এরিক কিছু খাবার নিয়ে এসে দেখল আলিজা সোফায় ঘুমিয়ে পড়েছে | এরিক আর ডাকল না তাকে | আলিজার পা-টা কাউচে তুলে দিয়ে কম্বল দিয়ে ঢেকে দিয়ে তার পাশে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিল কিছুক্ষন | কি আরাম করে ঘুমাচ্ছে |
এরিক উঠে ফোনটা নিয়ে ডায়াল করে বলল, "সোলিজ তুমি দুটো টিকিটের ব্যবস্থা করে দাও |"এত দ্রুত ভালো কোন ডোমেস্টিক ফ্লাইটের ব্যবস্থা হয়নি | রেভেন আলাস্কার দুটো ইকোনোমি টিকিট পাওয়া গেছে |
এরিককে সাথে আসতে দেখে আলিজা ব্যস্ত হয়ে বলল, "আরে তোমাকে যেতে হবে না | তুমি যতটা করেছো তাই অনেক |"
এরিক হেসে বলল, "কেন ? আমাকে সাথে নিতে চাওনা ? কেন ? আমি এতই খারাপ ভ্রমণসঙ্গী হিসেবে ?"
"না তা নয় ঠিক |"
"তো ? এতশত ভেবোনা |"
"কিন্তু ?"
"বিশ্রাম নাও |"
জেএফকে নয় আটলান্টা থেকে ফ্লাইট ধরতে হবে স্কিপল-এর | সেখান থেকে ঢাকা | কষ্টের ব্যাপার | কিন্তু এটাই পথ | এরকম কিছু একেবারেই নতুন নয় এরিকের জন্য | তার ব্যক্তিগত সাঁইত্রিশ ঘন্টা আর সাড়ে পঁয়ত্রিশ ঘন্টার ফ্লাইং রেকর্ড আছে যৌথভাবে তার বন্ধু অসওল্ডের সাথে | আর সেটা আরামদায়ক কিছু নয়, এসি ১৩০জে ঘোস্টরাইডার আর এফ ১৬ ফ্যালকন এর | দুটোই গানশিপ ফাইটার জেট | কিন্তু তার চিন্তা আলিজাকে নিয়ে | এত নরম স্বভাবের মেয়ে, ওকি পারবে এতক্ষন আকাশে থাকতে ?
আটলান্টায় নেমেই মনে হল এরিকের আলিজার শরীর ভালো নেই | ট্রান্সমিটে গিয়ে যখন সে একজন এয়ারপোর্ট কর্মকর্তাকে কোন ভনিতা ছাড়াই বলল যে তার অসুস্থ বোধ হচ্ছে রেস্টরুম কই তখন নিশ্চিত হল এরিক যে তার সাথে আসার সিদ্ধান্ত একেবারে সঠিক |
তিননম্বর টার্মিনালে যেতে যেতেই এরিকের মনে হল যাওয়া কি আজই দরকার ! আলিজাকে দেখে মনে হচ্ছে এখনই অজ্ঞান হয়ে পড়বে সে | কেমন নিস্তেজভাবে লবিতে বসে সে রানওয়ের দিকে চেয়ে আছে | এরিক এগিয়ে এসে তার হাতটা ধরে চুপ করে বসে রইল | কখনও কখনও কথার চেয়ে অনুভতিটার ভাষা হয় তীব্র |
তাদের ফ্লাইট এনাউন্সড হয়ে গেছে | যাক এটা বিজনেস ক্লাস দিয়েছে, যদিও জেটব্লুর সেবা এরিকের তত পছন্দ নয় | সাড়ে সাত ঘন্টার ফ্লাইটে একফোঁটাও ঘুমালো না আলিজা | এমনকি কিছু খেলোও না শুধু দুই কাপ কফি ছাড়া | কেমন উদাস দৃষ্টিতে চেয়ে রয়েছে জানালার দিকে |
আলিজা স্কিপল নেমে যাত্রা বিরতিতে কোথাও গেল না | একেবারে স্থবির হয়ে বসে রইল | অনেকেই বেরিয়ে পড়ল আমস্টারডাম দেখতে | এতো সুন্দর শহর | কিন্তু আলিজার দৃষ্টি এক্সিকিউটিভ লাউঞ্জের জানালার বাইরে কোথাও গেল না | কি হয়ে গেল কোথা দিয়ে ! কোথায় ফেলে চলে এসেছে সে সবকিছু ? আজ সে কে ? সেই দিনগুলো কোথায় চলে গেল ? সেই সময়গুলো হারালো কোথায় ? কিছুই আজ নেই কেন ? নিজের অজান্তেই আলিজার চোখের পানি অঝোর ধারায় বয়ে চলল | স্কিপল নেমেই এরিক কিছুক্ষন ঘুরে বেড়াল এয়ারপোর্টের আশেপাশেই | এসবকিছুই তার চেনা | আকাশের সবই সে জানে, তার ভয় মাটি নিয়ে |
এরিক ফিরে এসে দেখল আলিজার পাশে এক বয়স্ক ফরাসি মহিলা আর কয়েকজন লোক দাঁড়িয়ে | আলিজা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে | মহিলাটি নিজের রুমাল দিয়ে তার চোখ মুছে দিচ্ছে | এরিক একগ্লাস জুস্ নিয়ে এল ভেন্ডিং মেশিন থেকে |
সে এসে মহিলাটিকে পরিষ্কার ফ্রেঞ্চ ভাষায় বলল, " এল নে মোশনে রিয়েন দি ঠু | ভুলি ভুসিল ভুসপ্লেইড লে ফেএরে এভোয়ের এসে সুস ? ( ও খাচ্ছেনা কিছু একেবারেই | আপনি ওকে দোয়া করে এই জুসটা খাইয়ে দেবেন ?)''
