#নীরবতা #২৭

425 20 2
                                    


বেলা বাজে দশটা। ভোরের পাখিদের কোলাহল বন্ধ হলেও থেমে নেই জনমানুষের কোলাহল। নতুন একটি দিন সূচনার সাথেসাথে কর্মব্যস্ত মানুষেরা লেগে পড়েছে তাদের নিত্যকার কাজে। আশেপাশের সৃষ্ট এই কোলাহল সবসময় স্বাভাবিক লাগলেও আজ কদিন যাবৎ তা কাঁটার মত বিঁধছে মেসবাহর কানে। সেদিনের ঘটনার পর থেকে আজ দু'দিন হলো তার সঙ্গে কথোপকথন বন্ধ রেখেছে উল্লাসী। কিছু জিজ্ঞেস করলেও এড়িয়ে চলছে। কাছে ঘেষছে না, এমনকি রাতেও একা ঘরে ঘুমোচ্ছে। ভয়ংকর সেই রাত্রী যাপনের পর বেশ মিইয়ে পড়েছে মেয়েটি। কেনো শুধুশুধু অসহায় বাচ্চা একটি মেয়েকে নিজের জীবনের সঙ্গে জড়ালো সে? বাবার অন্যায় মেনে কেনো মুখ বুজে রইলো? নয়তো আর দশটি স্বাভাবিক মেয়ের মতোই বেড়ে উঠতো উল্লাসী। আজ মেয়েটির সঙ্গে যে অন্যায় করেছে তাতে নিজেকে ধর্ষক ছাড়া দ্বিতীয় কিছু ভাবতে পারছে না সে। আসলেই কি সে ধর্ষক? এতে কি সায় ছিল না উল্লাসীর? বুঝে হোক বা অবুঝে সায় তো ছিল তার। তাহলে কেনো আজ তাকে এতটা অনুতপ্ততায় পোড়াচ্ছে উল্লাসী? সে কী বুঝছে না তার এধরণের আচরণে ঠিক কতটুকু কষ্ট পাচ্ছে সে? চুপচাপ খানিকক্ষণ থম ধরে বসে থাকার পর চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো মেসবাহ। উদ্বিগ্ন মনে পায়চারী শুরু করলো পুরো চেম্বার জুড়ে। এই হলো অপ্রাপ্ত বয়স্ক মেয়েকে বিয়ে করার ফল। আজ উল্লাসীর জায়গায় কোনো প্রাপ্ত বয়স্ক বুঝদার মেয়ে হলে কখনোই এধরণের পরিস্থিতিতে পড়তে হতো না তাকে। বিয়ের পর থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত এই বিয়ে নিয়ে কম মিথ্যার মুখোমুখি হতে হয়নি তাকে। তবুও সে সবটা মেনে বুঝেশুঝে সামনে অগ্রসর হয়েছে এবং উল্লাসীকে নিয়ে তার মনে অনুভূতি সৃষ্টি হয়েছিল বলেই সে এতটা পথ মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে এগুতে সক্ষম হয়েছে। নয়তো কী দরকার ছিল উল্লাসীকে স্ত্রীর মর্যাদা দেবার? দায়িত্ব হিসেবে গ্রাম থেকে নিয়ে এসেছিল তাকে।পাড়াতো বোন হিসেবে তা না হয় শুধু দায়িত্ব পর্যন্তই সীমাবদ্ধ থাকতো! তবে সে পারেনি.. নিজের স্ত্রীকে অন্যের সঙ্গে জড়ানো তো দূরের কথা তার পাশে নামটি পর্যন্ত শুনতে পারেনি। আজ সেই স্ত্রী.. তার পথ চলার সঙ্গীই যদি তাকে না বোঝে, এর চেয়ে কষ্টকর দ্বিতীয় আর কী থাকতে পারে পৃথিবীতে? সে ঘোরের বশে অন্যায় করে ফেলেছে, তবে সহজ ভাষায় বললে প্ররোচনায় পড়ে অন্যায়টি করেছে। এবং তা সে অগ্রাহ্যও করছে না। বরং তা মেনে নিয়েই পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে চাইছে। সেখানে উল্লাসী কেনো সবটা মেনে সুস্থ স্বাভাবিক একটি জীবনে ফিরে আসতে চাইছে না!
-"কিরে? তুই আমার ফোন পিক করছিস না কেনো?"
ইভানার গলার স্বরে চিন্তার জগৎ ছেড়ে বেরিয়ে এল মেসবাহ। দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজের চেয়ারে ফিরে এসে বসে বললো,
-"ফোন সাইলেন্ট ছিল.. "
-"ফোন না হয় আজ সাইলেন্ট ছিল.. কাল কেনো পিক করিসনি? রাতে লিমনকে নিয়ে ল্যাবএইডেও গিয়েছিলাম। তবে গিয়েই শুনলাম তুই নাকি কিছুক্ষণ হলোই বেরিয়েছিস!"
-"অহ.. তা বাসায় আসলেই পারতি!"
