সুস্মিতা নির্জীবের মতো জড়সড় হয়ে সোফায় ঝিম মেরে বসে থাকতে থাকতে একসময় ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। গতকাল রাতে বিকাশ কখন চলে গিয়েছিল বুঝতেই পারেননি। ঠাণ্ডা হাওয়ায় হঠাৎ ঘুম ভেঙে গিয়েছিল, তখন অনেক রাত, ঘরে মৃদু আলো জ্বলছিল। অবসন্ন শরীর একেবারে অবাধ্য, সোফা ছেড়ে উঠতেই পারছিলেন না। আধো আলো আধো অন্ধকারে মনে হল--বহুদিন আগে স্মৃতির গহ্বরে হারিয়ে যাওয়া 'মা' ঘরে লম্বালম্বিভাবে পায়চারি করছেন; মৃত্যু পথযাত্রী মেয়েকে পাহারা দিচ্ছেন। কি আশ্চর্য! ছোটবেলায় দেখা মায়ের মুখ এখনও অবিকল সেইরকম রয়েছে।
মায়ের প্রসঙ্গ সুস্মিতা প্রায় ভুলেই গিয়েছিলেন। রাগে, অভিমানে, বিরক্তিতে মায়ের প্রতি বিশেষ আকর্ষণ কখনো আলাদা করে বোধ করেননি। শৈশবের দিনগুলো সিনেমার মতো চোখের সামনে দিয়ে সরে সরে যেতে লাগল। সুস্মিতা নীরব দর্শকের ভূমিকায়। তাঁর খুব ইচ্ছা করছিল মা-কে যত্ন করে বসান, আদর-আপ্যায়ন করেন, কিন্তু কিছুতেই উঠতে পারছিলেন না। মা-কে 'মা' বলে ডাকতে পর্যন্ত পারলেন না, গলা শুকিয়ে কাঠ, শরীর ভীষণ ভারী লাগছিল। অনেক কষ্টে হাত বাড়িয়ে টেবিল থেকে এক গ্লাস জল নিলেন, তেষ্টায় বুকের ছাতি ফেটে যাচ্ছিল। জল খেয়ে গ্লাস রাখতেই 'মা' উধাও। সুস্মিতা সোফায় সোজা হয়ে উঠে বসলেন। বুঝতে পারলেন, যা দেখেছেন তা চোখের ভুল। চোখের ভুল না মনের ভুল কে তার বিচার করবে!
সুস্মিতা জানতেন একবার বিছানায় শুয়ে পড়লে আর উঠতে পারবেন না। বুকের বাঁ-দিকে ব্যথা ততক্ষণে জাঁকিয়ে বসেছে। শ্বাস নিতে গেলেই খচখচ করছে, তাই সদর দরজা লক না করে ভেজিয়ে রাখলেন। দুটো ফোন, ল্যাপটপ, সিগারেটের প্যাকেট, দেশলাই, অ্যাশট্রে সাথে রেখেছেন। অনেকদিনের পুরনো, অনেক স্মৃতি বিজড়িত একটা ছোট আয়না, ভাইয়ের ছবি...তাঁর পছন্দের যাবতীয় সরঞ্জাম নিয়ে বিছানায় বালিশে হেলান দিয়ে বসেছিলেন। সারা রাত একভাবে আধশোয়া অবস্থাতেই কাটিয়েছেন। মনে মনে বুঝতে পারছিলেন যে, হাতে সময় বেশী নেই। কোন কাজও বাকী নেই, কারও প্রতি কোন ক্ষোভও নেই।
জীবনে চলার পথে সুস্মিতা উপলব্ধি করেছেন যে, জীবন তাঁর প্রতি উদাসীনতা নয় উদারতা দেখিয়েছে। প্রাপ্যের চেয়ে প্রাপ্তি সবসময়ই বেশী। মাঝে মাঝে যে মান-অভিমান হয়নি তা নয়, তবে তা আসক্তির কারণে। শেষমেশ, নিজেকে প্রস্তুত রেখেছেন অন্তিম লগ্নের জন্য।