সকাল কখন হয়েছে তা আমি টের পাইনি।ঘুম ভাঙলো ফোনের রিংটোন শুনে।তাকিয়ে দেখি ঝুমের বাবা মানে আমার বড় ছেলে কল দিয়েছে।আমি তাড়াতাড়ি কলটা রিসিভ করলাম।রিসিভ করতেই হাসানের গলা শোনা গেল।
-কেমন আছো মা?
-আছি মোটামুটি।তুমি?
-ভালো নেই মা আমি।
-কেন?
-কারনটা একটু পরে বলি।তার আগে অন্য কিছু কথা বলি।তোমার সম্মতি আছে?
-হুম।
-আমার জীবনে দুজন নারী সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ।একজন হলো তুমি, যে অনেক কষ্ট করে আমাকে জন্ম দিয়েছে।আর আরেকজন হলো আমার স্ত্রী, যে অনেক কষ্ট করে আমার তৃষাকে জন্ম দিয়েছে।
-হুম।
-আমি এখানে দুজন নারীর কথা বললেও আরেকজনের কথাও যে আমি খুব গুরুত্বের সাথে বলেছি সেটা নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছো।সেই আরেকজন হলো আমার মেয়ে তৃষা।কেননা আমার স্ত্রী আমার কাছে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ তৃষার মতো একটা মেয়েকে আমাকে উপহার দেওয়ার জন্যে।তুমি আমার কথা শুনতে পাচ্ছো মা?
-হুম।
-মা, তৃষা আমার জীবনে কতটুকু গুরুত্বপূর্ণ সেটা বুঝানোর জন্য আমি তোমাকে ছোট্ট একটা ঘটনা বলি।ও যখন সিক্সথ গ্রেডে পড়ে তখন সিঁড়ি দিয়ে নামতে গিয়ে ওর পায়ের শিরা ছিঁড়ে যায়।ব্যাপারটা এতটা জঘন্যভাবে হয়েছিল যে এতে ডক্টররা ধারনা করেছিল ও আর কোনোদিন হাটতে পারবে না।কিছু যদি এক্ষত্রে হতে পারে তা হলো মিরাকল।তুমি তো জানো মা আমি একদমই ধার্মিক নই।অথচ ঠিক সেই দিন থেকে টানা আমি প্রায় তিনমাস বাড়ির বাইরে যাই নি।ঘরে থেকে শুধু নামাজ পড়ে গিয়েছি।ওপরওয়ালার কাছে শুধু প্রার্থনা করে গেছি যেন আমার বদলে হলেও ও যেন সুস্থ হয়।তিনমাস পড়ে যখন ওর পায়ের ব্যান্ডেজ খোলা হয় সেদিন দেখা যায় ও ঠিক হাটতে পারছে।আমি সেই সারাদিন আর ওর সামনে যাই নি।শুধু কেঁদেই গিয়েছি।ওই তিন মাসে আমার কোম্পানি ঊনসত্তর লাখ টাকা লস করেছিল।তুমি কি বুঝতে পারছো মা আমার কথা?
-হুম।
-শোনো মা! আমি তোমার সবচেয়ে আদরের ছেলে।তুমি তোমার জীবনের চেয়েও আমায় বেশি ভালোবাসো।ঠিক?
-ঠিক।
-তবে তুমি কি করে এটা বুঝতে পারো না আমার কাছেও খুব স্বাভাবিকভাবেই তৃষা ঠিক ওভাবেই দামী হবে?এমনকি তৃষা আমার কাছে আরো বেশি দামী, কারন ওর জন্মের কথা তুমি জানো।
-হুম।
-শোনো মা, তুমি তৃষাকে রেগে গিয়ে যা নয় তা বলেছো কিন্তু একটা কথা শুনে নাও মা এটার অধিকার তোমার নেই।তুমি রেগে গিয়ে আমাকে যা খুশি বলতে পারো কারন আমি তোমার ছেলে।কিন্তু তৃষাকে তোমার বলাটা যুক্তিযুক্ত নয়।তৃষাকে যে অতীতের কথা তুমি মনে করিয়ে দিয়েছো সেই কথা আমিও ওকে বহুবার মনে করিয়ে দিয়েছি।আমার মুখ থেকে ওই কথা শুনে ও অল্প সময়ের জন্য মন খারাপ করে।কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই ও স্বাভাবিক হয়ে আমার সাথে সেই আগের মতো আচরন করতে শুরু করে।কিন্তু তুমি এ কথা বলতে পারো না মা।আর ওভাবে তো নয়ই যেভাবে তুমি বলেছো।এবার কি বুঝতে পেরেছো আমার মন খারাপ করার কারন?
-হুম।
-তুমি আমাকে নিয়ে অহংকার করতে পছন্দ কর।কিন্তু তোমার অহংকারের মাত্রা বর্তমানে এতটা বেড়ে গেছে যে অন্য যে কাউকে যখন তুমি আমার কাছে তোমার চেয়ে বেশি গুরুত্ব পেতে দেখো তখন তোমার স্বার্থে আঘাত লাগে।অথচ মা তুমি কি ভেবে দেখেছো তোমার এই চিন্তাটা কতটা নিম্নমানের? আমার কথা শুনতে পাচ্ছো?
-হুম।
-যাই হোক, অনেক কথা বলে ফেলেছি।আসল কথাটা বলি।তৃষা আজ সকালেই তোমাদের বাড়ি থেকে চলে গেছে।আর আজকের পর থেকে ও আর কোনোদিন তোমাদের বাড়িতে যাবে না।
-কি বলছ এসব!?
-ভয় নেই মা।আমি যেহেতু তোমার ছেলে তাই আমার পক্ষে তোমাকে ত্যাগ করা সম্ভব না।আমি তোমাদের বাড়িতে যাব, তৃষার মা ও যাবে।কিন্তু তৃষা কখনো যাবে না।
-এটা তোমার সিদ্ধান্ত?
-হ্যাঁ।আরেকটা কথা! তুমি যদি ভেবে থাক এসব কথা তৃষা বলেছে তবে ভুল ভাবছো।এসব কথা আমাকে বাবা জানিয়েছে।ভালো থেকো মা।অনেক কথা বলেছি।কিছু মনে করো না।
আমাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে হাসান কল কেটে দিল।আমি কিছুক্ষণ ঝিম মেরে চেয়ারে বসে রইলাম।তারপর উঠে দাঁড়িয়ে জিনিসপত্র গুছিয়ে ট্যাক্সি ভাড়া করে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম।