর সাথে একসাথে খেতে বসে সংকোচে কাজ করছিল উল্লাসীর। যার ফলে ইচ্ছে থাকা সত্বেও তেমন কিছু পেটে পুড়তে পারেনি সে। এখন হালকা ক্ষুধাভাব পেলেও কাউকে কিছু বলা ঠিক হবে কিনা তা নিয়ে একরকম দ্বিধাদ্বন্দে ভুগছে। এমতবস্থায় শাড়ির আঁচলে টান অনুভব করতেই পিছন ফিরলো উল্লাসী। ছোট্ট বছর চারেকের মত এক বাচ্চা ঠোঁট ভর্তি হাসি নিয়ে তার আঁচল ধরে দাঁড়িয়ে রয়েছে। এখানে আসার আগে অবশ্য ছোটমা এবাড়ির আদ্যোপান্ত জানিয়েছে তাকে। ছোট থেকে শুরু করে এবাড়ির প্রতিটি সদস্য সম্পর্কে দিয়েছে নানান তথ্য। যা ভুল না হলে এমেয়ের নাম মৌমি। জন্মের পর মা ছেড়ে চলে গেলে বাবার ছায়ায় যে বেড়ে উঠছে ধীরেধীরে। আশ্চর্যজনক হলেও তার নিয়তির সঙ্গে মেয়েটির নিয়তি অনেকটাই মিলে যায়। তবে অমিল শুধু রয়ে যায় একটি জায়গায়। মেয়েটির বাবা মায়ের ছায়া না খুঁজে নিজেই তার মা হয়ে উঠেছে। যা আজকালকার দিনে দূর্লভ এক ব্যাপার। দীর্ঘশ্বাস ফেলে চারিপাশে চোখ বুলিয়ে মৌমিকে কোলে উঠালো উল্লাসী। তারপর ধীরপায়ে এগুলো বিছানার দিকে।
-"তুমিই কী আমার আম্মু?"
মৌমির ছোঁড়া প্রশ্নে একদন্ড ভেবে উল্লাসী জবাব দিল,
-"উহু.."
-"বাবা যে বললো তুমিই আমার আম্মু!"
-"বাবা যেহেতু বলেছে তাহলে হয়তো আমিই তোমার আম্মু।"
-"তাহলে প্রথমে কেনো উহু বললে?"
এপ্রশ্নের ঠিক কি জবাব দেবে তা ভেবে পেল না উল্লাসী! মৌমির চুলে হাত বুলিয়ে বললো,
-"জানো? তোমার মত আমার ছোট্ট একটি বোন আছে?"
-"কী নাম ওর? আর কোথায় ও?"
-"আমাদের বাড়িতে।"
-"অহ বুঝেছি! তাহলে তুমি ওর জন্যই এতদিন আমার কাছে আসোনি.. না?"
বিবর্ণ ঠোঁটে হাসি ফুটলো উল্লাসীর। মৌমির কপালে চুমু দিয়ে বললো,
-"জানি না। তবে তোমার বাবা বললে ঠিকাছে।"
-"কেনো? বাবা বললে ঠিক থাকবে কেনো?"
-"কারণ, বড়রা কখনোই মিথ্যে বলেনা। তাছাড়া ছোটমাও বলে দিয়েছে এবাড়ির সকলের কথা মেনে চলতে।"
-"ছোটমা কে?"
ঠিক সেই মুহূর্তে ঘরে প্রবেশ করলো মেসবাহ। তার উপস্থিতিতে চুপসে গেল উল্লাসী। শান্ত বেশে মৌমির হাত চেপে চুপচাপ বসে রইলো সে।
-"মেজ বাবা? ও মেজ বাবা..."
হাতের ঘড়ি খুলে ড্রেসিং টেবিলের উপর রেখে মৌমির দিকে এগিয়ে এল মেসবাহ। একটি চেয়ার টেনে বসে আদুরে গলায় বললো,
-"কী লাগবে আমার আম্মার?"
