আলাউদ্দিন শেখের পায়ে পানি ধরেছে। পা ফুলে টসটসে হয়ে রয়েছে দু'দিন যাবৎ। ঘটনা মেসবাহকে ফোনে জানানোর পর ঔষধের নাম বলে দিলে তা খেয়ে সামান্য কমলেও আজ সকালে আবারও বেড়েছে। তাই শেষমেশ আজ মুবিন আসার পর তাকে নিয়ে হাসপাতালে গিয়েছিল সে। ডাক্তার দেখিয়ে ঔষধপত্র নিয়ে এসেছে। দুনিয়ায় এই জীবনে মনে হচ্ছে হায়াৎ দিনেদিনে কমে আসছে তার। দ্রুত মৃত্যু ঘনিয়ে আসছে। তবে অনেক কাজই যে এখনো অসম্পূর্ণ রয়েছে! ছোট মেয়ের হত্যাকারীর শাস্তির খবর না শুনে মরে গেলেও শান্তি পাবে না সে। বড় মেয়েকে বিয়ে দিয়ে ঝামেলা চুকিয়ে ফেললেও বড় ছেলেটা নিঃসঙ্গ জীবন যাপন করছে। তারও একটি গতি করে দিতে হবে। ওদিকে মেজোটা মোটামুটি থাকলেও ছোট ছেলেটার পড়াশোনাও এখনো শেষ হয়নি। তার একমাত্র নাতিন, যার দুনিয়ায় মা থেকেও নেই। এসব রেখে দুনিয়া থেকে বিদায় নিলে সব এলোমেলো হয়ে যাবে। জীবনে ছেলেমেয়েদের উপর কম অধিপত্য খাটায়নি সে। মেয়েকে তো তার এই অধিপত্যের জোরেই জীবন দিতে হলো। আজও তার চিঠি লুকিয়ে লুকিয়ে পড়ে নীরবে চোখের জল ফেলে সে। বুকের ভেতরটা ব্যথা করে। খুব কষ্ট হয়। বারবার তার ভেতরের দাম্ভিকতা ভেঙে চুরমার হয়ে যায়। সে খারাপ মানুষ। তার উদ্দেশ্য খারাপ। আল্লাহর ঘরে গিয়ে হজ্ব পর্যন্ত করে এসেছে সে গ্রামে নিজের নাম ও প্রতিপত্তি পাবার উদ্দেশ্যে। তার মতো নিকৃষ্ট মানুষ এদুনিয়ায় থাকা মানায়ও না! আজ তার ছেলেমেয়েরা ভদ্র সভ্য বলে নীরব থেকেও তার আদেশ মাথা পেতে মেনে নেয়। নয়তো তারা একেকজন যে অবস্থায় অবস্থান করছে তাতে এই বুড়ো বাপের আদেশ পরোয়া কেনো করবে? তবে তারা এই বুড়োর কথা পরোয়া করে। বড় ছেলের বউ মনমতো না হওয়ায় যখন বুদ্ধি করে মিথ্যা অপবাদ দিয়ে তাকে বাড়ি থেকে বিতাড়িত করলো তখন মুখ বুজে নীরবে তার আদেশ মেনে নিয়েছিল মাজহারুল। মেজো ছেলে মেসবাহ দেশের বাইরে থেকে ড্রিগ্রী নিয়ে আসা ডাক্তার হওয়া সত্ত্বেও তার কথায় গরীব ঘরের বাচ্চা এক মেয়েকে বিয়ে করলো! অনা তো ভুল কিছু বলেনি। সে লোকের কথায় বিচলিত হয়েই তার দুই ছেলের উপর নিজের সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিয়ে তাদের জীবনটা নষ্ট করে দিয়েছে। বুকচিরে একটি দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল আলাউদ্দিন শেখের। বালিশে হেলান দিয়ে চোখজোড়া বুজলো সে। নিজেকে সে সর্বজ্ঞানী সবজান্তা ভাবে। ভাবে তার সিন্ধান্তই এই পৃথিবীর সবচেয়ে উত্তম সিদ্ধান্ত। তার চিন্তাধারাই সঠিক চিন্তাধারা। তবে অনার মৃত্যুর পর পদে পদে বুঝেছে সে। প্রতিটি ক্ষণে ক্ষণে জীবন তাকে দু'চোখে হাত দিয়ে স্পষ্ট দেখিয়ে দিয়েছে নিজেকে নিয়ে তার ধারণা গুলো ভুল। এই যেমন অনার বান্ধবী চৈতালিকে খুনি বলে তাকে যাচ্ছেতাই ভাষায় গালিগালাজ করেছিল সে। পুরো গ্রামবাসীর সামনে তাকে হেয় করেছিল। অথচ কিছুদিন পর যখন অনার হত্যাকারীকে রিমান্ডে নেবার পর পুরো ঘটনা আদ্যোপান্ত খুলে বলেছিল সে তখন তার ধারণা কতটা ভুল তা প্রমাণিত হয়েছিল। সেদিন নিজেকে খুব ছোট মনে হচ্ছিলো। ইচ্ছে হচ্ছিলো চৈতালির পায়ে ধরে ক্ষমা চাইতে। এই তিনটি মাসে জীবন তাকে বারবার দেখিয়ে দিয়েছে তার অবস্থান। সে যে মানুষের মতো দেখতেই জঘন্য এক কীট তা জানতে আর বাকি নেই। তবে সবকিছুর পরে সে অনুতপ্ত। তার ভেতরের সত্তা আজ উপলব্ধি করতে পারে তার ভুলগুলো, তার করা অন্যায় গুলো। বাঁচতে হবে তাকে.. দীর্ঘদিন বাঁচতে হবে। নয়তো তার করা অন্যায়গুলো কী করে শোধরাবে সে?
