পর্ব ৪৮

396 19 0
                                    

ঘরে ডিমলাইট জ্বলছে আর বারান্দায় বাতি জ্বালানো নেই কোন l দূর রাস্তার আলোর আভা আর পাশের বাড়ির জানালার আলো কিছুটা এসে পড়ে আলোর আর ছায়ার একটা ধোঁয়াশা তৈরী হয়ে আছে l ঠান্ডা ভেজা ভেজা বাতাস বইছে l মনে হচ্ছে আশেপাশে কোথাও বৃষ্টি পড়ছে l আকাশে মেঘ l
আলিজা চুপচাপ একাকী দাঁড়িয়ে আছে বারান্দায় l মনের মাঝে অনেক কথাই ঘুরপাক খাচ্ছে অগোছালোভাবে l কিন্তু একটা নির্দিষ্ট খেয়াল তৈরী হচ্ছে না l সন্ধ্যার কথা মনে পড়ছে বারবার l কিন্তু কেন যেন নিজেকে ভারমুক্ত লাগছে অনেকটাই | কারন এরিককে সে এই জঘন্য অতীত ঘটনাটা আর কামরানের তার প্রতি আজীবনের পৈশাচিক আসক্তির কথা সে জানাতে চায়নি l এমন নয় যে মনে ভয় ছিল তার l কারন যে যাই বলুক আলিজা নিশ্চিত ছিল যে এরিক কখনোই তাকে অবিশ্বাস করে ভুল বুঝবে এমনটা হবার নয় l কারন ছিল এই যে, যে সত্যকে প্রচার করতে আর যে অন্যায়টাকে প্রতিবাদ করতে আলিজাকে এতটা মানসিক আঘাত আর যন্ত্রণার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছিল তাকে অনেক পেছনে ফেলে এগিয়ে চলে এসেছিল সে l কিন্তু কিছু আঘাতের দাগ যেমন মেটেনা, ঠিক তেমনি এই অতীতটা তাকে এক সূক্ষ্মসুতোয় অদৃশ্যভাবে টেনে ধরে রেখেছিল l
আলিজা জানায়নি কিছুই এরিককে l এর কারন ভয় নয়, দ্বিধা নয় l কারন হল ঘৃণা, এক ভয়ংকর অতীতের প্রতি ঘৃণা l কিন্তু প্রায়ই মনে হত তার হয়তো বলা উচিত এরিককে l স্বামী সে তার, জানার অধিকার তো রাখে সে l কিন্তু পরমুহূর্তেই মনে হয়েছে তার যে বললেই আবার তার মনে পড়বে সেই নোংরা ব্যাপারগুলো l কামরানের বিকৃতিপূর্ণ আচরণগুলো l কি মরিয়াভাবে সে চেষ্টা করতো আলিজাকে পাবার !
তার মনে পড়ে নাহিদের বিয়ের সময়কার একটা ঘটনা l বিয়ের মেহমানদের জন্য বড় চমচম আর রাজভোগগুলো দুভাগে কেটে রাখছে আলিজা l সে নাফির ঘরে বসে l নাফি অন্য কিযেন একটা কাজের তদারক করতে গিয়েছে l আলিজা আর নাহার ঘরে l এমনসময় কামরান এলো l কামরান আলিজাকে মোটামুটি একা দেখে বলল, 'আম্মা কি করতাছেন আপ্নে ? কাম করেন ? আঃ ! এত কাম কেলিগ্যা দিচ্ছে ব্যাক আপ্নেরে !' আলিজা জবাব দিলোনা, কামরানের বেশিরভাগ কথার সে কোন জবাব দেয়না l কামরান দেখল নাহার ঘুমিয়ে l সে একটা কোকের বোতল এনে আলিজার সামনে ধরে বলল, 'খান আম্মা ! এত্ত গরমের মইধ্যে এত্ত কাম করতাছেন ! ঠান্ডা খান !' আলিজা কোন কথা না বলে মিষ্টির প্যাকেটগুলো ঢেকে রেখে ঘর থেকে বেরিয়ে চলে এলো l এরপর সে পান সাজাতে বসেছে সোফায় বসে l কামরান এসে বলল, 'দ্যান তো আম্মা আপনার হাত দিয়া একটা পান বানাইয়া ! আম্মার হাতের পান বহুত মিডা হইবো তাইনা আম্মা !' আলিজা কোন কথা না বলে ফাহমিদার দিকে তাকালো l ফাহমিদা বোকার মত হেসে বলল, 'ভাই যে কি বলো !' কামরান হুট করে আলিজা যে সোফায় বসেছে সেটায় গড়িয়ে আধশোয়া হয়ে বসে পড়ে বলল, 'হরে বুবুজান ! আম্মাজানের সবই মিডা ! চেহারাসুরতও আর কামে কাজেও ! খালি জবানডা বহুত ধ্বক !' কামরান যেন প্রায় আলিজার কোলে শুয়ে পড়বে এমন এগিয়ে এলো l আলিজা ঝটকরে উঠে দাঁড়িয়ে মায়ের দিকে একেবারে আগুনঝরা চোখে তাকিয়ে বলল, 'আমার অবাক না শুধু রীতিমত আশ্চর্য লাগে তোমাকে মা !' কামরানের এই ব্যবহারে ফাহমিদা বোকার মত হাসলেও যখনই মেয়ের প্রতিবাদ এলো তখনই সে তেড়িয়া হয়ে জবাব দিল, 'কি করেছি আমি হ্যা ? কি করেছি যে এত তেজ করছিস আমার উপর ? ভালো দেখাচ্ছিস রে মেয়ে !' আলিজা শুধু বলল, 'তুমি যা দেখালে এরপর আমার আর দেখবার কি দেখাবার কিইবা বাকি থাকবে ! ধন্য তুমি মা !' আলিজা চলে এলো ঘরে তখনই l
আলিজা মনভার করে বসে রইল তখন আইলান টিউশনি থেকে ঘরে ফিরেছে কেবল l আলিজা ভাইকে পেয়ে নিচের ঘটনার উল্লেখ করল l কিছুক্ষন পরেই নাফি দৌড়ে এলো l সে চোখপাকিয়ে বলল, 'মায়ের সাথে এমন ব্যবহার করে কেউ হ্যা ? কি বলেছিস মাকে ? কেঁদেকেটে অস্থির ! জানিস তো কেমন ও ! কেঁদে দেয়ালে মাথা ঠুকে অস্থির l যা মার কাছে যা ! আর কাজ ফেলে এখানে কেন বসে আছিস ? মানুষ হ বুঝছিস মানুষ হ !"
ভাইয়ের কুলাঙ্গারপনায় কিছুই যে ফাহমিদা বলতে পারল না সে ফাহমিদাই তার মেয়ে যখন তার ব্যর্থতার দিকে আঙ্গুল তুলত তখন সে মরিয়া হয়ে উঠত মেয়েকে ছোট করতে l কথায় সে আলিজার সাথে পেরে উঠতনা বলে ঝগড়া, ভিত্তিহীন তর্ক আর সবশেষে দেয়ালে মাথা ঠুকে হম্বিতবি করে সবার কাছে আলিজাকে বিপর্যস্ত করত l কিছুক্ষন পর আলিজাকে যেতেই হল কারন ফাহমিদা নিজে এসে 'নিচে চল ! চল যেতে হবে |' বলে টেনে নিয়ে গেলো l আলিজা বাধ্য হয়েই