২.২

517 2 0
                                    

তালগাছ এক পায়ে দাঁড়িয়ে,
সব গাছ ছাড়িয়ে।
শহরে অত উঁচু তালগাছ হয়না। তালগাছ দু-একটা আছে কিনা তাও বলা মুশকিল। ছোটছোট পাইন গাছ লাগায় বড়লোকে সৌন্দর্যবর্ধনের জন্য।
তালগাছ না থাকলেও তালের শাঁস বেশ পাওয়া যায় সিজনে। পাকা তাল অবশ্য খুব একটা পাওয়া যায়না।
এখন সিজন কিনা আমার জানা নেই। ভ্যানে করে এক ছোকরা তালের শাঁস বিক্রি করছে। জিজ্ঞেস করলাম নরম আছে কিনা। যদিও জিজ্ঞেস করে লাভ নেই, এরা সবসময়ই হ্যাঁ বলবে। নরম-শক্ত যে এতটা সাবজেকটিভ ব্যাপার হতে পারে তা দার্শনিকদেরও ধারণার বাইরে।
তালের শাঁস গরমের দিনে দুপুর বেলায় খেতে হয়, এসময় স্বাদ-গন্ধ ঠিকমত ফোটে।
ছেলেটা তাল কেটে চোখ বের করে দিয়েছে পলিথিনে। একটা চোখ মুখে দিয়ে দেখলাম আসলেই সুস্বাদু, মাখনের মত নরম।
– তুমি কি বিকালে থাকবা এইখানে?
– কইতে পারিনা.. কাইল এই টাইমে শিউর পাইবেন।
ছেলেটা ঠোঁট উল্টে বলে।
তাল খেতে খেতে একটা টিউশান ধরতে হাঁটা দিলাম। গত ক’দিনে কয়েকটা পড়ানো মিস গেছে। শিক্ষক না এলে স্টুডেন্টদের ফুর্তি হয় ঠিকই, কিন্ত মায়েদের কপালে ভাঁজ পড়ে। ক্যালকুলেটর নিয়ে হিসেব করতে বসে যায় একদিন মিস যাওয়ায় ক’টাকা লোকসান হল।
আজ সকাল থেকে লম্বা সেশন পড়িয়ে দুজনকে পুষিয়ে দিয়েছি।
সোহানীকে ফোন করে জানিয়ে দিয়েছি আজ দুপুরে খেতে আসবনা। দুপুরে যেখানে পড়াতে যাবার কথা সেখানে আগে আগে যাচ্ছি। বাসা হয়ে খেয়ে গেলে এক্সট্রা টাইম পড়ানো যাবেনা।
দুপুরের এই স্টুডেন্ট ছাত্রী। আমি ওদের বাসায় যাবার খানিক আগেই ফিরেছে। স্কুল থেকে ফিরে ফ্রেশ হয়ে বিশ্রাম নিয়ে খাওয়া-দাওয়া করে পড়তে বসে এমনিতে।
মুখে না বললেও সে যে বিরক্ত তা বোঝা যায়। ইউনিফর্ম নিয়েই পড়তে বসেছে। ঘন্টাখানেক পড়ানোর পর টের পেলাম ভাল খিদে পেয়েছে। এখন বেরিয়ে গেলে যে কারণে ভ্যাজাল করে আগে আগে এলাম তা সাধন হয়না।
আন্টি কিছু নাস্তা দিয়ে গেল। স্টুডেন্টের বাসায় নাস্তা পেয়ে আগে এত খুশি লাগেনি কখনো। ছাত্রীরও নিশ্চই ক্ষুধা পেয়েছে। হাফপ্লেট বীফ বিরিয়ানি চামচ চেটে খেয়ে ঠান্ডা পানি গিলে একটু স্বস্তি হলো।
ছাত্রীর গোমড়া মুখের তোয়াক্কা না করে পাক্কা দুঘন্টা পড়িয়ে বেরোলাম। খিদে আবার মাথাচাড়া দিয়ে ওঠার আগেই হোটেলে বসে খেয়ে নিলাম। খেয়েদেয়ে মুনীরার সঙ্গে খানিক্ষণ আলাপ করলাম।
দুদিন ধরে কথা নেই, তবু ফোন করেনি – এমনটা সাধারণত হয়না। কথা বলে জানা গেল কোন এক আত্মীয়ের বিয়ে নিয়ে ব্যস্ত ওদের বাড়ির মানুষজন। যাক, ভাল হল আমার জন্য।
আরেকটা টিউশানি শেষ করতে করতে প্রায় সন্ধ্যা হয়ে গেল। নাহ, এবার বাসায় ফেরা দরকার। গরমে গা প্যাচপ্যাচ করছে। শাওয়ারের নিচে দাঁড়িয়ে শরীর ঠান্ডা করতে হবে।
বিল্ডিংয়ের নিচে যখন পৌঁছেছি, মাগরিবের আযান হবে হবে ভাব। চিটচিটে দেয়াল ঘেষা সরু পুরনো সিঁড়ি বেয়ে আমার রুমের সামনে পৌঁছে বেল বাজালাম।
– আসসালামু আলাইকুম!
