সে দিনটাও ছিলো অষ্টমীর দিন। সকাল সকাল স্নান সেরে কামেশ্বরের দেওয়া শাড়ীটা পড়েই অঞ্জলি দিতে গেলো মীনা। ছোটো ভাইয়ের হাত দিয়ে লুকিয়ে মাও একটা শাড়ী পাঠিয়েছিলো। বেশ দামীই শাড়িটা। কি মনে হতে কামুর দেওয়া সাদামাটা লালপেড়ে তাঁতের শাড়িটা পড়েই কামুর বউদি দীপার সঙ্গে মন্ডপে পৌঁছলো। মন্ডপের বাইরেই দাড়িয়ে তিন আঙ্গুলের ফাঁকে গুঁজে গাঁজা টানার ভঙ্গীতে সিগারেট টানতে টানতে আরো দু’চারজনের সঙ্গে গল্প করছিলো কামু। চোখাচুখি হতেই চোখ সরিয়ে নিলো। তার দেওয়া শাড়ীটা পড়েছে বলে খুশী হলো কি? বোঝা গেলো না। বোঝা যায়ও না। কোনো অভিব্যক্তি নেই লোকটার মধ্যে। কেমন রসকষবিহীন, নির্লিপ্ত। অথচ কর্তব্যজ্ঞান ষোলোআনা। তার প্রতি, বিধবা দীপা বৌদির প্রতি। মীনার দিকে তাকিয়ে সরাসরি কোনো কথা বলে না। হয় দীপা বৌদির মাধ্যমে, “বৌদি, ওনাকে বলো, তাড়াতাড়ি তৈরী হয়ে নিতে। কোর্টে যেতে হবে।“, অথবা ভাববাচ্যে, “এবার তাহলে বেরোনো যাক।“
তাকে দেখেই মন্ডপে উপস্থিত ‘আট থেকে আশী’ মহিলাদের গুজগুজ ফিসফিস শুরু হয়ে গেলো। সে এমন মেয়ে, যাকে বাপের বাড়ীতেও তোলে না, স্বামী বলে যাকে পরিচয় দেয় (বিয়ে হয়েছে কিনা ভগবানই জানে), সে রাষ্ট্রদোহীতার দায়ে জেলে পচছে; শ্বশুরবাড়ী স্বীকার করে না। স্বামীর বন্ধু এক মিলিটারির রক্ষিতা হয়ে আছে (হ্যাঁ, এটাই ছোট্ট শহরটায় গুঞ্জন) । পুষ্পাঞ্জলির ফুল নেওয়ার জন্য এগিয়ে যেতেই, প্রত্যাখ্যাতা হলো সে। পুরোহিত রাম ভশ্চায্যি বিড়বিড় করে কি সব বলতে বলতে, চোখ পাকিয়ে ফিরিয়ে দিলেন তাকে। চোখের জল চেপে মন্ডপের বাইরে এসে দাড়ালো সে। দীপাবৌদি ফুল পেয়েছিলো, কিন্তু তা ফিরিয়ে দিয়ে, বাইরে এসে কামুকে কি যেনো বললো।
এরপরই একটা বলিষ্ঠ হাত চেপে ধরলো মীনার বাজু। হিড়হিড় করে টেনে তাকে দাড় করিয়ে দিলো মূর্তির একদম সামনে। রাম পুরোহিতকে ইশারা করলো অঞ্জলির ফুল দিতে। একটু ইতঃস্তত করেছিলো রাম ভশ্চায্যি। একটা চাপা গলা মাইক্রোফোনে ভেসে উঠলো, “দাঁতগুলো খুলে অঞ্জলি দিয়ে দেবো”। সারা মন্ডপের আওয়াজ এক লহমায় থেমে গেলো। আর কথা বাড়াতে সাহস পাননি পাঁচ ফুট দুই ইঞ্চির পুরুত মশাই। কাঁপা কাঁপা হাতে ফুল বিলি করে, কাঁপা কাঁপা গলায় মন্ত্র উচ্চারণ শুরু করলেন।
**********************************************************************************************************************************
বাড়ীতে ফিরেই কাপড়জামা না ছেড়ে বিছানায় মুখ লুকিয়ে অঝোর ধারায় কাঁদতে শুরু করে মীনা। ভালবাসার এ কি দাম দিলো মীনা! নিজের জীবনটাই নষ্ট করে ফেললো। তার এবং বিপ্লবের ভালবাসার ফসল, যে তার পেটে বাড়ছিলো, ভ্রুণেই নষ্ট হলো। না তার বাড়ী, না বিপ্লবের বাড়ী, না এই ছোট শহরের সমাজ, কেউ তাদের সম্পর্কটাকে স্বীকার করবে না। সমাজের কাছে সম্পূর্ণ ব্রাত্য হয়ে স্বামীর বন্ধুর আশ্রিতা (লোকের ধারণা রক্ষিতা) হয়ে বাঁচবে কি করে? কামু যদি তাকে তার জ্যেঠতুতো দাদার বাড়ীতে না আশ্রয় দিতো, রাস্তায় দাড়াতে হতো তাকে। জঙ্গলে আন্নাবুড়ীর কাছ থেকে তাকে নিয়ে আসার পর পক্ষীমাতার মতো সামলেছে তাকে কামু। কোনো সামাজিক সংস্কারের তোয়াক্কা না করে।