গেল l সে কয়েকজনের সাথে পেঁয়াজ কাটতে বসল l কিছুক্ষন পর কামরান এলো l প্রথমে সে আলিজার সামনে চেয়ার নিয়ে বসে বোনদের সাথে গল্প শুরু করল l এরপর পেছনে সোফায় গিয়ে বসল l ঘরে অনেক লোকজন বলে সে গায়ে হাত দিতে পারছেনা আলিজার l এজন্য উসখুস করতে লাগল | আলিজা কামরান বসা মাত্রই সরে বসল l কামরান আবার টুল নিয়ে সেদিকে গেল l আলিজা আবারো জায়গা বদল করে একটা ছুরি আর প্লেট নিয়ে বিছানায় বসল পেঁয়াজ নিয়ে l এবার কামরান একা একাই বকবক করে গেল আর হেলে শুয়ে পড়ল আলিজার সামনে l আলিজা শুধু আহত চোখে মায়ের দিকে চেয়ে বলল, 'কিছুই কি দ্যাখোনা তুমি মা ?' এবার ফাহমিদাও লক্ষ করলেন ভাইয়ের কাজকর্ম কিন্তু নিজের ভাইবোনদের কোনরকম সমালোচনা করবেন এই ক্ষমতা ফাহমিদার নেই l আলিজা ঝরঝর করে কাঁদতে লাগল l সবাই ভাবল যে সে পেঁয়াজের ঝাঁজের জন্য কাঁদছে l কিন্তু নিজের সত্য নিজের কাছে রইল তার আর রইল কর্তব্যবিমূঢ় এক মায়ের চোখের সামনে l আলিজা প্লেটটা নিয়ে সম্পূর্ণ পিঠ ঠেকিয়ে দেয়াল ঘেঁষে মেঝেতে বসল আর কাটা পেঁয়াজের বাটিটা পাশে রাখল l কামরান এবার কিছুই করতে না পেরে সেই বাটিটার সামনে দাঁড়ালো l সে পা দিয়ে বাটিটা সরিয়ে দিতে লাগল কারন বাটির জন্য আলিজা গা ঘেঁষা যাচ্ছেনা l এবার আলিজা মাথাতুলে গর্জন করে বলল, "আর কি করবেন আপনি ? লজ্জা শরম তো নেই আপনার সেতো জানিই l অন্তত একটু মানুষের মত আচরণ করেন l"
ব্যাস ! এই কথাতেই ফুঁসে উঠল নাহার l সে কড়কড়ে স্বরে বলল, "আলিজা ! এ কেমন ধরনের কথা হল হ্যা ? একি হ্যা ! মামা হয় তোমার ! বড় মামা | তোমার বয়সে কত বড় l তোমার মায়েরও বড় বয়েসে ! তার সঙ্গে এমন করে কথা বলে ?"
আলিজা জবাব দিল, "বড়রা বড়দের মত হলে তারা ছোটদর ঘেন্নার পাত্র হয়না l আর আপনি তো বলবেনই এসব ! ছেলের দোষ আপনার চোখে পড়বে তাতো অসম্ভব l"
আইলান ঘরে ঢুকল এমন মুহূর্তে l আইলান দেখল আলিজার চোখে পানি, সে দেয়াল ঘেঁষে মেঝেতে বসে আর কামরান তার পাশে দাঁড়িয়ে প্রানপন চেষ্টা করছে আলিজার গায়ে ঘেঁষে দাঁড়াতে l কিন্তু পারছেনা কারন আলিজা একটা বড় এলুমিনিয়ামের বাটি মেঝেতে রেখেছে নিজেকে আড়াল করতে l
আইলান ঘরে ঢুকে ফাহমিদাকে বলল, "মা ! এসব কি মা ? এরকম কান্নাকাটি ঝগড়া করে নিয়ে এলে ওকে এখানে l আর এনে এই কুকুরের হাতের মুঠোর সামনে বসালে ?"
মুহূর্তে ঝগড়া লেগে গেল কামরান l আইলান দমবার পাত্র না l সে শুধু এই বলে গেল, 'ও কেন আমার বোনের গা ঘেঁষে থাকার চেষ্টা করে সবসময় ? কেন এই নোংরামো করে ও ! আমি নিজে চোখে তো দেখি ! একটা একটা মুহূর্ত আলিজা পা মেপে চলে এই হারামিটার ভয়ে l কিন্তু কেন এমন করে ও ? ওর মেয়ের বয়েসী একটা মেয়ে আর আপন ভাগ্নি ! অথচ সবসময় সুযোগ খোঁজে ওর গায়ে হাত দেবার l এত পিচাশ কিকরে হয় একটা মানুষ ?"
