#নীরবতা #৩৪

388 17 3
                                    


নিঝুম রাত। কোলাহলে মুখরিত করে রাখা প্রাণ হারিয়ে পুরো হাজীবাড়ি জুড়ে নেমে এসেছে নীরবতা। আশেপাশে নেই কোনো পাখির কুজন, নেই কোনো মানুষের কোলাহল। শুধুই কানে ভেসে আসছে টিপটিপ করে পড়তে থাকা বৃষ্টির শব্দ। অনাকে মাটি দিয়ে আসার পর থেকেই অঝোর ধারায় বৃষ্টি ঝরছে। মানুষের সঙ্গে কি তাহলে আকাশ-পাতালও কাঁদছে? তারাও কি মেনে নিতে পারছে না তার এই মর্মান্তিক মৃত্যুকে? বুকচিরে একটি দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল উল্লাসীর। আপনজন হারানোর কষ্ট তার অজানা নয়। ছোটকালে মাকে হারানোর পর এই কষ্ট দিনের পর দিন মাসের পর মাস উপলব্ধি করে এসেছে সে। এ কষ্ট যে সকল কষ্টের উর্ধ্বে। দুঃখ ভারাক্রান্ত মনে রান্নাঘর ঢুকলো উল্লাসী। মৃত বাড়ি হওয়ায় আজ তাদের বাড়িতে উনুন ধরানো হয়নি। আশেপাশের দু'এক বাড়ি থেকে ভাত ডাল দিয়ে গেছে। যা যেভাবে রেখে গিয়েছিল সেভাবেই পড়ে রয়েছে। কে খাবে এসব? কারো খাবার মতো পরিস্থিতি রয়েছে? খাবার সব ঢেকেঢুকে রান্নাঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়লো উল্লাসী। লম্বা বারান্দা ধরে খানিকটা সামনে এগিয়ে খুঁটি ধরে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে রইলো বৃষ্টির দরুন আঁধারে চিকচিক করা উঠোনের দেকে। বৃষ্টির তেজ ক্রমেই বাড়ছে। সারারাত এভাবে বৃষ্টি চলতে থাকলে অনার কবরের কোনো ক্ষতি হবে না তো! তার বাবার বাড়ির পাশের বাড়ির রহমত নামের এক চাচার মৃত্যু দিনেও এভাবে মুশলধারে বৃষ্টি হয়েছিল। যার কারণে তার কবর ঢসে পড়েছিলো। অনার ক্ষেত্রেও কি তেমন হবার আশংকা রয়েছে? মনে চলা প্রশ্নগুলোর উত্তর না পেলেও উঠোনে কারো অস্তিত্ব লক্ষ্য করলো উল্লাসী। চোখজোড়া প্রসস্থ করে সেদিকে ভালোভাবে তাকাতেই দেখতে পেল চৈতালিকে। আকাশ-পাতাল ফেটে পড়া বৃষ্টি মাথায় নিয়ে সে এগিয়ে আসছে তারই দিকে।
-"আপনি এখানে? এতরাতে?"
-"আমার একটা উপকার করবে উল্লাসী?"
-"আগে আপনি উপরে উঠে আসুন। পুরো শরীর ভিজে গেছে একদম!"
ভেজা শরীরে জবুথবু হয়ে চৈতালি বারান্দায় উঠতেই তার দিকে এগিয়ে গেল উল্লাসী। অনেক্ক্ষণ যাবৎ বৃষ্টিতে ভেজার ফলে ঠান্ডায় কেঁপে কেঁপে উঠছে তার শরীর। কিন্তু এত রাতে বৃষ্টিতে ভিজে কেনো সে এসেছে এবাড়িতে?
-"মুবিনকে একটু ডেকে দেবে? প্লিজ উল্লাসী। না করোনা! আমি অনেক্ক্ষণ হলো অপেক্ষা করছিলাম।"
-"মুবিন ভাইকে? কিন্তু উনাকে কেনো? কিছু হয়েছে?"
-"না.. তুমি কাওকে কিছু না জানিয়ে প্লিজ ওকে ডেকে দাও। আমি রান্নাঘরের ওই কোণাটায় অপেক্ষা করছি।"
চৈতালির ব্যাকুল স্বর শুনে মায়া হলো উল্লাসীর। পেছন ফিরে দু'কদম এগিয়ে থেমে গেল সে। পাশ ফিরে ক্ষীণ গলায় বললো,
-"আপনি অনা আপাকে পালাতে নিষেধ করেন নি কেনো?"
-"আমি কিছুই জানতাম না উল্লাসী। অনা আমাকে জানায়নি.."
কথা বাড়ালো না উল্লাসী। দোতলায় উঠে মুবিনের খোঁজে তার ঘরে ঢুকলেও তার দেখা না পেয়ে সে এগুলো দক্ষিণের একদম কোণার ঘরটির দিকে। ঘরটি অনার। বড়সড় সেই ঘরের মালিকের স্থান আজ সাড়ে তিন হাত মাটির ঘরে। জগতের কত অদ্ভুত নিয়ম না? দুনিয়ায় জীবনে ঘর যত বড়ই হোক না কেনো কবরের পরিমাপ নির্দিষ্ট..

নীরবতাWhere stories live. Discover now