আইলান মাহিরার দিকে তাকিয়ে বলল, "আজকে তোমাকে খুবই সুন্দর লাগছে মাহি !"
মাহিরা স্বামীর দিকে ফিরে তাকিয়ে কৃত্রিম রোষের সাথে বলল, "শুধু আজই ? তার মানে আর কখনও সুন্দর লাগেনা ?" আইলান একটু হেসে বলল, "তোমাকে সবসময়ই সুন্দর লাগে মাহি | কিন্তু আজ অনেক বেশিই সুন্দর লাগছে |"
মাহিরা লাজুক হেসে বলল, "সত্যি ?"
আইলান উঠে এসে মাহিরার কপালে একটা চুমু দিয়ে বলল, "তুমি আমার অধীশ্বরী ! তোমাকে কিকরে মিথ্যা বলি ?"
মাহিরা হেসে বলল, "থাক হয়েছে ! আমাকে আর ভুলভাল কবিতা শোনাতে হবে না !"
আইলান হাসল |
মাহিরা কানে দুল পড়তে পড়তে বলল, "দুজনের দুই অদ্ভুত কথা ! একজন বৌকে 'রাজহংসী' বানিয়েছে আর আরেকজন এখন 'অধীশ্বরী' !"
আইলান হেসে বলল, "মন্দ কি !"
মাহিরা একটু ইতস্তত করে বলল, "একটা কথা বলব তোমাকে আইলান ?"
"বলো মাহি |"
"আইলান জানো আমার না একটা কথা ইদানিং প্রায়ই মনে হয় |"
আইলান মাহিরার মুখে এটুকু শুনেই অসন্তোষের সাথে বলল, "মাহি প্লিজ ! কোন নেগেটিভ কথা নয় | দ্যাখো আমি জানি যে প্রতিটা এক্সপেক্টিং মা-ই খুব চিন্তিত থাকে তার সন্তানের সঠিকভাবে ভূমিষ্ঠ হওয়া নিয়ে | তাই তুমিও ব্যতিক্রম নও | কিন্তু প্লিজ ওসব বলো না ! একবার আলিজার অভিজ্ঞতাই আমার যথেষ্ট ! এইব্রাহামের জন্মের সময় ও 'আমি বোধহয় বাঁচবোনা' বলত আর পরে ও যে কষ্টটা পেয়েছে তা মনে হলেই আমার এখনও আত্মা কেঁপে ওঠে | আমি তোমার ওপরও একই কষ্ট দেখতে কোনদিন পারব না ! আল্লাহ না করুক ওর বা তোমার আর কারোরই যেন এই কষ্ট আর কোনদিন না হয় !"
"হুম | ওর এই অসম্ভব কষ্টের কথা ভেবেই বোধহয় এরিক আর সন্তান নিতে চায়না !"
আইলান অবাক হয়ে বলল, "তাই নাকি ? কবে বলল একথা ?"
"ওরা দেশে আসার কয়েকদিন পরেই আমি কথার ছলে জিজ্ঞাসা করি তখন বলল যে ওর ভয় হয় | ওর লিজের একবারেই যে কষ্ট দেখেছে ও, সেরকম কিছু ও আর কোনদিন দেখতে চায়না ! এমনকি আংকেল রজারও খুব একটা আগ্রহী না | সেও ভয় করে যে যদি আবার আলিজার কিছু হয় |"
"অবশ্য এরিককে একদমই দোষ দেইনা আমি | যে অবস্থা হয়েছিল আলিজার তাতে ও যে আবার সে অবস্থা কাটিয়ে ফিরে এসেছে সেটা সত্যি আল্লাহর মেহেরবানী | আর সেজন্যই বলি আল্লাহ না করুক যেন আর কখনও এমন ওর হয় |''
"জানি ভয়ংকর অবস্থা গিয়েছে ওর | আচ্ছা যদিও সবই বলেছো তুমি তাও জানতে ইচ্ছা করে | এরিক কেন এত ভয় পায় যে ও এই ব্যাপারটা নিয়ে কথাই বলেনা তেমন !"
