বিষাদের ভারে ভীষণ ক্লান্ত লাগছিল বিকাশের। নিজেকে আর বহন করতে পারছিল না। ইচ্ছাশক্তির বিরুদ্ধে শরীর বা মনকে দিয়ে কোন কাজ করানো অসাধ্য সাধন করার মতো কঠিন। ঘরে ঢুকতেই বিকাশের চোখে পড়ল--খাটের ওপর পড়ে রয়েছে তার প্যাডের কাগজ। কাগজে চোখ বুলিয়ে বুঝতে পারল তাতে দীপার হাতের ছোঁয়া আছে, কিন্তু তার অর্থ উদ্ধারে অসমর্থ বিকাশ। লিপস্টিক দিয়ে লিখেছে বোঝা যাচ্ছে, কিন্তু কয়েকটা বিক্ষিপ্ত আঁচড় ছাড়া আর কিছু আবিষ্কার করতে পারছিল না। হঠাৎ হাজার ওয়াটের বাল্ব জ্বলে উঠল মস্তিষ্কে, এবং সেই আলোর কিছু রশ্মি বিকাশের স্মৃতিতে প্রতিফলিত হতেই তার মনে পড়ে গেল দীপার 'মিরর রাইটিং'-এর তথ্য। আয়নার সামনে ধরতেই ছবি পরিষ্কার, তাতে বিকাশের অপরাধবোধের বোঝা শতগুণ বেড়ে গেল। দীপাকে যে সে বুঝতেই পারেনি সেই যন্ত্রণার তির হৃদয়ের গভীরে বিঁধতে লাগল, ক্রমশ রক্তাক্ত করতে থাকল বিকাশকে।
কাগজটা দু-হাতে টানটান করে ধরে ভাবে বিভোর বিকাশ একদৃষ্টে আয়নার দিকে চেয়ে রইল। 'আই লাভ ইউ' তিনটে শব্দের বিচ্ছুরিত জ্যোতি তাকে ক্ষণিকের জন্য অন্ধ করে দিয়েছিল। হৃদপিণ্ড কাজ করছিল ঠিকই, কিন্তু হৃদয় চাপা পড়েছিল ঘোর অমাবস্যায়। নিজেকে কিছুতেই ক্ষমা করতে পারছিল না। বারবার মনে হচ্ছিল--অর্জুন গাছের উপমা দেওয়া মারাত্মক অন্যায় হয়েছে। সেটা ছিল শুধুই শুকনো রূপক, কিন্তু সত্যিকারের রক্ত ঝরছে দীপান্বিতার অন্তর থেকে নিঃসৃত তিনটে শব্দে। বিকাশের ঘৃণার বদলে দীপা উপহার দিয়ে গিয়েছে ভালোবাসা। উদার হাতে বিলিয়ে গিয়েছে বহু মূল্যবান সম্পদ। দীপা ভালোবেসে নিজেকে সমর্পণ করতে চেয়েছিল, কিন্তু আধার প্রস্তুত ছিল না। তাই অনাদরে, অসময়ে বিদায় নিতে হল। সেই মুহূর্ত থেকে দীপার প্রতি বিকাশের শ্রদ্ধা একশগুণ বেড়ে গিয়েছিল।
বিকাশের আফসোস যে, দীপান্বিতার নগ্ন রূপ কেন সে সেই মুহূর্তে সহ্য করতে পারেনি, কি কারণে তার চোখের পাতা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল তা বুঝিয়ে বলার সময় পেল না। বিকাশ গ্রামের ছেলে, ছেলেবেলা থেকে গাছগাছালির পরিবেশে বড়ো হয়েছে। তাদের স্কুলের মাস্টারমশাই ছিলেন গ্রামের বৈদ্যও, অসুখবিসুখে মানুষের প্রধান সহায়। অর্জুন গাছের ছাল যে কি ভীষণ দামী, এবং কত অসুখের প্রতিষেধক যে তার থেকে তৈরি হয় তার চাক্ষুষ প্রমাণ পেয়েছিল মাস্টারমশাইয়ের কাছে। তিনি বারবার বলতেন--গাছই জীবন। গাছের ভিতর জীবনের স্পন্দন অনুভব করবার চেষ্টা করতে সবাইকে অনুপ্রাণিত করতেন।