মহিলা সাগ্রহে বললেন, "ফিসে(ল) সুর(ও) (অবশ্যই বাবা) |"
তাদের ফ্লাইট এনাউন্স হওয়ার আগে পর্যন্ত সেই মহিলা সেখানেই বসে রইলেন আলিজার পাশে |
ব্রিটিশ এয়ারওয়েজ-এর বিমানটা দেখে প্রথম কথা বলল আলিজা, "অনেক বড় প্লেনটা !"
এরিক একবার তাকিয়ে দেখে আবার ম্যাগাজিনে চোখ রেখে বলল, "হুমম | বোয়িং ৭৬৭-৩০০ | বড়ই |"
আলিজা তার দিকে তাকিয়ে বলল, "তুমি কিভাবে জানলে ?" বলেই সে সোজা হয়ে বসে বলল, "স্যরি | আমি ভুলে গিয়েছিলাম |"
এরিক একটু হেসে বলল, "আমিও যদি ভুলে যেতে পারতাম তো ভালো হত | কিন্তু কি করি বল | আকাশের সাথে আমার রক্তের সম্পর্ক |"
বিমানে ঢুকতেই একজন স্ট্রুড্রেস ফ্লাইট এটেন্ডেন্ট-কে দেখে এরিক হেসে বলল, "তো অবশেষে এখানে এলে স্যালি !"
মেয়েটি সুন্দরকরে বলল, "ওয়েলকাম আবোর্ড স্যার |" বলে চোখটিপে হেসে বলল, "আই এম অন ডিউটি |"
এরিক এগিয়ে এল সামনে তাদের সিটের দিকে |
আলিজাকে বসিয়ে দিয়ে বলল, "বসো তুমি আমি আসছি |''
এরিক ফ্লাইট ডিপারচারের মিনিট পাঁচেক আগে ফিরল |
সে বসেই হেসে বলল, " স্যালি আগে তিনতলার ছাদে উঠতে ভয় পেত | আর দেখো এখন ৩০,০০০ ফুট উঁচুতে উঠেছে | মেয়েরা সব পারে !"
তিনতলার ছাদ ! কথাটা যেন কোন এক প্রাচীন স্মৃতির দরজায় আঘাত করে বসল | তিনতলার ছাদ ! সেই এক পৃথিবী যা তার কত প্রিয়, কত আপন ছিল ! কত দিন, রাত, কত স্মৃতিময় বিকাল সন্ধ্যা সব সেখানে | একটা অদ্ভুত জগৎ ! কোথায় সে ছাদটা এখন ? আলিজার চোখ আবার ভিজে উঠল |
এরিক আবার তার হাতটা ধরল শক্ত করে | মৃদুস্বরে বলল, "নিজেকে সামলাও | হয়ত আরো বেশি বড় কোন কষ্ট সামনে আছে | সেটার জন্য প্রস্তুত হও |"
বেল টিপে এরিক এটেন্ডেন্টকে ডেকে পানি নিয়ে একটা ওষুধ সে আলিজার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, "খেয়ে নাও | কিছুটা ভালো বোধ করবে |"
আলিজা জিজ্ঞাসা করল, "কি এটা ?"
"এটা তেরো ঘন্টার ফ্লাইট | আর রিচমন্ড থেকে হিসেবে সাড়ে নয় ঘন্টা ফ্লাইটে ছিলে | এতক্ষন তোমার এভাবে মাটির এত ওপরে থাকার অভ্যাস নেই | এখনই অনেক অসুস্থ হয়ে পড়েছো | এটা খেয়ে নাও | এতে তোমার রক্তচাপ নিয়ন্ত্রিত থাকবে আর স্নায়ু উত্তেজিত হবে না | খাও |"
"আমি ঠিক আছি |"
''দ্যাখো আমাকে অন্তত মিথ্যে বোলো না | বেশিক্ষন আকাশে থাকার অভিজ্ঞতা যেমন তোমার চেয়ে অনেক বেশি আমার, তেমন যাদের অভ্যাস নেই তাদের কষ্টগুলোও খুব দ্রুতই চোখে পড়ে আমার |"