২.৮

475 2 0
                                    

মুনীরা বলে দিয়েছে বাজার করতে হবে। বাজারে গিয়ে খেয়াল করলাম টাকা অল্পই আছে পকেটে। কোনমতে যা যা আর্জেন্ট কিনলাম। আবার বাসায় গিয়ে বের হয়ে বাজার করা সম্ভব না। আজ জুম্মার দিন, রেডি হতে হবে।
মেহমানদারি ভোগ করলে দেনমোহরের মত একটা হাদিয়া দিতে হয় সামর্থ্য অনুযায়ি। আসার সময় হাজার টাকা গুঁজে দিয়ে এসেছি নাইমার হাতে। রাগ করল নাকি খুশি হল কে জানে। বলল, বিয়ে খেতে এলে গিফট আরো বড় হতে হবে।
বাসায় ফিরলাম বেলা এগারোটা বেজে গেছে। ড্রইংরুমে সোহানীর সঙ্গে বসে গল্প করছে মুনীরা। দুইজনে ভাল খাতির হচ্ছে দিনদিন।
– সেই কখন গেলা কাল, আসতে মনে চায়না?
মুনীরা উঠে এসে বাজার নিয়ে যায় কিচেনে।
– মাংস নাই তো, আনলেনা? আজ নিরামিষ খেও।
– দেরি হয়ে গেছে তো, পাইনি। পেলে বিকেলে নিয়ে আসব বড় বাজার থেকে।
– বাসায় আসতে মন চাইবে কেন, মাদ্রাসায় খাতিরদারি চলছে যে!
এরমধ্যে সোহানী ইঙ্গিতপূ্র্ণভাবে মন্তব্য করে।
– কি যে বলেন, আমি কি মেহমান নাকি?
প্রসঙ্গ ভালমতো ওঠার আগেই ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা করলাম। সোহানী যেহেতু জানে কি হচ্ছে, বলে দেয়নি তো আবার? মুনীরা অনেকসময় সাময়িকভাবে দুঃসংবাদ চেপে যায়, পরে বিস্ফোরণ হয়।
মুনীরা ‘খাতিরদারি’র মানে বোঝেনি। জিজ্ঞেস করল,
– খুব খাওয়াদাওয়া হচ্ছে নাকি?
– নাহ। আজ মীটিং আছে, মেহমানদের একটু ঘুরিয়ে দেখালাম আশপাশটা।
সোহানী দুষ্টু দৃষ্টিতে তাকাল আমার দিকে। মুখে চাপা হাসি। ঢোক গিললাম। এখুনি বলে দেবে নাকি?
– আচ্ছা আপা, যাই। দানিয়েলেরও বাজার নিয়ে আসার কথা।
স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। মনে হয় বলবেনা। মনে হল এই লুকোচুরি ঠিক হচ্ছেনা। সোহানি, চাঁদনি, নাইমা – হঠাৎ সব একসঙ্গে জেনে গেলে কি যে হবে!
বিকেলে বেরিয়ে এক বন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে গেলাম। মাদ্রাসায় যাবার আমন্ত্রণ ছিল। আজ আরো মেহমান আসার কথা, তাদের গাইড দেয়ার লোক দরকার। আমি জুম্মার সময় ইমাম সাহেবকে বলে দিয়েছি, বিকেলে কাজ আছে।
বন্ধুটিও আমার মত চাকরি করছে কোনরকম একটা। দুজনে সুখ দুঃখের আলাপ, কলেজ-ভার্সিটির স্মৃতি রোমন্থন করলাম। বাসায় ফিরতে রাত হল। খেয়েদেয়ে শুয়ে পড়লাম। আজ খুব ক্লান্ত শরীর। ঘুমটা খুব দরকার, সকালে অফিস।
– মেহমানরা কি চলে গেছে?
মুনীরা জিজ্ঞেস করলে শুয়ে।
– উহু, ভোরে বাসে উঠবে।
বুকে মাথা রেখে লোম আস্তে আস্তে টানছে বৌ। প্রায়ই এমন করে রাতে। চুলে আঙুল চালিয়ে দিয়ে চোখ বুজলাম।
– মাদ্রাসায় থাকবে ওনারা?
– হুম।
– আজ কি আরো মেহমান এসেছে?
– হ্যাঁ, আজ মীটিং তো, সকালে আরো চারজন এসেছে।
– সবাই মাদ্রাসায় থাকবে?
