পর্ব ১৮

576 31 5
                                    

ফাহমিদা হু হু করে কাঁদছেন | নাহার একবার কি যেন বলতে গিয়েও বললেন না |
আকবর নাহারের ঘরে এসে ফাহমিদাকে দেখে ভ্রূ কুঁচকে বিরক্তির সাথে বলল, "তুই আবার কি বলছিস !"
নাফি একপাশে বসে 'উমমম' করে জাম্বুরা মাখানো খাচ্ছে |
আকবর চিৎকার করে বলল, "তোদের কোন হিসাব আমি বুঝিনা ! কি চাস কি তোরা হ্যা ? আমার লেগে কি করেছিস কোনদিন তোরা ? বল ? কি দিয়েছিস কখন আমাকে ?"
ফাহমিদা কেঁদে হিচকি তুলে বললেন, "আমি কি দেইনি কিছু রে তোকে ? তোর যখন যা লেগেছে আমি দিয়েছি | তোর যা সাহায্য যখন দরকার তুই চেয়েছিস আমি আমার সাধ্যমত করেছি ! আমার গতরে খেটে তোর মেহমানদারী করেছি | আমি কিছুই করিনি ?"
আকবর মুখটা বেকিয়ে ভেঙ্গিয়ে বলল, "কত করেছিস ! সবার জন্য কাড়ি কাড়ি জিনিস ঢেলেছিস ! আমার বেলাতেই শেষ সব !"
"আল্লাহ নারাজ হবে এই কথা বলিস না ! তোর বিয়ের সময় আমি আমার আলিজার জন্য রাখা এক ভরি চারানার কানের দুলটা তোর বৌকে দিয়ে দিয়েছি | তোর শালীর বিয়েতে ছয় আনার সোনামুক্তার হার কিনে দিয়েছি | তুই এভাবে অস্বীকার করছিস !"
আকবর যেন রাগে ফেটে পড়ল, একেবারে গর্জনকরে বলল, "এই বালছাল চারটি দিয়ে আজকে হিসেবে নিতে বসেছিস ! আসলেই নিমকহারাম সব ! বছরবছর ভাড়া মেরে বসে খেয়ে এখন তো এসবই বলবি ! বেঈমান কোথাকার !"
আকবর উঠে যেতে গেল, ফাহমিদা তার হাতটা চেপে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে বলল, "ভাইরে তোর কাছে জোড়হাত করছি এতবড় সর্বনাশ আমার করিস না | ভাই আমার অনেক কষ্টের জিনিস !"
আকবর একটা ঝটকা মেরে ফাহমিদাকে ফেলে দিয়ে দাঁত খিচিয়ে বলল, "কোনদিন কোন দরকার হলে বলিস আমাকে ! থু মারবো মুখে ঐদিন ! বেঈমান বাটপার !"
আকবর গেলে ফাহমিদা পিছন পিছন কেঁদে কেঁদে গেলেন কিন্তু আকবর তাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিয়ে দরজা বন্ধ করে দিল নিজের ঘরের |
ফাহমিদা থতমত খেয়ে ফিরত এসে ধীরে ধীরে নাফির কাছে গেল, তার হাতধরে বসে বলল, "বোনরে এতবড় ক্ষতি করিসনা আমার | আমি পথে বসে যাবো |"
নাফি "আঃহা " বলে বিরক্তিতে হাত সরিয়ে নিল |
ফাহমিদা তাকে গায়ে হাত বুলিয়ে দোয়াতে লাগলেন, বললেন, "আমি যা পারি দেব তোকে ! দিয়ে দে বোন !"
নাফি তার হাতের জাম্বুরা মাখানোর গামলাটা ছুড়ে ফেলে দিয়ে একটা হুংকার করে বলল, "কি শুরু করেছিস হ্যা ! নকশা না ? জানিনা আমি !"
ফাহমিদা ফুঁপিয়ে উঠে বললেন, "যা বলিস বল বোন দিয়ে দে ! আমার অনেক কষ্টের জিনিস |"