-"কিচ্ছুটিই না। জানো? আম্মু এতদিন আম্মুর বোনের জন্য আমার কাছে আসেনি? আমার তো ওর জন্য রাগ হচ্ছে। মনে হচ্ছে ওকে একটি মেরে দাঁত ফেলে দেই।"
মৌমির কথা বোধগম্য হলো না মেসবাহর। কপাল কুঁচকে সে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে উল্লাসীর দিকে তাকাতেই বুকের ভেতর উথালপাতাল শুরু হয়ে গেল উল্লাসীর। মৌমি তাকে আম্মু বলায় কী রাগ করেছেন উনি? কিন্তু সে নিজে তো কিছু বলেনি। মৌমির বাবাই তো ওকে শিখিয়ে দিয়েছেন!
-"ও বাবা! শিশি পেয়েছে।"
মৌমির কথায় তাড়াহুড়ো করে মেসবাহ চেয়ার ছেড়ে উঠে তার দিকে হাত বাড়াতেই পিছিয়ে গেল মৌমি। আহ্লাদী গলায় বললো,
-"আম্মুর কাছে শিশি করবো।"
একপলক মেসবাহর দিকে তাকিয়েই মৌমিকে কোলে চাপিয়ে দ্রুতপায়ে ওয়াশরুমের দিকে এগুলো উল্লাসী। উনি ক্ষেপেছেন। প্রচুর ক্ষেপেছেন। হয়তো সকালের মতো খানিকক্ষণ বকাবকিও করবেন! উল্লাসী সচকিত মনে মৌমিকে নিয়ে ঘরে ফিরে আসতেই তার কোল ছেড়ে নেমে একদৌড়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল মৌমি। তার যাত্রাপথের দিকে খানিকক্ষণ স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো মেসবাহ। এরপর গম্ভীর গলায় বললো,
-"আম্মু তোমায় ডাকছে মৌমি?"
ঢোক চেপে হালকা মাথা নেড়ে উল্লাসী সম্মতি জানাতেই মেসবাহ আবারও বললো,
-"কে শিখিয়েছে?"
-"ওর বাবা..."
ভাইয়ের কথা আসতেই খানিকটা নরম হয়ে এল মেসবাহ। দু'কদম এগিয়ে বিছানায় শরীর মেলে দিয়ে চোখজোড়া বুজে কিছুক্ষণ কাটানোর পর ধীর গলায় সে বললো,
-"শাড়ি এখনো বদলাওনি কেনো? যা তুমি ঠিকঠাক রাখতে পারবে না সেগুলো পড়বেও না। যে কাজে নিজে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করবে সেগুলোই করার চেষ্টা করবে।"
-"জ্বি আচ্ছা।"
-"যাও.. শাড়ি বদলে অন্যকিছু পড়ে নাও।"
-"কিন্তু শাড়ি ছাড়া তো অন্য কিছু নেই আমার।"
চোখ মেলে উল্লাসীর দিকে তাকিয়ে ভ্রু কুঁচকে মেসবাহ বললো,
-"তোমার বাড়িতে কী পড়েছো তুমি?"
-"সালোয়ার কামিজ।"
-"তাহলে ওগুলোই পড়ো।"
-"কিন্তু ছোটমা তো বলেছে মেয়েদের বিয়ের পর শাড়ি ছাড়া অন্য কিছু পড়তে হয় না।"
বিরক্ত হলো মেসবাহ। আবারও চোখ বুজে ছোট্ট কিছু নিঃশ্বাস ফেলে সে বললো,
-"ইললজিক্যাল কথাবার্তা যতসব! চোখে আলো লাগছে। দরজা চাপিয়ে দিয়ে তুমি এখন যাও। আমি ঘুমোবো কিছুক্ষণ।"
মেসবাহর আদেশ পেয়ে দ্রুত ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়লো উল্লাসী। দরজা টেনে লম্বা বারান্দা ধরে সামান্য এগিয়ে একটি চেয়ারে বসে পড়লো সে। ভর দুপুরের চড়া রোদ গায়ে এসে লাগছে তার। তীব্র এই রোদের প্রখরতায় গায়ে জ্বালা ধরলেও নড়লো না উল্লাসী। রাশভারী চোখে তাকিয়ে রইলো উঠানের দিকে। সেখানে ছোট একটি বিড়ালের পেছনে পেছনে দৌড়ে তাকে ধরার চেষ্টা করছে মৌমি। তীব্র রোদে তার পুরো শরীর ঘামে ভিজে উঠলেও চোখেমুখে তার অদ্ভুত এক উজ্জ্বলতা ফুটে উঠেছে।

নীরবতাWo Geschichten leben. Entdecke jetzt