রাত গভীর হচ্ছে। ধীরেধীরে নিস্তব্ধ হচ্ছে চারিপাশ। বড়সড় একটি ঘরে একা বসে মাজহারুলের অস্থির মন পায়চারী করছে অতীত জুড়ে। যে দিন চলে যায় সেদিন আর ফিরে আসে না জেনেও মনের গহীনে অজস্র আশা জমিয়ে রাখার নামই কী নির্বুদ্ধিতা? যা হারিয়েই গেছে তার জীবন ছেড়ে তা কী হবে মনে করে? তবে বেকুব মন তাকেই খোঁজে বারেবারে। একবারও বুঝতে চেষ্টা করে না সে তার কখনো ছিলই না! দীর্ঘশ্বাস ফেলে বিছানায় শরীর মেলে দিল মাজহারুল। রাত দু'টোর উপরে বাজে। অথচ এখনো ঘুমের দেখা নেই তার চোখে। পাশের রুমেই মৌমির সঙ্গে রয়েছে জ্যোতি। এতক্ষণে হয়তো মা মেয়ে দুজনে একে অপরকে আঁকড়ে ধরে ঘুমিয়েও পড়েছে। মেয়েকে ছাড়া এই প্রথম রাত কাটাতে প্রচুর কষ্ট হচ্ছে। সেইসাথে বেদনাদায়ক অতীতের স্মৃতি গুলো যেনো কামড়ে কামড়ে খাচ্ছে তার বুকের ভেতরটা। উচিৎ হয়নি তার মৌমিকে নিয়ে ঢাকায় আসা। সে মরে গেলে মরে যেত! তবুও তো এই যন্ত্রণাদায়ক অতীত ছেড়ে রক্ষা পেত! চিন্তাজগতে বিচরণ করতে করতে চোখজোড়া লেগে এসেছিল মাজহারুলের। হঠাৎ আসা ফোন কলের রিংটোনে ধড়মড়িয়ে উঠে বসলো সে। চারিপাশে চোখ বুলিয়ে পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টায় সফল হয়ে লম্বা একটি নিঃশ্বাস ফেলে ফোন রিসিভ করলো। ক্ষীণ স্বরে বললো,
-"হুম.. বলো।"
-"একবার আসবে এই রুমে?"
-"কেনো? মৌমি উঠেছে নাকি?"
-"না, তুমি এসো। আমি অপেক্ষা করছি।"
ওপাশ থেকে জ্যোতি কল কাটতেই চোখমুখ কুঁচকে ফেললো মাজহারুল। এত রাতে জ্যোতির ঘরে যাওয়াটা ঠিক হবে কিনা তা নিয়ে একরকম দ্বিধাদ্বন্দে ভুগছে। বিবেক নানান বুঝ দিয়ে নিষেধ করলেও বেহায়া মনের সাথে না পেরে বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো সে। ধীর পায়ে এগুলো পাশের ঘরের দিকে।দরজা খোলা থাকায় কোনোরকমের বাঁধা না পেয়ে ঘরে প্রবেশ করলো মাজহারুল। বুকের ভেতরটায় তার টিপটিপ করছে। আর একটি দিনও থাকবে না সে ঢাকায়। কাল সকাল সকাল এখান থেকে বেরিয়েই মেসবাহর বাসা থেকে অনাকে নিয়ে রওনা হবে গ্রামের উদ্দেশ্যে। এভাবে আরও একটি দিন জ্যোতির ছায়ায় কাটালে পাগল হয়ে যাবে সে...
ঘরের কোথাও জ্যোতির দেখা না পেয়ে হালকা কেশে উঠলো মাজহারুল। প্রায় সাথেসাথেই ওয়াশরুম থেকে আওয়াজ এল জ্যোতির। ভেতর থেকে সে উঁচু গলায় বললো,
-"বসো.. আমি আসছি।"
কথা না বাড়িয়ে ঘুমন্ত মৌমির দিকে এগিয়ে গেল মাজহারুল। কপালে ভালোবাসার একটি পরশ ছুঁয়ে দিয়ে ফিসফিসিয়ে বললো,
-"মায়ের সাথে ঘুমিয়ে কেমন লাগছে রে আম্মা? খুব মজা.. না?"
বিপরীতে মেয়ের সাড়া না পেয়ে মৃদু হেসে সোফায় এসে বসলো মাজহারুল। জ্যোতি কেনো ডেকেছে তাকে তা জানতে মনের ভেতরটা ছটফট করছে।
-"তুমি আসবে ভাবিনি.."
টাউয়েল দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে মাজহারুলের পাশে এসে বসলো জ্যোতি। ডান হাত মাজহারুলের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললো,
-"এখনো হাত কাটার দাগ যায়নি.. দেখেছো?"
-"দেখলাম..."
-"কেনো কেটেছিলাম... মনে পড়ে?"
-"পড়ে.."
-"কেনো.. বলো তো?"
নড়েচড়ে বসলো মাজহারুল। গম্ভীরমুখে বললো,
-"তুমি কী এসব বলতেই আমাকে ডেকেছো?"
-"না.. ঘুম পাচ্ছিলো না। ভাবলাম তোমার সাথে খানিকক্ষণ গল্প করি।"
-"অহ..."
-"একটা কথা বলি?"
-"বলো.."
-"তুমি আমায় এখনো ভালোবাসো?"
-"জানি না.."
-"কখনো জানতে ইচ্ছে হয় না?"
-"না.."
দীর্ঘশ্বাস ফেললো জ্যোতি। সোফায় আরাম করে বসে উদাস গলায় বললো,
-"আমার না মাঝেমাঝে জানতে ইচ্ছে হয়... তোমাদের কাছে ফিরে যেতে ইচ্ছে হয়। তবে যখনই তোমার স্বভাবের কথা মনে পড়ে তখন নিজেকে শান্ত করি।"
-"অহ.."