দীপাবৌদিও তাকে সহজ মনেই গ্রহণ করেছে; হয়তো বা কামেশ্বরের প্রতি কৃতজ্ঞতাবশতঃই। অল্প বয়সে বিধবা হবার পর, দেওর-ভাসুররা যখন তাকে স্বামীর সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করার চেষ্টা করেছিলো, কেউ কেউ আবার উপকার করার অছিলায়, তার কচি বিধবা শরীরের স্বাদ নিতে চেষ্টা করেছিলো, তখনো রুখে দাড়িয়েছিলো এই ছ’ ফিট তিন ইঞ্চি বিশালস্কন্ধী পুরুষটি। লাঠালাঠি-মামলা-মোকদ্দমা সব কিছুতেই পাশে দাড়িয়ে সম্পত্তির অংশ এবং তারর স্বামীর অফিসের পাওনা টাকা পাইয়ে দিতে সমর্থ হয়েছিলো। পড়াশুনা বিশেষ একটা জানতো না দীপা। স্বামীর অফিসে চাকরির আশা ছেড়ে, তাই একটা সেলাই মেশিন কিনে বাড়ীতেই সেলাই-ফোঁড়াইয়ের কাজ শুরু করে দীপা। প্রথম প্রথম কাজ জুটিয়ে দিতো কামু। আজকাল প্রচুর অর্ডার পায় সে। মীনা এবং আরো একটি মেয়ে তাকে সাহায্য করে।
বিপ্লব কি আদৌ কোনোদিনও জেল থেকে ছাড়া পাবে? তাদের পার্টি সম্পূর্ণভাবে ভেঙ্গে গেছে। ধরা পড়ে গেছেন দলের সভাপতি কমঃ মণিকন্দন সহ সকল প্রথম সারির নেতা। পার্টি থেকে যে উকিল লড়ছিলেন বিপ্লব, শেখর, মাহী সহ অন্যান্য কমরেডদের পক্ষে, তিনিও পিছিয়ে গেছেন। Section 12a, Section 121A, Section 122, Section 124-A সহ একগাদা ধারায় রাষ্ট্রবিরোধীতা, রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার্থে অস্ত্র সংগ্রহ সহ একগাদা বিপদ্জনক অভিযোগ আনা হয়েছে তাঁদের বিরুদ্ধে। ছাড়া পাওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। বিপ্লবের সমর্থনে লড়ার জন্য কামেশ্বর একজন উকিল দাঁড় করিয়েছে, কিন্তু তিনিও কোনো আশা দিতে পারছেন না।
একনাগাড়ে কেঁদে যাচ্ছিলো মীনা। যেন চোখের জল দিয়েই, সে তার জীবনের দুঃখগুলো মুছে ফেলতে চায়। হঠাৎ পিঠে একটা হাতের স্পর্শ পেতেই, মুখ ঘুরিয়ে তাকায় সে। জানলা বন্ধ, দরজা ভেজানো, জানলার পাল্লার কোনো এক ফাঁক দিয়ে, একটা রশ্মি এসে পড়েছে বাদামী কঠিন মুখের উপরে। ধড়মড় করে উঠে বসলো মীনা। আঁচলটা ঠিক করার আগেই, শরীরটা ঝুঁকিয়ে তার চোখের জল জিভ দিয়ে চেটে নিলো সেই বলিষ্ঠ পুরুষ। খুব দুর্বল হয়ে পড়লো মীনা। এইটুকু আদরই সে বহুদিন পায় নি। মরুভুমির শুস্ক বালুপ্রান্তরে শীতল বারিসিঞ্চন করলো কেউ। বসে থাকা অবস্থায় দীর্ঘকায় লোকটার কোমরের কাছে পড়ে সে। মাথা ঘষতে লাগলো তার কটিদেশে। চোখের জল আর বাঁধা মানছে না। ভিজিয়ে দিচ্ছে আপাতকঠিন মানুষটার তলপেট। পাঞ্জাবীর দুই হাত খামচে, নামালো তার মুখ। ঠোঁটজোড়া খুঁজে নিলো তার আশ্রয়। দু হাতে আঁকড়ে ধরলো তার শেষ অবলম্বন।