হাসিমুখে কেউ দরজা খুলবে এমনটাই আশা করছিলাম, কিন্ত সেই মুখে ঘন দাঁড়ি থাকবে তা ভাবিনি।
– ওয়ালাইকুম.. ইমাম সাহেব, আপনি?
ইমাম সাহেব দরজা থেকে সরে দাঁড়িয়ে ঢুকতে দিলেন। আমার অবাক হওয়া দেখেও চকচকে দাঁতের হাসি কমেনি।
– আপনার জন্যই বসে আছি আছরের পর থেকে।
– ক’দিন টিউশনি মিস গেল তো, সারাদিন পড়াচ্ছি।
– ওহ, রাত্রেও পড়াবেন?
– না, আজ খুব টায়ার্ড।
ভেতরে ঢুকে দেখলাম ড্রইংরুমে দুজন বোরকাওয়ালী বসে আছে। কম পাওয়ারি বাল্বের আলোয় এক মুহুর্ত লাগল বুঝতে, এরা সোহানী-চাদনী।
– যাযাকাল্লাহ ভাই, জেনেশুনে বিপদ কাঁধে নিয়ে ভাবীসাহেবাদের খেয়াল রাখবার জন্য শুকরিয়া।
ইমাম সাহেব চট করে আমার দুহাত চেপে বললেন। গলায় স্পষ্ট আন্তরিকতা।
– ওদের, মানে, ওনাদের নিয়ে যাচ্ছেন?
ঘাড় ঘুরিয়ে নারীযুগলের দিকে তাকালাম। বাসায় ফেরার পর থেকে ওরা একদম চুপচাপ।
– জ্বী, আপনাকে এত ঝামেলা পোহাতে হল, অনেক শুকরিয়া সংগঠনের পক্ষ থেকে।
আমার কাঁধে হাত বুলিয়ে দিয়ে ইশারা করলেন নারীদের। ওরা ব্যাগ-ট্যাগ নিয়ে রেডী। দ্রুত রুম ছেড়ে বেরিয়ে গেল।
– আপনাদের এগিয়ে দেব?
সোহানী-চাঁদনী আমার সঙ্গে চোখাচোখিও করছেনা। ওদের যে গুডবাই-টাই কিছু বলব সেটাও সংকোচ হচ্ছে।
– নিচে ছেলেপেলে আছে, আমাদের রিকশায় তুলে দেবে। আপনি আরাম করেন।
ইমাম সাহেবও বেরোলেন। বোরকাওয়ালীরা নামতে শুরু করেছে সিঁড়ি বেয়ে।
– ওনাদের কি বাসায় পাঠিয়ে দিচ্ছেন? দানিয়েল ভাইরা ব্যাক করেছে?