আইলান একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, "মাহি এরিক তো ওর স্বামী তাই ওর অনুভুতিটা আমি জানিনা কিন্তু ওর অস্থিরতা আমি চোখে দেখেছি | ও তিনদিন আলিজা অজ্ঞান থাকার সময়টা বোধহয় কয়েকগ্লাস পানি ছাড়া আর কিছুই খায়নি, একবারের জন্য সামনে থেকে সরেনি, সারাটা সময় আলিজার হাতটা ধরে ছিল, একটু ঘুমায়ওনি | ওর কষ্ট ও জানে |"
"এত অস্থির হয়ে গিয়েছিল ?"
"হ্যা ! আর অবস্থা যা হয়েছিল আলিজার তাতে এরিকের এরকম করাটা অস্বাভাবিক নয় | মাহি এই কথাটা বলিনি আমি তোমাকে | আজকে বলছি |"
মাহিরা অধীরভাবে বলল, "কি কথা ?"
"ওকে যেদিন হাসপাতাল নেই সেদিন | আমি তখন কেবল শাওয়ার নিয়ে বেরিয়ে জিন্সটা পড়ে শার্টটা গায়ে দিয়ে বোতাম লাগাচ্ছি | তখনি "ভাইয়া !" ভাইয়া !" বলে চিৎকার ও | মানে প্রচন্ড যন্ত্রনায় যেমন একটা চাপা আর্তনাদ করে না মানুষ ওরকম করে ডাকল | আমি তো স্যান্ডেলটা পড়েই দৌড়ে গেলাম | মানে হঠাৎ কি হল ওর ! দশমিনিট আগেই তো সুস্থ ছিল, আমার হাতে খাবার খেল | মাহি গিয়ে দেখলাম ও পাঁচটা সিঁড়ি নেমে বসে পড়েছে সিঁড়ির উপর | ওর ওই আফ্রিকান আমেরিকান বান্ধবী এসে ধরেছে ওকে | আমাকে দেখে হেঁচকি তুলে কেঁদে শুধু বলল, 'ভাইয়া ! আমি.....' বলে কেঁদে ফেলল !"
আইলান বিছানায় বসে বলল, "মাহি সত্যি বলতে আমারই মাথা ঘুরে গিয়েছিল ! এমন ভয়াবহ অবস্থা ওর !"
মাহিরা ভীতকন্ঠে বলল, "কি হয়েছিল ?"
আইলান মাহিরার হাতটা ধরে বলল, "এখনও দৃশ্যটা মনে হলে আমার গায়ে কাঁটা দেয় ! আলিজা বসে পড়েছে আর...........আর সারা সিঁড়ি রক্তে ভেসে গেছে ! ভেনাল ব্লাড ( শিরার রক্ত ) নয় একেবারে টকটকে আর্টেরিয়াল ব্লাড ( ধমনীর রক্ত ) | বুঝলাম বড় ধরনের কোন জটিলতা হয়েছে ! আমি সব সংকোচ ভুলে ওর কাছে গিয়ে জড়িয়ে ধরে বসলাম ওকে | এরপর তো প্রথমে পুলিশে ফোন করতে গিয়েও রজার আংকেল ওকে কোলে উঠিয়ে নিয়ে হাসপাতাল গেল |"
মাহিরা আইলানের মাথায় হাতবুলিয়ে দিয়ে বলল, "থাক ! মন খারাপ করোনা তো ! মনে করো ওটা পরীক্ষা ছিল | এখন তো আর কোনরকম কোন কষ্ট ওর নেই | ওর জন্য এরিক আছে, তুমি আছো, আমি আছি | ওর কিছুই হবেনা |"
"তাই যেন হয় মাহি ! তুমি আর আলিজা আমার জন্য তোমরা দুজন হলে আমার দুটো চোখের মত | তোমাদের কারো কোন কষ্ট আমি সইতে পারিনা |"
মাহিরা প্রসঙ্গ পাল্টানোর উদ্দেশ্যে বলল, "আমি কিন্তু সম্পূর্ণই অন্য কথা বলতে চাইছিলাম |"
"তাই ? বলো কি কথা |"
"আইলান আমার মনে হয় কি জানো ?"
"কি ?" আমাদের এই সন্তানটাও মেয়ে হবে !"
আইলান হেসে ফেলে বলল, "তো ! সেটা তো খুবই ভালো কথা |"
"তুমি রাগ হবেনা ?"