-"দাদু? এই যে তোমার মলম। বাবা নিয়ে এসেছে।"
মৌমির গলার স্বর কানে আসতেই চোখ মেললেন আলাউদ্দিন শেখ। মেয়েটি এই তিনমাসে বড্ড রোগা হয়ে গেছে। ঠিকমতো খাওয়াদাওয়া নেই, যত্ন নেই। একা আর কতদিক সামলাবে মোরশেদা? তাছাড়া বিচ্ছু এই মেয়ে তার কথা আমলেও নেয়না। অনা থাকতে মৌমির খাবার গোসল সবদিকই সে সামলিয়েছে। আজ যখন অনাই নেই তখন তার অভাব আর পূরণ করবেই বা কে! ছোট্ট একটি নিঃশ্বাস ফেলে আলাউদ্দিন শেখ বললেন,
-"তোর আব্বা আইছে?"
-"হ্যাঁ তো।"
-"তুই এতক্ষণ কোনহানে ছিলি?"
-"দাদীর সাথে। দাদীর ঘরে।"
-"খাইছিস?"
-"না।"
ইশারায় মৌমিকে কাছে ডেকে তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন আলাউদ্দিন শেখ। নীচু গলায় বললেন,
-"তোর কি তোর আম্মাকে খুব দেখতে ইচ্ছে করে?"
-"করে তো।"
-"থাকতে ইচ্ছে করে আম্মার কাছে?"
-"করেই তো।"
-"অহ.. যা তোর আব্বাকে ডাইকা আন।"
-"কেন?"
-"তোর আম্মার ব্যবস্থা করমু। যা.."
মৌমির একদৌড়ে ঘর থেকে বেড়িয়ে যাবার দু'দন্ড যেতে না যেতেই হালকা কেশে দরজায় টোকা দিল মাজহারুল। ক্ষীণ স্বরে বললো,
-"আব্বা ডাকছিলেন?"
-"হ্যাঁ.. আয়।"
কয়েক কদম এগিয়ে আলাউদ্দিন শেখের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে মেঝের দিকে তাকিয়ে মাজহারুল বললো,
-"জ্বি, বলেন.."
-"তোর কাছে বড় বৌমার নাম্বার আছে?"
ঘাবড়ে গেল মাজহারুল। ঢাকায় গিয়ে জ্যোতির সাথে তার দেখা করার খবর কী কোনোভাবে জেনে গেছেন আব্বা? ঢোক গিলে একরাশ আতংক নিয়ে মাজহারুল জবাব দিল,
-"না..."
-"মিথ্যা কইস না। তোর ফোনে বড় বৌমার নাম্বার আছে। ক.. আছে না?"
-"আছে।"
-"দেখি ফোন লাগাইয়া আমার কাছে দে।"
বুকের ভেতরে উথালপাতাল শুরু হতেই আমতাআমতা করতে লাগলো মাজহারুল। অস্থিরতায় সত্যিটা বলে দিলেও ভয় হচ্ছে তার।
-"কী দরকার আব্বা?"
-"তুই কল লাগাইয়া দে।"
-"কিন্তু আব্বা হঠাৎ? যে গেছে যাক না! তাছাড়া..."
মাজহারুলকে মাঝপথে থামিয়ে দিলেন আলাউদ্দিন শেখ। থমথমে গলায় তিনি বললেন,
-"তোর কাছে মিথ্যা বলছিলাম আমরা। বৌমা কোনো ছেলের হাত ধইরাই পালায় নাই। আমরাই তাকে এই বাড়ি ছাড়তে বাধ্য করছিলাম!"