– কি জানি।
সকালে তো এত আগ্রহ দেখায়নি, এত কৌতুহল কোত্থেকে এল? একটু অবাক লাগে।
– সন্ধ্যায় রিপা ভাবী গেল মাদ্রাসায়।
ঢুলুঢুলু চোখ জেগে উঠল শুনে। আমাদের পাশের ফ্যামিলি রিপা ভাবীর। হাজবেন্ড একটা ট্রাভেল এজেন্সিতে চাকরি করে। ওদের একটা মেয়ে আছে টীনএজার।
– কেন?
– খেদমত।
এক শব্দে বলে। মুনীরা কি সন্দেহ করছে? বুক ধকধক করছে। গালে কাঁপন ধরতে পারছে কি? নিশ্চিত দুপুরেও এই শব্দ ওর জানা ছিলনা, বা শব্দের বিশেষ অর্থ সম্পর্কে ছিল অজ্ঞ।
আমার নীরবতা দেখে বলতে শুরু করে,
– মেহমানরা এসেছে না? সবাই তো একা, ওয়াইফ রেখে এসেছে। ওনাদের সাপোর্ট দেয়ার জন্য..
মেপে মেপে বলছে মুনীরা। ওর ধারণা জানতে পারলে আমি-ই ক্ষেপে যাব!
– ওয়াইফ হিসেবেই সাপোর্ট দেবে।
– সাপোর্ট?
– মানে, হাজবেন্ড-ওয়াইফের মতই.. মুয়াশিরা করতে হতে পারে।
কোনমতে বলে চুপ করে মুনীরা। জিজ্ঞেস করলাম,
– কেউ এসেছিল নিতে?
– মাগরিবের পরে আমরা তালিমে ছিলাম কয়েকজন, ওপরে। একটা ছেলে এসেছিল মাদ্রাসা থেকে। বলছিল নতুন মেহমান এসেছে, খেদমতের জন্য দুজন দরকার।
– আর কিছু বলেনি?
– সেতু ভাবী ছিল। জিজ্ঞেস করল কে কে যেতে পারবে হাত তুলতে। কেউ রাজি হচ্ছিলনা দেখে ভাবী রেগে গেল।
– কেন?
– যে ছেলেটা এসেছিল, খুব বেয়াদব। ভাবীকে খোচা মেরে বলে, কই, কেউ তো শোনেনা আপনার কথা!
– তারপর?
– ভাবী ক্ষেপে বলল, কেউ এগিয়ে না আসলে সবাইকে পাঠাবে। তখন রিপা ভাবী হাত ওঠাল।
– দুইজন না চেয়েছে?
– হু। বাকিদের কারণ বলতে হয়েছে তো। কেউ বলেছে শরীর খারাপ, কারো সময় খারাপ। আমি বলেছি হাজবেন্ডের অনুমতি নেই।
– ভাল করেছো সোনা।
বলে চকাস করে কপালে চুমু খেলাম। মনে হল যেন বড় একটা ফাড়া গেল।
– ভাবী খুব ডিসএপয়েন্টেড হয়েছে আমার প্রতি। বলল তোমার সঙ্গে আলাপ করবে।
– সে দেখা যাবে।
আশ্বস্ত করি ওকে।
– বলে, এই বয়সে মেহমানদারি না করলে কবে করবে? কত দূর থেকে এসেছে মেহমানরা, কষ্ট করছে।
– দুদিন কষ্ট করলে কিছু হয়না।
– তাই বলে মেহমানদের আপ্যায়ন করা লাগেনা? ভাবী কতগুলো মাসআলা শুনিয়েছে..
মনে হচ্ছে সেতু ভাবী মুনীরার মাথায় দোষবোধ ঢুকিয়ে দিয়েছে।
– রিপা ভাবী গেল তো।
– দুজনের জায়গায় একজন গেলো। দুজনের সওয়াবও নিয়ে নিল।
মুনীরার কন্ঠে ঈর্ষা।
– ঘরে বসে এবাদত করো, দেখবা কতো সওয়াব।
– ঘরেই তো বসে থাকি।
গলা মোটা করে বলে মুনীরা। মেজাজ খারাপ হল, বললাম –
– তাহলে রেডি হও, দিয়ে আসি মাদ্রাসায়।
– ইশ..
বুকে মুখ লুকায় মুনীরা। কন্ঠে লজ্জ্বা। ভাবলাম এবার এই অদ্ভুত আফসোস বাদ দেবে। কিন্ত কিছুক্ষণ চুপ থেকে নিজেই বলে,
– এখন যাওয়া যাবেনা, রাত কয়টা বাজে দেখেছো!