"আশ্চর্য মাহি ! রাগ কেন হবো ?"
"মানে সবাই তো চায় একটা পুত্রসন্তান |"
আইলান মাহিরার হাতটা নিজের হাতে নিয়ে বলল, "মাহি বাবা কিছু বলেছে ?"
মাহিরা একটু চুপ থেকে বলল, "না মানে বাবা সেদিন বললেন যে তার ছেলের ঘরের নাতির নাম উনি উনার বাবা মানে তোমার দাদার নামে রাখবেন | আমি সেজন্যই ভাবছি যে যদি আমার এই সন্তানটা ছেলে না হয় তো ?"
আইলান আশ্বস্তভাবে বলল, "তো ? তো কি ? কথা একটা ছোটবোন পাবে, তুমি আমি আর আলিজা আরেকটা ফুটফুটে মেয়ে পাবো | মাহি আমার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মানুষ তুমি আর আলিজা তোমরা দুজনই কিন্তু মেয়ে !"
"তো কোন আপত্তি নেই তোমার ?"
"না |"
মাহিরা হেসে বলল, "জানো আলিজা আমার মেয়ের একটা নামও ঠিক করেছে |"
"কি ?"
"নক্ষত্র ! কি সুন্দর না নামটা ?"
আইলান স্ত্রীকে জড়িয়ে ধরে বলল, "সুন্দর তো হবেই | কে রেখেছে নামটা দেখতে হবে তো !"
.
.
.
"লিজ ?"
"কি এরিক ?"
"আচ্ছা তোমার ক্লাস নিতে কেমন লাগে ?"
আলিজা হেসে ফেলল |
এরিক সূক্ষ্ম বিরক্তচোখে চেয়ে বলল, "হাসছো কেন লিজ ? বলোনা কেমন লাগে ?"
"আগে যা বলেছি ঠিক তেমন ! ভালো লাগেনা তেমন !"
"তাহলে ছেড়ে কেন দিচ্ছনা ?"
"তারপর ?"
"তারপর কি আর ! ফুলটাইম ওয়াইফ এন্ড মাদার প্লাস হোমমেকার ! আমার কোনোই আপত্তি নেই ! আর এখন ড্যাডও তো আমাদের সঙ্গেই আছে | লিজ তুমি পড়াশোনা ছাড়ো তা আমি কখনই চাইনি সেজন্য সেক্ষেত্রে আমি বাধা দিয়েছি কিন্তু তোমার কাজ নিয়ে বাধ্যবাধকতা আমার নেই | তোমার ইচ্ছা না হলে টিচিং ছেড়ে দাও !"
আলিজা হেসে বলল, "এরিক তোমার সেকেন্ড ডিগ্রি পার্সোনাল মোটিভেশন আমার উপর কাজ করবেনা !"
এরিক হতাশভাবে বলল, "তুমি বুঝে ফেলেছো আমি কি বলতে চাইছি তাইনা ?"
"হুম ! তুমি আমাকে গ্র্যাড স্কুলের শিক্ষকতা ছাড়তে বলছো কারন তুমি তোমার এভিয়েশন ইন্সট্রাকশনের শিক্ষকতা ছাড়তে চাও |"
"সত্যিই চাই লিজ | এভিয়েশন স্কুলের শিক্ষার্থীরা অতিরিক্ত প্রশ্ন করলে আমার খুব বিরক্ত লাগে !"
"তুমি ড্যাডের কাছে সাহায্য নাও এ ব্যাপারে !"
এরিক আশাহতভাবে বলল, "আঃ ! ড্যাড ! সে আরেকজন ! সে খুবই উপভোগ করে শিক্ষকতা ! দেখোই তো তাকে ! কি চমৎকার সে ছয়মাস ওটিএস-এ ( অফিসার ট্রেইনিং স্কুল ) যাচ্ছে ছাত্র পড়াতে ! সপ্তাহে তিনদিন ম্যাক্সওয়েল ( ম্যাক্সওয়েল এয়ারফোর্স বেস ) পড়ে থাকে আর চারদিন চেস্টার-এ | আছে ফ্রি টিকিট তাই তিনদিন মন্টগোমারি ( স্টেট অব এলাবামা ) থেকে আবার রিচমন্ড ফিরছে আর আবার ভাইসভারসা ! কি আনন্দ তার এসবের ! আবার মোটা অংকের ডলার কামাচ্ছে ! ড্যাডের উদাহরণ দিও না !"