আইলান হাত ধরে বের করে নিয়ে এসেছিলো আলিজাকে l ছাদে বসে ভাইকে জড়িয়ে ধরে কি কান্না আলিজা সেরাতে l তার শুধু এই প্রশ্ন যে, 'এমন কেন হচ্ছে তার সঙ্গে ? কি দোষ তার ? কেন নীরব ফাহমিদা আর মনজুর ? আর কেনই বা তারা আলিজাকেও এর প্রতিবাদ করতে দেয় না ?"
বহু পুরাতন সেই প্রশ্নের সেই উত্তর আজ সন্ধ্যায় পাওয়া গেল এরিক আর রজারের কাছে l আলিজা ভেবেই নিয়েছিল যে এরিক জানলে হয়ত সে সহানুভতিশীল হবে l কিন্তু এরিক এভাবে তার প্রতিক্রিয়া দেবে সেটা যেন অভাবনীয়ই ছিল l আর রজার ? সম্পর্কে তার সবচেয়ে প্রিয় পুত্রবধূ আলিজা, কিন্তু নিজের অবচেতন মনেই যেন সে কন্যার স্থানটা দিয়েছে তাকে l আজ তা প্রমান করে দিলেন তিনি l আলিজা নিঃশব্দে কাঁদতে লাগল l
কতক্ষন কাঁদছিলো আলিজা সে জানেনা l কিন্তু ঘোর ভাঙলো মাথায় কারো পরম মমতাভরা স্পর্শে l আলিজা ফিরে তাকিয়ে দেখল আইলান l সে কোন কথাই বলল না, নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে আলিজার চুলে কয়েকবার আঙ্গুল চালিয়ে দিয়ে বোনের কাঁধটা হাতে জড়িয়ে নিজের কাছে টেনে নিয়ে দাঁড়ালো l আলিজা নীরবে কাঁদতে লাগল l আইলান তার কান্না থামাবার চেষ্টা করল না একটুও l কাঁদুক l কখনও কখনও জমাট দুঃখকে চোখের পানি নিজের ক্ষমতায় ধুয়ে দিয়ে মনকে হালকা করে দেয় l আইলান বোনের মাথার চুলে বিলি কেটে দিতে লাগল তাকে বুকের মাঝখানে জড়িয়ে ধরে l
.
.
.
আজকে দুপুরে আইলান কাজ গুছিয়ে একটু দিবানিদ্রার উদ্রেক নিচ্ছে তখনই এরিক ঘরে এলো l
এরিক ঘরে ঢুকে বলল, "এলান তোমার সিগারেট কোথায় ?"
আইলান আফসোসের সাথে বলল, "আর বলো না ! তোমার বৌ নিয়ে চলে গেছে l আমি তখন কথা বলতে বলতে আলিজার সামনে পরপর তিনটা সিগারেট ধরিয়েছি l এজন্য ও প্যাকেট নিয়ে গেছে l আর দেবেনা এখন l"
"তোমার নিশ্চই ব্যাকাপ প্যাকেট আছে l যেকোন স্মোকারদের থাকে l কই সেটা ?"
"হ্যা আছে l কিন্তু তুমি কেন চাচ্ছ ?"
"দরকার l কোথায় ?"