মেসবাহর মুখোমুখি চেয়ারে বসে ইভানা বললো,
-"লিমনও বলছিল তোর বাসায় যেতে। তবে পরে উল্লাসীর কথা ভেবেই আর যাওয়া হয়ে উঠেনি। মেয়েটি ছোট.. কী ভাববে না ভাববে!"
চোয়াল শক্ত হয়ে এল মেসবাহর। গম্ভীরমুখে সে বললো,
-"তোদের ইচ্ছে হলে তোরা যাবি। এখানে উল্লাসী কে তোদের নিয়ে ভাবতে হবে না।"
-"কী হয়েছে বল তো! তোকে এমন অদ্ভুত কেনো লাগছে?"
-"কিছু না.. আমি ঠিক আছি।"
-"নো.. আই থিং সামথিং ইজ ফিসি!"
ঘাড় নেড়ে চেয়ারে মাথা এলিয়ে দিল মেসবাহ। ছোট্ট একটি নিঃশ্বাস ফেলে চোখজোড়া বুজে ক্ষীণ স্বরে বললো,
-"তুই বেশি ভাবছিস।"
-"আই ডন্ট থিং সো। ইউ কল্ড মি লাস্ট নাইট... অলদো দ্যাট ইজ ইউর পারসোনাল ম্যাটার বাট আই ওয়ান্ট টু নো।"
-"তেমন কিছু না। বাদ দে।"
কপাল কুঁচকে ফেললো ইভানা। সন্দেহ হচ্ছিল তার। তবে মেসবাহর ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে তার কথা বলা ঠিক হবে কিনা তা নিয়ে একরকম দ্বিধায় ভুগছিলো। তবে আজ মনে হচ্ছে বেশ দেরি করে ফেলেছে সে। তার উচিৎ ছিল সেদিন রাতেই পুরো ব্যাপার সম্পর্কে জানতে চাওয়া.. মেসবাহর দু'হাতে নিজের হাতের মাঝে বন্দী করলো ইভানা। তাকে আশ্বস্ত করে বললো,
-"প্লিজ.. তুই আমাকে বলতে পারিস।"
ভরসার সন্ধান পেয়ে চোখজোড়া মেললো মেসবাহ। অজস্র অস্থিরতা গলায় চাপিয়ে পুরো ঘটনা খুলে বলতে শুরু করলো ইভানাকে। উল্লাসীর আচরণ দ্বারা মানসিক ভাবে আজ এতটাই ভেঙে পড়েছে যে সারাক্ষণ এক হিংস্র পাখি ঠুকড়ে ঠুকড়ে খেয়ে যায় তার বুকের ভেতরটা।
-"আর ইউ সিরিয়াস? আই মিন সিরিয়াসলি উল্লাসী তোকে এভাবে ট্রিট করছে?"
ইভানার প্রশ্নে ব্যাথাতুর গলায় মেসবাহ বললো,
-"আমি কী করবো বল! আমি জাস্ট বুঝতে পারছি না। আমি ওকে যথেষ্ট বুঝিয়েছি.. কিন্তু ও কোনোভাবেই মানতে রাজী নয়। হ্যাঁ.. আমি মানছি ও প্রচুর ভয় পেয়েছে। তবে সেই ভয় ভাঙ্গানোর একটি সুযোগ তো ও আমায় দেবে!"
-"আমি কি একবার উল্লাসীর সাথে কথা বলে দেখবো?"
-"না.. দরকার নেই। তাতে হীতে আরও বিপরীত হবে।"
উদ্বেগপূর্ণ গলায় ইভানা বললো,
-"তাহলে?"
-"জানি না। আই অ্যাম টোটালি ফেডঅাপ!"
-"শোন.. আমার মনে হচ্ছে উল্লাসীকে তোর কিছুদিন সময় দেয়া উচিৎ। ও যেহেতু ছোট। এসব ব্যাপারে অজ্ঞ.. তাতে শি নিড সাম টাইম।"
-"আমি কী ওকে সময় দিচ্ছি না? আমি ভুল করেছি। এন্ড আই এক্সেপ্ট ইট। তারপরও ও কেনো বুঝছে না!"
-"ও ছোট মেসবাহ।"
-"হ্যাঁ.. ছোট! এই ছোট মেয়েকে বিয়ে করেই আমার জীবনটা আমি ধ্বংস করলাম। না সেদিন মুখ বুজে আব্বার কথা শুনতাম আর না এমন পরিস্থিতিতে পড়তাম! আজ ওর জায়গায় কোনো এডাল্ট ম্যাচুয়ার মেয়ে ধর তুই থাকলে কি এমন পরিস্থিতিতে পড়তে হতো আমায়?"
মেসবাহর প্রশ্নের উত্তরে কোনো জবাব দিল না ইভানা। মেসবাহ ঠিক কী বুঝাতে চাইলো একথা দ্বারা? তাহলে কী মেসবাহর মনেও তাকে নিয়ে কিছু রয়েছে? বদমেজাজী বাবার ভয়ে কী তা প্রকাশ করতে পারেনি? আর কিছু ভাবতে পারলো না ইভানা। মেসবাহর দু'হাত জোরে চেপে ধরে মনে মনে আওড়ালো, আমি তোকে ভালোবাসি। তবে তুই একটি বন্ধনে জড়িয়ে পড়ার পর আমি নিজেকে সামলে নিয়েছিলাম। কিন্তু এখন যখন উল্লাসী তোকে নিয়ে এতটা আনসিউর, তখন ইউ ডিজার্ভ বেটার মেসবাহ।

নীরবতাМесто, где живут истории. Откройте их для себя