"এরিক তুমিও তো ফ্রি ফ্লাইট ইন্সট্রাক্ট করবেনা ! ড্যাড যেহেতু ইউএসএএফ এর জেট ইন্সট্রাক্টর তাই তার পেস্লিপ অনেক বেশি | কিন্তু যেহেতু তুমি খুবই অভিজ্ঞ, প্রাক্তন এএফ কমিশন্ড অফিসার তাই তোমাকেও তো প্রায় আশিহাজার ডলার দেবে আমেরিকান এয়ারলাইন্স একজন ইন্সট্রাক্টর হিসেবে | আর সেটার সাথে তোমার তোমার ওয়ারকিং আওয়ার তো আছেই ! এটা ভেবেই তো রাজি হয়েছিলে তুমি | তো এখন কি হল হঠাৎ ?"
"লিজ আমি এক্সট্রা আওয়ারে ইন্সট্রাকশন করবোনা !"
"মানে তুমি কাজটা রাখতে চাও এই শর্তে যে তুমি ছুটিতে কাজ নেবেনা ?"
"না | মাসে বড়জোর তিনদিন থেকে চারদিন, দুতিনমাস পর বড়জোর একসপ্তাহ, ছয়মাস পর পনেরদিন, আটমাসপর একমাস আর আমারমত দিনের পর দিন একনাগাড়ে কাজ করে গেলে ভাগ্যক্রমে তিনমাস ছুটি ! এর জন্য অর্থ অনেক পাই সত্যি কিন্তু সময়টা যা তোমার কাছে পেতাম সেটা হারাই সেজন্য অনেক কষ্ট হয় | এজন্যই বললাম যে যদি এক্সক্যাজুয়েলড আওয়ারে আমাকে ইন্সট্রাক্টর হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয় তো রাজি আমি কাজ চালিয়ে যেতে | নইলে বাদ ! আর লিজ, তুমি তো জানোই যে আমার আরো একটা কাজ রয়েছে ! ইউএসএএফ আমাকে এখনো ছাড় দেয়নি এসওসি থেকে | তাই এই ডলার আর লাক্সারি থেকে তোমার সঙ্গটা অনেক দামি আমার জন্য |"
আলিজা এরিকের গালে হাত রেখে বলল, "তুমি যাতে খুশি থাকো তাই করো | আর আমার পেশার ব্যাপারটা হল বছরে চারমাস কি আটমাস আমাকে সপ্তাহে একটা করে ক্লাস নিতে হয় | আর সেজন্য অনেকগুলো ডলার পারিশ্রমিক ও অনেক সুবিধাদি দেয়া হয় আমাকে | এজন্যই যদিও আমার পছন্দ নয় শিক্ষকতা তবুও সেটা চালিয়ে যাই | আর এই কাজটা চালিয়ে যাবার দুটো কারন রয়েছে | একটা হল অনেকের মুখে ঝামা ঘষে দেয়া আর কিছু উপার্জন | তবে সেটা যাই হোকনা কেন ওটা আমার দ্বিতীয় কাজ | আমার প্রথম কর্তব্য হল তুমি আর আমাদের পরিবার | সেজন্যই যদি তুমি আর ড্যাড না চাও তো আমি কাজ ছেড়ে তোমার আর আমাদের পরিবারের প্রতি সারাসময় নিযুক্ত হব |"
এরিক আলিজার কপালে একটা চুমু দিয়ে বলল, "আমি এখন সত্যিই চাই যে তুমি কাজটা করো | কেননা তুমি চাইলে অনেকবড় কোন চাকরি নিয়ে নিজের ক্যারিয়ার গড়ে তুলতে পারতে অনায়েসেই ! কিন্তু তুমি কখনোই আমার আর আমাদের পরিবারের চেয়ে বেশি কোনকিছুর দাম দাওনি | আর এই কাজটা খন্ডকালীন আর আরামদায়ক চাকরি তাই ছাড়ার দরকার নেই | তুমি সেরকম স্ত্রীলোক কখনোই নও যে নিজের জীবন, আপনজন আর পরিবারের চেয়ে সম্মান, প্রতিপত্তি, খ্যাতি আর অর্থের মূল্য দেবে ! আচ্ছা লিজ তুমি মেম্ফিস-এর সার্ভে অফিসার চাকরিটা নিলেনা কেন ? ওদের অফার কিন্তু দারুন ছিল ! বছরে প্রায় দুইলাখ ডলার পেতে আর সাথে কোম্পানি থেকে দেয়া একটা অ'ডি, থাকার জন্য বড়সড় এপার্টমেন্ট সবই তো ছিল ! তুমি রাজি কেন হলেনা ?"