– না, এখনো ফিরেনি, ফিরবে শিঘ্রী।
এক মুহুর্ত ভেবে জবাব দেয় ইমাম।
– আচ্ছা, আসি ভাই। মাগরিবের টাইম হয়ে যাচ্ছে। জামাত পড়াতে হবে তো।
বলে হন্তদন্ত হয়ে নেমে যায় ইমাম। আর কিছু বলার সুযোগ দেয়না।
গায়ের ঘাম-ধুলাবালি শাওয়ারের স্রোতে যত পরিষ্কার হচ্ছে, মনে মনে অস্বস্তি তত বাড়ছে।
ক’দিন তো খুব বিরক্ত হয়েছি, এখন ‘আপদ-বিপদ’ বিদায় হওয়ায় খুশি হবার কথা। তা না হয়ে ফাঁকা রুমটা মনে শূণ্যতা তৈরি করছে।
আজ রাতে ছোট বিছানাটায় আরাম করে হাত-পা ছড়িয়ে শুতে পারব আবার। খুশি হবার কথা, কিন্ত একজোড়া নারীর মাঝে জড়োসড়ো হয়ে ঘুমানোর অনুভূতিটাকে এখন তুলনামূলক বেশি আপন মনে হচ্ছে।
রাতে ঘুমানোর আগে ইতস্তত করে সোহানীর নাম্বারে দুবার রিং করলাম। ফোন বাজলেও ধরছেনা। ওরা কোথায় আছে জানতে পারলে ভাল লাগত। তবে আমাকে এখন জানানোয় নিষেধ আছে ধারণা করলাম।
আমার বাসা থেকে চাদনী-সোহানীর তড়িঘড়ি বিদায়ের পর ওদের কোন খবর পাইনি পুরো সপ্তাহজুড়ে। দানিয়েল ভাইদের ফেরার আগ পর্যন্ত কারো সঙ্গে কোনরুপ যোগাযোগ-ই ছিলনা।
আট-নদিন পর যোহরের সময় মসজিদে দানিয়েল ভাইয়ের সঙ্গে দেখা। নামাজের পর উনি তো আমাকে জড়িয়ে ধরে আবেগী হয়ে গেলেন।
– ভাই, বেশি কোশ্চেন করোনা, বলা নিষেধ আছে।
কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই বললেন।
– ঠিক আছে, ঠিক আছে। আপনি সুস্থ আছেন তো?
– হ্যাঁ ভাই, কোন সমস্যা হয়নি। পুলিশি ঝামেলা শেষ হয়েছে। আজ সকালেই ফিরেছি।
– বাবুল ভাই?
– সবাই ব্যাক করেছে। সবাই ভাল আছে। তোমাকে যে কিভাবে থ্যাংকস দেবো, আমাদের এই বিপদের সময়ে রিস্ক নিয়ে হেল্প করলে..
– কি যে বলেন ভাই, আমার পজিশনে থাকলে আপনারাও হেল্প করতেন। তা, ভাবীরা ফিরেছে?
এই প্রথম কাওকে জিজ্ঞেস করার সুযোগ পেলাম।
– অনেকে ফিরেছে। আজ-কালের মধ্যে সবাইকে নিয়ে আসবে।
– সোহানী ভাবী, চাঁদনী ভাবী?
– ওরা একটু দূরে আছে মেইবি, দু-তিনদিনে ফিরবে।
শুনে একটু গিল্টি ফীল হচ্ছিল। বললাম,
– স্যরি ভাই, আমি ইমাম সাহেবকে বিরক্ত করায় ভাবীদের দৌড়াদৌড়ি করতে হয়েছে।
– আহা, কি বলো.. যখন ইমার্জেন্সী ছিল তখন যে দায়িত্বটা নিয়েছো, সেটাই তো বড়। খবর নিয়েছি, ওরা ভাল আছে। বাবুল ভাই তো ফিরেই অফিস করছে, এশার সময় পাবে ওনাকে। আমি আজ রেস্ট করছি।
রাতে বাবুল ভাইও বেশ ইমোশনালভাবে ধন্যবাদ দিচ্ছিলেন। এমনিতে খুব একটা ইমোশন দেখানোর লোক না উনি। এমন একটা ঝাপটা যাবার পর ওনার দিলও নরম হয়েছে।
বাবুল ভাইয়ের কাছে এডিশনাল তথ্য এটুকু পাওয়া গেল, বিকেলে মওলানা সাহেবের মুক্তি মিলেছে। যতটুকু ধারণা, মামলাটা আপাতত হিমাগারে থাকবে।















কমিউনিটি সার্ভিস (১৮+)Where stories live. Discover now