– আমি নিয়ে যাবো। ওখানে না আরো মেয়ে লাগবে?
ওকে লজ্জ্বা দিয়ে চুপ করাতে হবে ঠিক করেছি।
– অন্য ভাবীরা সামলে নেবে।
মুনীরা হাসি চেপে রাখার চেষ্টা করছে। সেতু ভাবী দ্বিধায় ফেলে দিয়েছে ওকে।
– দিয়ে আসি, ঘরে ফিরে বলবা কেমন লাগল।
– ধুত্তেরি.. লজ্জ্বা দিওনা তো আর!
বুকে চড় মেরে হাসে মুনীরা।
একেবারে চুপ করে রয়েছে, জিজ্ঞাস করলাম,
– কি ভাবতেছ?
– রিপা ভাবীর কথা চিন্তা করতেছি। কি করতেছে যেন এখন..
– তোমার মত শুয়ে আছে। নাহ, ঠ্যাং চ্যাগিয়ে শুয়েছে.. কুষ্টিয়া থেকে আগত মেহমান ঢাকাই বেলুনে বাতাস ভরছে।
উচ্চস্বরে হাসে মুনীরা। বিছানায় উঠে বসে ব্যান্ড খুলে চুল ছেড়ে ঘুমানোর প্রস্ততি নেয়।
– এমন করে বলছ, খুব মজা।
– মজাই তো।
– তোমাদের জন্য তো মজা, যেখানে ইচ্ছা খালি ঢুকিয়ে দাও!
– ভাবীও মজাই করছে। ঘরে বুড়ো জামাই, ওখানে খেলছে ইয়াং ছেলেদের সঙ্গে।
– এমন ভাবে বলছ না, যেন যখন যে ছেলেকে ভাল লাগছে তার সঙ্গে করছে।
– অন্তত দুই নাগর তো পেয়েছেই।
– দুই? যাহ!
মুনীরার চোখে অবিশ্বাস।
– তুমি তো গেলেনা, ওই বেচারা এখন কই যাবে?
– একসঙ্গে?
অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে।
– হুম। একজন এদিক দিয়ে, আরেকজন ওদিক দিয়ে।
দুহাতের আঙুল ওপরে নিচে দেখিয়ে বোঝালাম।
– মাগোহ.. তাও বললছ মজা?
মুনীরার চোখমুখ বেঁকে গেল শুনে। মজা লাগল দেখে।
– মজাই তো.. চলো দিয়ে আসি তোমাকে, বলব গর্ত রেডি আছে খালি ইঁদুর ঢুকবে। শহুরে গর্ত কি পারবে গেঁয়ো ধাড়ি ইঁদুর সামলাতে?
নাটকীয় গলায় বলি। হাসে মুনীরা। বলে,
– শহুরে কিসের? সারাজীবন থেকে আসলাম গ্রামে.. কয়েকমাসে শহুরে বানিয়ে দিলে?
– পারবেনা সেটা বল।
খোচা দিলাম।
– ইশ, পারবেনা.. তুমি জানো? একজন নিচে.. আর, একজন মুখে দিয়ে… যাহ, ওসব হবেনা আমাকে দিয়ে।
ওপর দিকে তাকিয়ে একটু ভাবল মুনীরা, নিজেকে কল্পনা করল তেমন পরিস্থিতিতে।
– পারবনা, হবেনা, দেবোনা.. এসব বলা মেয়েদেরই ওখানে পাঠায়। ওরাই শিখিয়ে দেবে ল্যাওড়া খাওয়া।
আঙুলে গাল টিপে বলি।
– ধুৎ! তোমার মাথা।
উঠে বাতি নিভিয়ে শুয়ে পড়ল মুনীরা।
সকালে রেডি হয়ে অসিফের উদ্দেশ্যে বেরিয়েছি। পেছন পেছন সিঁড়ির সামনে এসে দাঁড়ায় মুনীরা বিদায় জানাতে। দুকদম নেমেছি, দেখলাম রিপা ভাবী উঠে আসছে।
– ভাবী, কেমন আছেন? এখনি আসলেন?