"কখনোই হতামনা এরিক | আমার কাছে সুখ আর সমৃদ্ধির সঙ্গাটা একটু ভিন্ন | সুখের জন্য ওই অ'ডি গাড়ি আর ২৫০০ স্কয়ারফিট ডুপ্লেক্স এপার্টমেন্ট আমার চাইনা | তোমার সঙ্গটা আমার জন্য পৃথিবীর সবচেয়ে সুখকর বস্তু | আর ওই অতবড় এনভায়রমেন্ট সার্ভে অফিসার পোস্টার চেয়ে তোমার স্ত্রী, ম্যাডিন আর এইবের মা, ড্যাডের মেয়ে এই পোস্টগুলো অনেক বেশি দামি আমার কাছে ! আমার অনেক নাম, অনেকবড় পোস্টের সম্মান এগুলো দরকার পড়বেনা | তোমার সাথে প্রতিটা মুহূর্ত, তোমার ভালোবাসা , আমার সন্তানদের মুখে মা ডাক, ড্যাড যখন কিছুক্ষন আমাকে না দেখে খুঁজে বের করে পেয়ে যে হাসিটা দেয় সেগুলো অমূল্য | আর এজন্যই আমি সাধারণ | তবে একজন সাধারণ মানুষ হিসাবে কোনোই কষ্ট নেই আমার |"
এরিক আলিজার কপালের টিপটা ঠিককরে পড়িয়ে দিয়ে আলিজার দুগালের উপর হাতরেখে বলল,"লিজ তুমি কখনোই সাধারণ নও | তুমি হচ্ছো আমার সম্রাজ্ঞী !"
.
.
.
মনজুর অবাকচোখে দেখছেন রজারকে | নাতিকে কোলে নিয়ে বকবক করছেন আর হাঁটাহাঁটি করছেন |
মনজুর এরিককে নিয়ে সন্তুষ্ট হয়েছেন তার শিক্ষা, পেশা আর পদবি সব জানার পরে | আর রজারকে দেখে তিনি বিস্মিতই হন ! রজারও নাকি বিমানবাহিনী কর্মকর্তা আর সে নাকি তার ছেলের চেয়ে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা |
এরিক ক্যাপ্টেন হয়ে তিনবছর পর সার্বক্ষণিক অফিসারের পদ থেকে পদত্যাগ করে এয়ারফোর্স ছেড়ে এসেছে | আর রজার পূর্নকর্মজীবন বিমানবাহিনীতে ছিলেন | তিনি যখন অবসর নেন তখন তার অবস্থান ছিল একজন সম্মানিত ফিল্ড অফিসারের, সে লিউটেনেন্ট কর্নেল পদে ছিল অবসরের সময় | অথচ এখন সে ম্যাক্সওয়েল এয়ারফোর্স বেস ফ্লাইং স্কুলের একজন খন্ডকালীন ফ্লাইট ইন্সট্রাক্টর হয়েও সার্বক্ষণিক নিয়োজিত সংসারে | সারাক্ষন নাতিনাতনিদের নিয়ে রয়েছেন ! এরিক ঘরে এলেও এইব্রাহামের দেখাশুনা তিনিই করেন বেশিরভাগ সময় | অবসরে তার একই কাজ, তিনি তার সন্তানদের সময় দেন আর সন্তানেরা যেন সময় কাটাতে পারে ঠিকমত সে অবসর তাদের করে দেন | সন্তানদের মধ্যে কোনোই ভেদাভেদ করেননা তিনি কিন্তু এরিকের কাছে থাকেন আলিজার জন্য | কারন জিজ্ঞাসা করলে তিনি উত্তর দেন এই শান্তশিষ্ট, নিরীহ, নম্র আর দায়িত্বশীল মেয়েটিকে রেখে তার কোথাও যেতে ইচ্ছা করে না |
