বিকাশদের সচ্ছল পরিবার। গ্রামে তার বাবার যথেষ্ট প্রতিপত্তি আছে। বলা যায়—তিনি হলেন সেই এলাকার হর্তা-কর্তা-বিধাতা। অন্যের কাছে যা সৌভাগ্য বলে পরিগণিত হতে পারত, সেটাই ছিল বিকাশের গলার কাঁটা। পাড়া-প্রতিবেশীদের হাজার স্তুতি বাক্য সত্ত্বেও কিছুতেই সে গিলতে পারত না।
একদিন চোখের সামনে গ্রামের গরীব মানুষদের ওপর বাবার অকথ্য অত্যাচার দেখেছিল বিকাশ। কিছুতেই মানতে না পেরে নিজে থানায় গিয়েছিল দারোগাবাবুর কাছে নালিশ জানাতে। তিনি খুব যত্ন করে মিষ্টি খাইয়ে পুলিশের জীপে তাকে বাড়িতে পৌঁছে দিয়েছিলেন, কিন্তু তার কথার কোন গুরুত্ব দেননি। পরে মায়ের মুখে শুনেছিল, "খোকা, তুই এ কি করেছিস? বাবার নামে থানায় নালিশ করে এসেছিস? এই দিন দেখার জন্যই কি আমি বেঁচে আছি? হায় আমার পোড়া কপাল।"
বিকাশ মাকে বোঝানোর আপ্রাণ চেষ্টা করেছিল, "মা, তুমি ভাবতে পারবে না বাবা কি করেছেন?"
"যাই করুন, তিনি তোর বাবা। ভগবান আছেন--তিনি শাস্তি দেবেন! তুই কে তাঁকে অপমান করার?"
ট্যাক্সির বিকট হর্ণের শব্দে বর্তমানে ফিরে এল বিকাশ। ধারাবাহিকতার সুর কেটে যেতে বিকাশ প্রথমে ক্ষুণ্ণ হয়েছিল, কিন্তু একটু পরে বুঝতে পেরেছিল যে, বাধাপ্রাপ্ত হয়ে ভালই হয়েছিল, নাহলে হয়তো বসে বসে সারারাত কেটে যেত। বিকাশ প্রায়ই ভাবে--মাথায় এত কিছু ধরে কি করে! সাইজ তো ছোট, হয়তো পাকস্থলীর মতো জড়াজড়ি করে থাকে, তাই বোধহয় মাথা থেকে যা কিছু উৎপত্তি--সবই জটিল।
বাইরে থেকে রাতের খাবার খেয়ে এসে সেদিনের মতো শুয়ে পড়ল বিকাশ। কিন্তু চোখের পাতা বন্ধ করলেই তো আর বিশ্বসংসার ঝাঁপ ফেলে দেয় না, তাই মনে মনে চলতে লাগল বায়োস্কোপ।
বিকাশ বুঝে গিয়েছিল গ্রামে থাকা আর তার পক্ষে সম্ভব হবে না। অন্যায়কে প্রশ্রয় দিয়ে বাঁচতে পারবে না। ইংরাজি অনার্স নিয়ে বি.এ. পাস করার পর, চাকরির পালা। সে ভালো করেই জানত, গ্রামে থাকলে তার বাবা কিছুতেই তাকে চাকরি করতে দেবেন না। তাঁর ধারণা চাকরি করা মানে পরের গোলামি করা। নিজেদের জমিজমা আছে, সুরকির গোলা আছে, সরকারি রাস্তা তৈরির ঠিকা আছে। চাকরি করা তো টাকার জন্য, ব্যবসার মতো টাকা কোন চাকরিতে আছে?