"নেই আমার কাছে | আর থাকলেও দিতাম না | কেন দিতাম ? কি করেছিস আমাদের জন্য তুই ? পাশের বাড়ির সাইদা আপাকে দেখ ! বোনের বিয়েতে প্রায় সত্তরহাজার টাকা দিলো | আর তুই ? বসে বসে মাগনা থাকিস এই বাড়িতে চোখের লজ্জা করেও পঞ্চাশটা হাজার টাকাও বের করলিনা ! লজ্জা করেনা ? এত নির্লজ্জ হোলি কেমন করে ? ওই ফকির ব্যাটার ঘর করে ওই বাটপারের মত ছোটলোক হয়েছিস |"
ফাহমিদা হতবিহ্বল হয়ে বলল, "আমার নেই আমি কোথেকে দেব তোকে ?"
"নেই ? বাটপার ! ছেলে লাখটাকার ওপরে বেতন পায়, ফ্লাট কিনছে, আর মেয়ে আমেরিকায় থেকে কামাই করে টাকা পাঠায় তোর পয়সা নেই ? বাটপাড়িও করিস ভালো !"
নাফিসা দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেল, ফাহমিদা নাহারের দিকে চেয়ে অশ্রুসিক্ত অসহায় চোখে চেয়ে বলল, "মা তুমি অন্তত কিছু বলো মা ? আমার এতবড় সর্বনাশ করোনা মা |"
নাহার নিরাসক্ত চোখে চেয়ে বললেন, "আমি জানিনা বাবা | তোরা জানিস | আমি না জেনে কাকে কি বলবো |"
ফাহমিদা হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন | তার যেন কোন জ্ঞান রইলোনা কোন কিছুর |
কামরান এসে ঘরে ঢুকে ফাহমিদাকে দেখে মুখ বিকৃতকরে বলল, "তুই হেনে কি করছ রোইজ রোইজ ! তোর পোলায় না ফেলাড কিনছে তোরা হোনে যাচনা কেলা ! সালা বান্দী তো বান্দী !"
ফাহমিদা একবার আকবরের ঘরের দিকে একবার নাফিসার দিকে আর একবার নাহার আর কামরানের দিকে চেয়ে ধীরপায়ে যেতে যেতে বলল, "মাগো তোমার জন্য আমি কিনা করেছি আর আজকে তুমি এমন করলে আমার সাথে ! আমার অন্যায়ের শাস্তি আল্লাহ আমায় দিলো ! মনে রাখিস তোরা, এই অন্যায় আল্লাহ মাফ করবে না |"
ফাহমিদা ঘর থেকে বেরুতেই কামরান এসে তার মুখের উপর দরজা লাগিয়ে দিল |
ফাহমিদা কয়েকটা সিঁড়ি উঠে দেখলেন তিনি ঘরের চাবি ফেলে এসেছেন | আবার ফিরে গেলেন | ফাহমিদা প্রায় ঘন্টাখানেক দরজা নক করলেন কিন্তু কেউ খুলল না | তিনি চুপচাপ এসে সিঁড়িতে বসলেন |
বিপ্লব কলেজ থেকে ফিরে তাকে সিঁড়িতে বসে থাকতে দেখে বলল, "খালামনি এহেনে বইসেন কেরে ?"
ফাহমিদা তাকে বললেন, "আব্বারে আমার ঘরের চাবিটা একটু নানুর ঘর থেকে এনে দিবি রে ?'' বলে কেঁদে ফেললেন |
বিপ্লব দ্রুত ভেতরে গেল |
মিনিটের মধ্যেই বুয়া চাবি এনে ফাহমিদার হাতে দিয়ে বলল, "খালাম্মার তরকারি দিয়া যাইয়েন | হেয় ভাত খাইবো |"
ফাহমিদা কোনরকমে বলল, "আসো | নিয়ে যাও |"
বুয়া একেবারে ঝাঁঝিয়ে বলল, "আমি সিঁড়ি বামুনা | আমার আটুট দরদ করে | আন্নে দিয়া যাইয়েন |"
ফাহমিদা ধীর পায়ে উপরে চলে গেলেন | বুয়া এমন করবেই | কারণ এটা আমাদের দেশীয় রীতি "বড়লোকের কুকুরও বড়লোকি করে !" | নাহার আর নাফির তার মেয়ে ও বোনের প্রতি এই ব্যবহার দেখেই বুয়া সেই মোতাবেক এমন করে |

মেঘের আলোয়Where stories live. Discover now