মনজুর তার মেয়ের পরিবার দেশে আসার পর একটা বিষয় দেখে খুবই অবাক হলেন তা হল রজার খুবই ভালোবাসে আলিজাকে আর তা একেবারেই লোকদেখানো ভালোবাসা নয় | তিনি ছেলের চেয়েও পুত্রবধূর প্রতি বেশি যত্নশীল | এরিক ঘরে থাকলে তিনি সবসময়ই নাতিনাতনিদের নিজের কাছে ব্যস্ত রাখেন যাতে আলিজা স্বামীকে সময় দিতে পারে | কখনই তিনি সন্তানদের বিরক্ত করেননা দেখে মনজুরও অবাকই হন |
একটা সহজ স্বাভাবিক সম্পর্ক রেখেছেন তিনি ছেলে আর তার স্ত্রীর সঙ্গে | মনজুরের পক্ষে চেষ্টা করেও এরকম সম্পর্ক গড়া সম্ভব নয় আইলান আর মাহিরার সঙ্গে |
.
.
.
বিকেলে সবাই একসাথে লেকে বেড়াতে গেল | রজার এইব্রাহামকে কোলে নিয়েছে আর তার অন্যহাতটা ম্যাডিসনের হাতে |
এরিক রজারের কাছ থেকে এইব্রাহামকে কোলে নিতে গেল কিন্তু রজার নাতিকে দিলেননা |
বরং ম্যাডিসন এরিককে বলল, "ড্যাডি তুমি মার সঙ্গে হাঁটো | আমরা ঠিক আছি এখানে |"
আলিজা ম্যাডিসনকে সাথে আসতে বললে ম্যাডিসন বলল, "মা তুমি কিছুক্ষন নিজেকে সময় দাও | আমরা গ্যান্ডপার সঙ্গে বেশ আছি | সারাটা সময় তুমি ঘরে আমাকে আর এইবকে নিয়ে থাকো | এখন একটু নিজেকে নিয়ে থাকো মা !"
আজকে রজারকে দেখেই মনজুর আইলান আর মাহিরাকে অবাক করে দিয়ে আইলানের কোল থেকে কথাকে নিয়ে নিলো |
আইলান বিস্মিত হয়েই বলল, "বাবা থাক ! আমি নিয়েছি তো ! তুমি ক্লান্ত হয়ে পড়বে ! তুমি যাও এগিয়ে যাও |"
মনজুর হেসে বললেন, "আরে কিছু হবেনা গো বাবা | দে আমার কাছে | আসো দাদু !"
মনজুর নাতিকে কোলে নিয়ে বললেন, "তুই বৌমাকে দেখে রাখ আর সাবধানে হাঁট !"
মনজুর এগুতেই আইলান বলল, "মাহি বাবার কি হল ?"
মাহিরা আইলানের হাতটা ধরে বলল, "কিছুনা ! ইনফ্লুয়েন্স |"
"কিসের ?"
মাহিরা রজারকে ইশারায় দেখিয়ে বলল, "বেয়াইকে দেখে ইনফ্লুএন্সড !"
আইলান একটু লক্ষ করে হেসে ফেলে মাহিরার কাধঁজড়িয়ে হাত রাখল |
.
আলিজা কিছুদূর গিয়েই এইব্রাহামের গলা শুনল, ''মা !"
আলিজা সাথেসাথে ফিরে তাকিয়ে রজারের কাছে এসে বলল, "ড্যাড অনেকক্ষন ওকে সামলেছেন এবার আমার কাছে দিন |"
রজার বললেন, "কেন ডিয়ার ! আমি রয়েছি তো | আমার কাছেই থাকুক |"
এইব্রাহাম মিষ্টিকন্ঠে আবার বলল, "মা ! আছবো !" বলে হাত বাড়িয়ে দিলো আলিজার দিকে |
এবার রজার আর বাধা দিলেননা !
আলিজা ছেলেকে কোলে নিয়ে গালে চুমু দিয়ে বলল, " 'আছবো' নয় বাবা, বলো 'আসবো' !"