-"তুমি আমায় কখনোই বোঝোনি.. আমার চাওয়া-পাওয়ার মূল্য দাওনি। যখন তোমাকে আমার প্রয়োজন ছিল, তখন কখনোই তোমায় কাছে পেতাম না। আমার খুব কষ্ট হতো জানো?"
-"জানি..."
-"জেনেও কেনো কিছু করতে না? স্ত্রী সন্তানের দিকে তাকিয়ে একটিবার কী বাবার মুখের উপর কথা বলা যেত না?"
-"হয়তো যেত.. তবে তাতে আব্বাকে অসম্মান করা হতো!"
তাচ্ছিল্যের হাসি ঠোঁটে ফুটলো জ্যোতির। মাজহারুলের দিকে ফিরে বললো,
-"সম্মান করা এবং অন্যায় মেনে নেবার মাঝে যে পার্থক্য রয়েছে তা হয়তো তুমি জানো না।"
-"তুমি তো জানো.. তাহলে তুমি কেনো অন্যায় করলে?"
-"আমি কোনো অন্যায় করিনি..."
চোয়াল শক্ত হয়ে এল মাজহারুলের। শক্ত গলায় সে বললো,
-"সাতমাসের বাচ্চাকে ফেলে অন্য পুরুষের হাত ধরে পালিয়ে যাওয়া অন্যায় নয়?"
-"না.. নয়। স্বামীর সাপোর্ট না পেলে একজন মেয়ে এমন হাজারো ছেলের সাথে পালিয়ে যাবার অধিকার রাখে।"
-"তাই? তোমার বিবেক তোমাকে এই বলে?"
-"হ্যাঁ বলে..."
উঠে দাঁড়ালো মাজহারুল। জ্যোতির সঙ্গে আর একমুহূর্ত বসে থাকার ইচ্ছে তার নেই। রাগে তার পুরো শরীর থরথর করে কাঁপছে।
-"কোথাও যাবে না তুমি.. আমার কথা শেষ না হবার আগে তুমি কোথাও যাবে না।"
দ্রুতপায়ে দরজার দিকে এগিয়ে দরজা বন্ধ করলো জ্যোতি। তারপর আবারও ফিরে এল মাজহারুলের কাছে। তার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে শীতল গলায় বললো,
-"একটা কথা কী জানো মাজহার? তুমি তোমার বাবা মায়ের কাছে ভালো সন্তান হতে পেরেছো, তবে আমি আমার সন্তানের কাছে ভালো মা হতে পারিনি। আর না কখনোই পারবো..."
চোখজোড়া বুজে সজোরে কিছু নিঃশ্বাস ছেড়ে আবারও সোফায় বসলো মাজহারুল। সময় নিয়ে নিজেকে শান্ত করে ধীর গলায় বললো,
-"এমনতো হবার ছিল না..."
-"কিন্তু হয়েছে তো। বিশ্বাস করো আমার দম বন্ধ হয়ে আসে। একজন মা হয়ে জীবত অবস্থায় আমি আমার মেয়ের সাথে থাকতে পারি না। এর চেয়ে কষ্টকর কিছু আর পৃথিবীতে আছে?"
ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো জ্যোতি। মাজহারুলের পাশে বসে আঁকড়ে ধরলো তার দু'হাত। ব্যাকুল স্বরে বললো,
-"ওকে আমার কাছে প্লিজ দিয়ে যাও। আমি তোমায় কথা দিচ্ছি আমি ওকে তোমার কাছ থেকে কখনোই আলাদা করবো না। ওর আমাকে দরকার। ও বড় হচ্ছে। দেবে আমার মেয়েকে আমার কাছে?"
-"জ্যোতি তুমি শান্ত হও।"
-"আমি শান্ত আছি.. তুমি শান্ত নেই। তুমি বোঝো না। তুমি কিছুই বোঝো না.. আমি তো মা। আমার কষ্ট হয় না? আমি আর কত নিজেকে শক্ত করবো?"
-"বাচ্চা নিয়ে নাও.. মৌমিকে মনে পড়বে না।"
-"কিসের বাচ্চা! কোন বাচ্চা! নেব না বাচ্চা.. কোনো বাচ্চা নেব না। আমার মৌমিকেই চাই।"
ক্রন্দনরত অবস্থায় চেঁচিয়ে উঠলো জ্যোতি। পরিস্থিতি নিমেষেই পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে বুঝতে পেরে একটি দীর্ঘশ্বাস ফেললো মাজহারুল। ভারী গলায় বললো,
-"আমার এখন যাওয়া উচিৎ।"
-"না তুমি যাবে না। তুমি সব সময় আমাকে এড়িয়ে যাও। আজ তোমাকে আমার কথা শুনতেই হবে।"
মাজহারুলের বাহুডোরে নিজেকে আবদ্ধ করলো জ্যোতি। অশ্রুসিক্ত নয়নে তার দিকে একরাশ আকাঙ্খা নিয়ে তাকিয়ে বললো,
-"দেবে না মৌমিকে আমার কাছ?"
-"তুমি অন্তত আমার প্রাণকে কেড়ে নিও না।"
মাজহারুলের উত্তরে পুরো শরীরজুড়ে শীতল এক রক্তস্রোত বয়ে গেলো জ্যোতির। তাকে আরও গভীরভাবে জড়িয়ে ধরে চোখজোড়া বুজলো সে। সে খুব লোভী... খুব। নয়তো মাজহারুলের কাছ থেকে কী করে চাইতে পারলো সে তার জীবনকে? লোকটি সহজসরল বলে?
![](https://img.wattpad.com/cover/197974578-288-k533882.jpg)