মুনীরা উৎসুক হয়ে জিজ্ঞেস করে। বেবী ব্লু কালারের বোরকার নিকাব মাথার পেছনে দিয়ে আমাদের সামনে এসে দাঁড়ায় ভাবী। মুখে ছড়ানো হাসি।
– হ্যাঁ, আসলাম মাত্র। তুমি তো গেলে না, মিস করলে!
মাথা নেড়ে বলে ভাবী। নাকে নাকফুল চিকচিক করছে, চোখে ঝিলিক।
– হামিদ, তুমি নাকি পারমিশন দাওনা ওকে? দুই প্রতিবেশী থাকতাম একসঙ্গে।
আমার দিকে চোখ নাচিয়ে বলে ভাবী। আমি হাসি।
– কি কি হল?
কৌতুহল মুনীরার কন্ঠে।
– অনেএএক কিছু। গিয়ে পরিচিত হলাম সবার সঙ্গে। ভাল খাওয়াদাওয়া হল। যশোর থেকে, কুমিল্লা থেকে, আরো কই কই থেকে এসেছে মেহমানরা। সবাই এলাকার গল্প করল। গল্পে গল্পে রাত পার যাকে বলে।
ভাবীর বলার ধরণে মুনীরার চোখেমুখে আফসোস স্পষ্ট হয়ে দেখা দিয়েছে। আমার কাছে লেজকাটা শিয়ালের গল্প মনে হল, যদিও উচ্চারণ করে বলা যাবেনা।
– এভাবেই হয়ে গেল?
একটু অবাক মুনীরা।
– ছহবত হয়েছে তো, দুইটা-আড়াইটা থেকে ফজর পর্যন্ত। ফাঁকে ফাঁকে গল্পটল্প হয়েছে। এইযে, এইটা দিয়েছে এক ব্যবসায়ী।
নাকের জ্বলজ্বলে সোনার ফুলটা দেখিয়ে বলে। নতুন বলেই এত চিকচিক করছে।
– খুব সুন্দর তো ভাবী।
মুনীরা গদগদ হয়ে বলে। চাপা গলায় জিজ্ঞেস করে,
– আচ্ছা, ভাবী, একসঙ্গে কি কয়েকজন থাকে?
– হাহাহহ.. নাহ, একজন একজন করে।
হেসে বলে ভাবী। মুনীরা আমার দিকে তাকায় চোখ পাকিয়ে,
– দেখেছ!
– মেয়ে স্কুলে গেল কিনা কে জানে দেখি গিয়ে।
বিড়বিড় করে বলতে বলতে উঠে যাচ্ছে রিপা ভাবী।
– ভাবী, আজকে থাকবে মেহমানরা?
আগ্রহী মুনীরা।
– আজ? উমম, মনে হয়না। গোছগাছ করছে, বিকেলে বাসে করে ফিরবে বলছিল। তাও রেডী থেকো, লাগলে সঙ্গে নিয়ে যাবো। আমাদের বিল্ডিং থেকে আমি একাই ছিলাম, আরো অওরাত লাগতো।
মুনীরা আমার চোখে চোখ রেখে তাকিয়ে আছে একভাবে, অনুমতির আশায়। ভাবীর সামনে কি আর বলব, সেতু ভাবীর পর সে-ও মাথায় ভূত চড়িয়ে দিয়েছে। আসলে ঘরে একা বসে থেকে থেকে এক্সাইটমেন্ট খুঁজছে বৌ।
– রান্নাবান্না করে রাখব বিকেলে, ঠিক আছে?
– ওকে।
ঢোক গিলে বললাম। রিপা ভাবী স্মিত হেসে উঠে গেল। বিড়বিড় করে বলছে,
– গোসল করে একটা ঘুম দেবো। ফজরের টাইম হয়ে গেল, তাড়াহুড়ো করে পানি ঢাললাম। কতগুলো মিক্স হয়ে আছে।
দুপুরে একবার ফোন দিয়ে বললাম, অন্য কেউ গেলে ওর যাবার দরকার নেই। হু বললেও কানে নেয়নি কথা।
লাঞ্চের পর কাজে প্রচন্ড চাপে ভুলে গেছি বাসার কথা। অফিস থেকে বরিয়ে মনে পড়তেই ফোন দিলাম। মুনীরা বলল, মাদ্রাসা থেকে আজ আর কেউ আসেনি। নিরাশা ভেসে এল তরঙ্গে, আমি হাঁফ ছেড়ে উঠলাম বাসে।


















কমিউনিটি সার্ভিস (১৮+)Where stories live. Discover now