এইব্রাহাম মায়ের গালে চুমু দিয়ে বলল, " 'আ-শ-বো' !"
আলিজা ছেলে জড়িয়ে আদরকরে বলল, "এইতো হয়েছে বাবা |"
এরিক এগিয়ে এসে বলল, "বাহ্ লিজ ! আমার ছেলে আমার চেয়েও তিনগুন দ্রুত শিখে ফেলবে 'বেঙ্গলি !"
আলিজা হেসে বলল, "এরিক তোমার কাজ নয় বাংলা শেখা ! আমি হলফ করে বলতে পারি সেটা !"
"আমি ছয়মাসে জার্মান শিখেছি !"
আলিজা এইব্রাহামকে কোলে রেখে হাঁটতে হাঁটতে বলল, "কিন্তু সাতবছরেও টেনেটুনেও বাংলা বলতে পারলেনা !"
"আরে অনেকটা পারি ?"
"এরিক ! লাভ নেই আমার কাছে জাহির করে ! তুমি আমার নামটাও এখনও উচ্চারণ করতে পারোনা ঠিকমত !"
আলিজা এগিয়ে যেতে লাগল |
"আ-লি-জা-হ ! ইজ দ্যাট গুড ইনাফ ? ( এতটুকু কি যথেষ্ট ?)"
আলিজা ফিরে তাকিয়ে বলল, "সাতবছর পর ! হ্যা ! যথেষ্ট !"
এরিক বলল, "হ্যা সত্যিই অত্যন্ত কঠিন আর প্রাচীন ভাষা | আর এত নিয়মনীতি এর ! তবে তুমি এইবকে শিখাতে পারো আরও |"
"সময় হোক এরিক | ও একটা শিশু | ওকে আমি নিজের ইচ্ছাপূরণের 'উইশবক্স' বানাবোনা কোনদিনই ! আর ওর রক্তে বাংলা রয়েছে | ও শিখবেই | কিন্তু এখনই ওকে এতগুলো ভাষার চাপে ফেললে কি হবে জানতো ? ও 'ভোকাল ইন্টারেকশন এবনর্মালিটিস'-এ ভুগবে | ও বুঝতে পারবেনা তখন যে ও কখন কোন ভাষাটায় প্রতিক্রয়া করে উত্তর দেবে প্রশ্নকর্তাকে | আমি কোনদিনই তাই ওকে এই বিপদে ফেলব না | ও যেভাবে ধীরে ধীরে শিখছে তাই শিখবে |"
এরিক এগিয়ে এসে ছেলেকেসহ আলিজাকে জড়িয়ে ধরে বলল, "আমার কখনোই কোন ভাষার প্রয়োজন পড়েনি তোমার চোখদুটোকে, তোমার মনটাকে বুঝতে | সেজন্যই এই চেষ্টা আমি করিনি !"
আলিজা হেসে ফেলে বলল, "পাগল ! এরিক তোমাকে এই চেষ্টা করতেও হবেনা |"
এরিক আলিজার কাঁধে হাতরেখে হাঁটতে হাঁটতে বলল, "আমার নিজেরও কখনও কখনও মনে হয় আমি অনেকটাই পাগল |"
আলিজা জানে ভাষাটা আয়ত্ত করতে না পারলেও এরিক আলিজার অনেককথাই বোঝে |
ম্যাডিসন এসে এরিকের অন্য হাতটা জড়িয়ে ধরে বলল, "আমিও মার সঙ্গে একমত ! তুমি আসলেও কিছুটা 'পাগল' !"
এরিক হেসে মেয়ের কপালে চুমু দিয়ে বলল, "তাহলে তো বলতেই হবে যে আমি ভাগ্যবান যে আমি 'পাগল' !"
ম্যাডিসন আলিজাকে বলল, "মা তুমি ঠিকই বলেছো ! ড্যাড অদ্ভুত কথাই বেশি বলে !"
আলিজা বলল, "প্রায় দশ বছর ধরে দেখছি সোনা !"
এরিক হাতবাড়িয়ে দুজনকেই নিজের কাছে টেনে নিয়ে বলল, "আই লাভ বোথ অব মাই লেইডিস !"
.