"তোমার পাশের ক্যাবিনেটের দুনম্বর ড্রয়ারে l একটা চামড়ার বাক্স আছে তার ভিতর l এরিক তুমি তো স্মোকার না l কি করবে ? এই দ্যাখো তোমরা স্বামীস্ত্রী মিলে আমার সিগারেটের পিছে পড়োনা l এমনিতেই তোমার বাবা কাল আমাকে 'টোব্যাকো এডিক্ট' বলেছে l"
এরিক ড্রায়ার খুলে একপ্যাকেট সিগারেট বের করে আইলানের দিকে ছুড়ে দিয়ে বলল, "ধরো l সিগারেট ধরাও l"
"কি হচ্ছে কি এরিক ?"
"জানবে এখনই l"
এরিক চেয়ার টেনে আইলানের মুখোমুখি বসল l
এরিক বলল, "এখন শোন l যা জানতে চাই বলবে দয়া করে l আর মিথ্যা বলবে না l একজন স্পেশাল মিলিটারি এজেন্ট আমি তাই খুব সহজে মিথ্যা ধরতে পারি l"
"কি হয়েছে এরিক ?"
এরিক পা ছড়িয়ে বসে বলল, "বিয়ের আগে লিজ কি কুমারী ছিল ?"
আইলান আধশোয়া থেকে উঠে বসে বলল, "এরিক এসব কি বলছো তুমি ? দ্যাখো এরিক আমি নিজে বহু এমন অনেককিছুই করেছি অতীতে যা নিয়ে গর্ব করা চলে না l বরং আজও সেগুলো দ্বিধায় ফেলে মনকে l কিন্তু আমার আলিজার মত মেয়ে হয় না l ও কতটা পবিত্র সেটা আমি জানি l কখনও কোন ছেলের সাথে ওর কোন অন্যায় সম্বন্ধ তো দূরের কথা, সামান্য ঘনিষ্ঠতাও ছিলোনা l"
"উত্তেজিত হয়োনা এলান l পুরো কথাটা শোন l ওর মত একজন মানুষের মনে একটা লুকানো কষ্ট থাকা আমার জন্য অনেক যন্ত্রনাময় l"
"এরিক তোমাকে বিশ্বাস করতে হবে এটা l ওর এমন কোন অতীত নেই l তুমি ওই ব্যারিষ্টারের কথা শুনে হয়ত এমন করছো l সৌখিন ওকে বিয়ে করতে চেয়েছিল আর ওর মা আলিজাকে একটা এনসেস্টরেল ( খানদানি ) গহনা দিয়েছিল l সৌখিন কয়েকবার ওর হাত ধরেছিল আর ও সে হিসেবে ওর হবুস্ত্রী ছিল সেসময় l কিন্তু কোন ঘনিষ্ঠতা ওদের কোনদিনই ছিলনা l"
"এলান লিজকে আমি বিয়ে করার সময় জানতাম যে সে কুমারী l আর ট্রায়ালের সময় মেডিক্যাল পরীক্ষায়ও তাই জানা যায় l আমি আমাদের জীবনের প্রথম সে বিশেষ রাতেও সেটাই জানলাম যে সে শুধু মন নয়, দেহের আর আত্মার দিক থেকেও খুব পবিত্র একজন মানুষ l"
"তো ? কি জানতে চাইছো তুমি ?"
