-"হাতটা দাও.."
মেসবাহর কথায় হাত বাড়াতেই সুহার হাতে চকলেট পুরে দিল সে। চোখমুখে প্রশান্তির ছায়া ফুটিয়ে বললো,
-"ছিঁড়ে দেই?
সুহা মাথা নেড়ে সম্মতি জানাতেই চকলেটের প্যাকেট ছিঁড়ে তা আবারও তার হাতে ধরিয়ে দিল মেসবাহ। ছোট সুহাকে কোলে চাপিয়ে এগুলো ড্রইংরুমের দিকে। ছোট্ট এই কোমলমতি মেয়েটিকে বেশ মনে ধরেছে তার। হরিণীর মতো টানাটানা চোখ দুটো দিয়ে যখন ড্যাবড্যাব করে তার দিকে তাকায় তখন বুকের ভেতরটা হুহু করে উঠে। ইচ্ছে হয় পৃথিবীর সকল সুখ এনে ছড়িয়ে দিতে তার পায়ের তলায়। ছোট এই মেয়েটি যে সুখের দেখা পায়নি কখনোই! সোফায় সুহাকে বসিয়ে তার পাশে বসলো মেসবাহ। টেলিভিশনে কার্টুন ছেড়ে তার দিকে চেয়ে বললো,
-"বিকেলে কিছু খেয়েছো?"
-"হু..."
-"এখন কি ক্ষুধা পেয়েছে?"
-"উহু..."
-"এই চকলেটটা খেতে ভালোলাগছে?"
-"হু।"
মাথা নেড়ে সুহার জবাবগুলো দেখে সামান্য হাসলো মেসবাহ। টেলিভিশনের দিকে তাকিয়ে বললো,
-"বড়টা দেখছো না? ওই যে বিড়ালের মতো.. ওটা টম। আর ছোট পিচ্চি ইদুরটা হলো জেরি। দেখো.. সারাসময় কিভাবে এরা একে অপরের পিছনে লেগে থাকে!"
মেসবাহর কথায় আগ্রহী চোখে টেলিভিশনের দিকে খানিকক্ষণ তাকিয়ে রইলো সুহা। তবে তাতে বেশি একটা মজা খুঁজে না পেয়ে সে আবারও মেসবাহর দিকে ফিরে মাথা নেড়ে নাকমুখ কুঁচকে ফেললো।
-"ভালো লাগছেনা দেখতে?"
-"হু.."
-"ঠিকাছে। আমরা টিভিই অফ করে দিলাম।"
ঠোঁটে বিশ্বজয়ের হাসি ফুটিয়ে সুহা দু'হাত বাড়িয়ে দিল মেসবাহর দিকে। একহাতের তালুতে অন্য হাতের তালু লাগাতেই পাশ থেকে মেসবাহ বলে উঠলো,
-"খেলতে ইচ্ছে করেছে? কী খেলবে? দশ বিশ?"ডাইনিং থেকে মেসবাহ এবং সুহার মাঝের মিষ্টি বন্ধন দেখে বিবর্ণ ঠোঁটে হাসি ফুটলো উল্লাসীর। সুহা এবাড়িতে দিন তিনেক হলো এসেছে। এর মাঝে সুহার না বলা কথাগুলো বেশ বুঝতে শিখে গেছে মেসবাহ। প্রতি রাতেই তার জন্য কিছু না কিছু নিয়ে তবেই বাড়ি ফেরে সে। তারপর সাথে নিয়ে বসে রাতের খাবারের আগ পর্যন্ত টেলিভিশন দেখে। খেলাধুলায় সঙ্গ দেয়। মাঝেমধ্যে বেশ খুনসুটিও চলে দুজনের মাঝে। যা দেখলেই মনের ভেতরটায় প্রশান্তিতে ভরে উঠে উল্লাসীর। যেখানে প্রত্যেকেই সুহার মাঝের প্রতিবন্ধকতার জন্য তাকে ধুর ছাই ধুর ছাই করেছে, সেখানে এই প্রথম কেউ এতটা কাছে টানছে তাকে! অপরদিকে সুহাও মেসবাহ বলতে পাগল। সারাদিন তার সঙ্গে সময় কাটালেও খেলার ফাকে বারবার জিজ্ঞেস করে বসে কখন আসবেন উনি? রাতে বাড়ি ফিরলেই একদম শরীরের সাথে লেপ্টে বসে থাকে। দুজনের মাঝের এই ভালোবাসার মুহূর্ত দেখলেই আত্মা জুড়িয়ে যায় উল্লাসীর। সে এ পৃথিবীতে যদি কাওকে মনের অন্তস্তল থেকে ভালোবেসে থাকে সে শুধুমাত্রই সুহা। তার খুশিতে অনায়াসে নিজের জান কুরবান করতেও সে ভাববে না দুবার। তার সেই কলিজার টুকরোকে যেভাবে মেসবাহ আগলে রাখে তা বেশ প্রশান্তি এনে দেয় তার বুকজুড়ে। স্বস্তির নিঃশ্বাস ছেড়ে ডাইনিং ছেড়ে শোবার ঘরে এল উল্লাসী। তার নানা সিকান্দার মির্জা এবং ইভানার বলা প্রতিটি কথা নিয়ে এই দু'রাত ভেবেছে সে। প্রচুর ভেবেছে। কষ্ট দেবার মানুষের অভাব নেই এই জগতে। অনেকে আসবে কষ্ট দিয়ে চলেও যাবে। তবে সেই নিজের ভালোবাসার মানুষটিকে আঁকড়ে ধরে তার সবটা আপন করে নেবে যে প্রকৃত অর্থে ভালোবাসতে জানে। দুজন বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হলেই যে সাথেসাথে তাদের মাঝে ভালোবাসা আপনাআপনি তৈরি হয়ে যায়, তার এই ধারণা ভুল। বিপরীত স্বভাবের মানুষটির প্রতি ভালোলাগা, তার প্রতি ভালোবাসা সবটাই আসে নিজের ভাবনার দ্বারা। আজকাল সে ভাবে মেসবাহকে নিয়ে। তার করা কার্যক্রমে অভিভূত হয়। ভালোলাগা এমনই জিনিস যা মন দিয়ে অনুভব করলে এর গভীরতা শুধু বাড়তেই থাকে। যা তার ক্ষেত্রেও ঘটছে। দিনেদিনে মেসবাহকে নিয়ে তার ভাবনার গতিপথ গহীন থেকে গহীনতর হচ্ছে...