সিপাহী-বাবা ও ফকীহ-ছেলে

2 0 0
                                    


একবার ফররুখ আবু আব্দুর রহমান বনী উমাইয়ার শাসনামলে খোরাসানে যুদ্ধ অভিযানে (জিহাদ) বের হল, ছেলে রবীয়া তখনও তার মায়ের পেটে। যাওয়ার আগে সে নিজের বিবির কাছে ত্রিশ হাজার দিনার রেখে গেল।

সেই ফররুখ এল ফিরে প্রাণের শহর মদীনায়, তবে দীর্ঘ সাতাশ বছর পর। ঘোড়সওয়ার হয়ে, হাতে শোভা পাচ্ছে একটা চোখা ও ধারালো নেযা। ঘোড়া থেকে নেমে নেযাটা দিয়ে সেই নিজের চিরচেনা বাড়ির দরজা টোকালেন, ছেলে রবীয়া দরজা খুলল। সে রবীয়াকে দেখে বলে উঠল,

'অই আল্লাহর দুশমন! তুই আমার ঘরে হানা দিয়েছিস তাহলে?'

জবাব এল, 'না।'

আবার সে তেজ গলায় বলে উঠল, 'এই খোদার দুশমন! তুই আমার বিবির সাথে সময় কাটাস!'

বলতে বলতে দুইজন একে অপরের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে ধস্তাধস্তি, ঘাড় ধরাধরি শুরু হয়ে গেল, পাড়াপড়শিরা এসে পড়ল। মশহুর তাবেয়ী মালিক বিন আনাসের কানে খবরটা পৌঁছালে আরও সাথিদের সাথে নিয়ে রবীয়াকে মদদ করতে আসলেন। মারামারি ঠেকানোর পর রবীয়া বলল, 'কসম আল্লাহর! ফয়সালা বাদশার কাছে গিয়ে হবে।'

ফররুখও একই কথা বলল, সাথে 'আমার বিবির সাথে থাকিস!' কথাটা যুক্ত করে।

শোরগোল বেড়েই চলছে, লোকে হচ্ছে লোকারণ্য। জনতা মালিক বিন আনাসকে দেখে খামোশ হল। মালিক তাকে বললেন,

'জনাব! আসুন, আপনার জন্য অন্য ঘরে জায়গা আছে।'

সে বলল, 'আরে, এটা আমার বাড়ি। আমি ফররুখ, অমুকের ছেলের গোলাম।'

তার বিবি শুনে বের হয়ে এসে বলল,

'ইনি আমার সাহেব, আর সে আপনার রেখে যাওয়া বেটা, যাকে আমি গর্ভধারণ করেছি।'

অতঃপর উভয় উভয়কে জড়িয়ে কাঁদল। ফররুখ ঘরে ঢুকে বিবিকে জিজ্ঞেস করল,

'এটা আমার ছেলে?'

'জ্বি হ্যাঁ।'

'এবার তোমার কাছে সেই রেখে যাওয়া দিনারটা বের কর, আর এইযে রাখ সাথে আরও চল্লিশ হাজার দিনার।'

'ঐ ত্রিশ হাজার এক জায়গায় পুঁতে রাখছি, কয়েকদিন পর বের করব।'

'আচ্ছা।'

রবীয়া মসজিদের পানে রওয়ানা হলেন, এসে বসে পরলেন সেই চিরচেনা এলমী মজলিসে*। হাজির হলেন মালিক বিন আনাস, হাসান বিন যায়েদ, ইবনে আবু আলী আল-লাহাবী, মাসাহিক্বি সহ মদীনা শহরের যত জ্ঞানী-গুণী আশরাফ ব্যক্তিবর্গ। এদিকে ফররুখের বিবি বলল,

'যাও, নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মসজিদে (মসজিদে নববী) নামাজ আদায় করে আস।'

ব্যাস, সে নামাজ পড়ল সেখানে। নামাজ শেষে তার নজরে এল এক ভরপুর মজলিস। মজলিসের কাছে এসে দাঁড়ালে লোকজন একটু জায়গা ছেড়ে দিল। রবীয়া মাথা ঘুরিয়ে নিল, সে মনে করল যে তাকে দেখেনি। ফররুখের দিলে সন্দেহ জেঁকে বসল, জিজ্ঞেস করল,

'ইনি কে?'

লোকজন জবাব দিল, 'ইনি রবীয়া বিন আবু আব্দুর রহমান।' (অর্থাৎ আবু আব্দুর রহমানের ছেলে রবীয়া)

'বিন আবু আব্দুর রহমান! আল্লাহ পাক আমার ছেলের ইজ্জত এত ওপরে দিয়েছে!'

খুশির জোড়ে বাড়ি গিয়ে রবীয়ার মাকে বলল,

'ওরে আল্লাহ! তোমার ছেলের যে ইজ্জত ও কদরদানি দেখলাম জিন্দেগিতে কোনদিনও কোন আলিম বা ফকীহের* এমন ইজ্জত দেখি নাই।'

রবীয়ার মায়ের জবাব, 'এবার বলো, কোনটা তুমি চাও, ত্রিশ হাজার দিনার নাকি নাকি এমন ইজ্জত ও শান?'

'এইটাই চাই, আল্লাহর কসম।'

'তাহলে শুনে রাখ, আমি ওই তামাম ত্রিশ হাজার দিনার ওঁর পিছনে খরচ করছি।'

'হায় আল্লাহ! করছ কি তুমি!'


--------------------------------------------------------------------------------------------------

*এলমী মজলিস হচ্ছে মসজিদে অনুষ্ঠিত এক কিসিমের পাঠশালা। এখানে সেরা আলেমরা আসেন এবং মানুষ তাদের থেকে বিভিন্ন ধরণের এলেম শেখে। সাধারণত এটা মসজিদে হয়, আবার মসজিদ ছাড়া অন্য স্থানেও হয়। একে 'এলমী হালাকাহ'ও বলে। 

*ফকীহ বলা হয় ইসলামী আইনশাস্ত্রবিদকে। যিনি আল্লাহর দেয়া সব হুকুম – রাষ্ট্রীয় থেকে শুরু করে ব্যক্তিগত – মানুষদের জানান এবং মানুষরাও রোজানা জিন্দেগি আল্লাহর হুকুমে রঙিন করার জন্য তাঁর শরণাপন্ন হয়।



(সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নদভী রহ. এর কেতাব আল-কেরাতুর রাশেদার ৩য় জেলদ থেকে অনূদিত)

তথ্যসূত্র: তারিখে বাগদাদ, খতীবে বাগদাদী রহ. ৮ম জিলদ, ৪২১-৪২২ পৃষ্ঠা।


তরজমাশালাDonde viven las historias. Descúbrelo ahora