"এলান শোন, আমার মেয়ের একটা অতীত সম্পর্কে শুনেছ বোধহয় l"
আইলান একটু দ্বিধাভরা চোখে চেয়ে বলল, "হ্যা l ব্যাপারটা দুঃখজনক l"
"লিজ ম্যাডিসনের জন্য যা করেছে সেটার জন্য আমি ওকে সারাজীবন ধন্যবাদ দিলেও কম পড়বে l যখনই ম্যাডিসন কাঁদত আমি দেখতাম লিজ ওকে জড়িয়ে ধরে বসে থাকত l ওকে বলত 'আমি সবসময় আছি সোনা l তুমি একা নও l' রাতে ম্যাডিসন একা ঘুমাতে পারত না l লিজ সাথে গিয়ে ঘুমাতো l কখনও কখনও অনেকরাতে ম্যাডিসন ঘুম থেকে উঠে আমাদের শয়নকক্ষে এসে নক করত l লিজ উঠে গিয়ে ওকে সান্তনা দিয়ে আমাদের বিছানায় এনে কোলের মাঝে জড়িয়ে ধরে ঘুম পাড়াত l ও যদি স্বপ্ন দেখে উঠে পড়ত, কাঁদত, তখন লিজ জড়িয়ে ধরে সান্তনা দিত আর বলত 'একটুও ভয় নেই মামনি আমার l আমি আছি l মা আছি তো l কার সাহস তোমার কাছে আসে আমি থাকতে l আমি থাকতে কেউ আসতে পারবে না l' ও এসব বলে ম্যাডিকে শান্ত করত l"
আইলান চুপ করে রইল l
এরিক একটু হেলে বসে বলল, "একদিন ও ম্যাডিকে ওর ঘরে ঘুম পাড়ানোর সময় বলল 'আমি একা ছিলাম কিন্তু তুমি একা নও সোনা l আমি আছি l সবসময় তোমার পাশে আছি l"
আইলান একটা সিগারেট ধারালো নীরবে l
এরিক একটু ঝুকে এসে বলল, "এলান, এখন আমাকে বলো l বলো সেই লোকটা কে ছিল ?"
আইলান অস্বস্তির সাথে বলল, 'এরিক কি বলছো এসব ? কোন লোকটা ?"
"এলান তুমি খুবই খারাপ অভিনেতা l তাই ভনিতা না করে বলে ফেলো ব্যাপারটা l আমি সেসময়ই বুঝতাম যে কোন জঘন্য অতীত আছে ওর যা ও প্রকাশ করেনা l"
"এমন কিছুই না এরিক l"
"বা এমন কোন ব্যাপার ঘটেছিল যেখানে ও কারো সহযোগিতা পায় নি এজন্যই ও ছায়ার মত ম্যাডিসনের পাশে ছিল l"
"এরিক সত্যিই এমন কোনকিছুই হয়নি l ও হয়তো মা হিসেবে ম্যাডিসনকে সাহায্য করেছে l"
"ও সাহায্য যদি নাও করত তাও ও আমার মেয়ের মা l এলান আমি অনুরোধ করছি, ব্যাপারটা জটিল করো না l আমি তোমার চোখমুখ দেখেই বুঝতে পারছি যে তুমি সবই জানো l বলো আমাকে l"
"এরিক !"
"কিছুক্ষন আগে তোমার স্ত্রীকে দেখতে গিয়েছিলাম কারন সকালে ও বলছিলো ও অসুস্থ বোধ করছে l তোমার স্ত্রী লিজের সাথে কথা বলছিল যা ছিল এরকম 'বাট হি ট্রাইড টু মলেস্ট ইউ ! এন্ড ইউ ওয়ার জাস্ট ফিফটিন, এ চাইল্ড অনলি ! হাও ক্যান ইউ লেট গো ? ( কিন্তু ও তোমাকে হয়রানি করতে গিয়েছিল ! আর তখন তোমার বয়স ছিল মাত্র পনেরো বছর, একটা শিশু ছিলে তুমি ! তুমি কিকরে ভুলতে চাও এটা ?)' l"
আইলান চুপকরে রইল l
এরিক সোজা হয়ে বসে বলল, "স্টার্ট টকিং এলান l ডোন্ট মেক মি মেক ইউ স্টার্ট টকিং l ( বলা শুরু করো আইলান | আমাকে বাধ্য করোনা তোমাকে কথা বলাতে )"
আইলান একটু চুপ থেকে ভারীস্বরে বলল, "এরিক ও বোধহয় চায়না যে তুমি এই ব্যাপারটা জানো l"
এরিক সোজা হয়ে বসে বলল, "এলান, ওর আর সম্পর্কের বন্ধনটা এতটা দৃঢ় যে আমি যেকোন অবস্থাতেই লিজকে বিশ্বাস করতে আমার মন থেকে বদ্ধপরিকর l এখন বলো তুমি l আর নির্ভয়ে থাকতে পারো l লিজ কখনোই জানবেনা তোমার আর আমার মধ্যকার কথোপকথন l"
আইলান একটা সিগারেট ধরিয়ে একটা লম্বা টান দিয়ে বলল, "শোন তাহলে l অনেক বড় ঘটনা এটা l তবে এরিক কথা শুরুর আগেই এটা বলে নেই তোমাকে l যা হয়েছিল আর এ পর্যন্ত হয়েছে এতে কখনোই আর কোন অবস্থাতেই আমার আলিজার কোন দোষ এতে কখনোই ছিলোনা l এটা আমাদের দুৰ্ভাগ্য যে আমরা যে সমাজে বাস করি সেখানে মানুষের খোলসে অনেকগুলো পিশাচ বাস করে l"
.
.
আইলানের কথা শেষ হবার পর এরিক আইলানের টেবিলের উপর রাখা পানির গ্লাসটা এক নিঃশ্বাসে শেষ করল l
এরিক একটু মাথা হেলে বসে বলল, "গতকাল পার্টিতে তোমার মায়ের বাড়ির আত্মীয়দের সাথে একজন ষাটের মত বয়েসী লোক এসেছিল l কালো, চোয়াল ভাঙা, চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা, পরনে লালচে গোলাপি ছাপা শার্ট আর গলায় হলুদ মাফলার, পায়ে একটা ছেঁড়া কালো জুতা, কালো ময়লা দাঁত আর নোংরা হাসি হাসে অনেকটা হিচকির মত করে l এই লোকটাই সে ?"
আইলান অবাক হয়ে বলল "হ্যা l ওই সে l ওটাই কামরান l তুমি কিকরে চিনলে ?"
"এলান তোমার বর্ণনায় ওকে চিনলাম l তোমার ভাষ্যমতে লীজের বয়স যখন নয় তখন থেকে এ লোকটা লিজের প্রতি কামনাসক্ত l তোমার স্মৃতিতে সবই আছে যেহেতু তুমি ওর ছয় বছরের বড় l কেননা তখন তুমি টিনেজ অনেক স্মৃতিই তোমার স্পষ্ট মনে রয়েছে l"
"হ্যা |"
"এই লোক শুধু একজন হয়রানিকারক নয়, এ একজন অপরাধী l ও দীর্ঘদিন ধরে লিজের প্রতি একটা তীব্র লালসাকে এমনকরে লালন করেছে যা ওর আচ্ছন্নতা হয়ে গেছে l ও কোন অবস্থাতেই তাই লিজের সামনে স্বাভাবিক ব্যবহার করবেনা l এটা তুমিও জানো যে কাল রাতে লিজকে অসম্ভব সুন্দর লেগেছে l সবাই লক্ষ করেছে ওকে l আমি স্বামী হয়েই এতটা আকর্ষণ করছিলাম ওর প্রতি যে নিজেকে নিজের আয়ত্বে রাখা কষ্টকর ছিল আমার জন্য l আর সেখানে ওই লোকটার মত একটা অফেন্ডার যে কিনা ওর প্রতি এতদিন ধরে লুব্ধ তার তো বেগতিক অবস্থা হবে সেটাই স্বাভাবিক l আমি প্রথমে লক্ষ করলাম লোকটা লিজকে দেখছে একভাবে l এরপর দেখলাম যে লোকটা লিজের ব্লাউজের নেকলাইন বরাবর তাকিয়ে রয়েছে আর তার দৃষ্টি ওর পিঠের দিকে l সে একদৃষ্টিতে দেখছে l ও একবার কথা বলতে গেল কিন্তু লিজ একদম পুরোপুরি এড়িয়ে চলে গেল l এরপর দেখলাম ও লিজ যেখানে যায় সেখানে যাচ্ছে l ওর চোখ যেন ওর শরীরের ভাঁজে ভাঁজে কুরছে l আমার রাগ উঠে গেল l আমি গিয়ে হুট করে ওর কলারটা পেছন থেকে টেনে ওকে দূরে সরিয়ে দিয়ে বললাম, 'আই উইল স্কুপ ইওর আইজ আউট লিটারেলি ইফ ইউ গো নেয়ার এনি মোর ( আমি সত্যিই তোমার চোখ উপরে নেব যদি ওর সামনে যাও তো ! )' l ও সরে গেল কিন্তু একটু পর ওকে আবার দেখলাম l ও কালকেই মার খেত আমার হাতে কিন্তু তার আগেই অন্য গন্ডগোল শুরু হল l আর ব্যাপারটা চাপা পড়ল l'
"এরিক যা হয়েছে তাতে কখনোই আমার বোনের কোন দোষ নেই l ও সারাজীবন এর প্রতিবাদ করে গিয়েছে l বিশ্বাস করো ও খুব পবিত্র মনের একটা মেয়ে l"
"এলান লিজ একটা মানুষের শুধু একটাই দিক দেখে কি জানো সেটা ?"
"কি ?"
"মানুষটা ভালো না খারাপ l ও একজন ভালো মানুষকে নির্দ্বিধায় বিশ্বাস করে l আমার মধ্যে আরেকটা আমি আছি সেটা ও পেয়েছে যা আমি হারিয়ে ফেলেছিলাম l ও আমাকে কতটা বিশ্বাস করে জানো তুমি ?"
"হ্যা l দেখিই তো l"
"এটা তো বিয়ের পরে দেখছো তুমি l আমি কি ছিলাম তাকি ও বলেছে সেভাবে তোমাকে ? মনে হয়না l এলান যেদিন ওর সঙ্গে তোমার মায়ের অসুস্থতার কথা শুনে আমি প্রথম ওর সঙ্গে বাংলাদেশে আসি সেরাতে আমি কোথায় ছিলাম জানো ? আমি তখন আমার তৎকালীন প্রেমিকার সঙ্গে নগ্ন অবস্থায় এক কম্বলের নিচে ঘুমিয়েছিলাম l আমি যখন ওকে দরজা খুলে দেই তখন আমার পরনে ছিল শুধু তোয়ালে l আর রান্নাঘরে গিয়ে তড়িঘড়ি কফি বানাতে গিয়ে ওটাও কখন খুলে পড়েছিল তাও মনে নেই আমার l আমি ওই অবস্থাতেই কথা বলছিলাম আমার এক এজেন্ট বন্ধুর সঙ্গে l পরে যখন দেখলাম লিজ একেবারেই তাকায়না আমার দিকে তখন মনে পড়ল আমার যে আমি কি অবস্থায় আছি ! তো এখন বুঝতে পারছো তো আমাদের সম্পর্কটা কেমন ছিল l আমার এতগুলো মেয়ের সঙ্গে সম্পর্ক থাকা সত্বেও লিজের কখনোই মনে হয়নি যে আমি ওকে কখনও মলেস্ট করতে পারি l একাধিকবার ওকে এ প্রশ্ন করেছিলাম l ও একদিন উত্তর দিয়েছিল 'এরিক আমি ছেলেদের চোখের দৃষ্টি চিনি l সেজন্যই আমি জানি এটা যে, যেসব মেয়েরা স্বেচ্ছায় ঘুমাতে চায় তোমার সাথে তাদের কথা ভিন্ন আর তাদের প্রতি তোমার ব্যবহারও ভিন্ন l কিন্তু তোমার পক্ষে কোনদিনই কোন মেয়েকে হয়রানি করা সম্ভব না l তুমি কখনোই কারো উপর বলপ্রয়োগ করতে পারোনা l আমি জানি সেটা l অনেক মেয়ের সাথে হয়ত তোমার সম্পর্ক হয়েছে কিন্তু কখনোই কোন মেয়ের সাথে তুমি অসৎব্যবহার করোনি l' এখন বুঝলে তো এলান আমার প্রতি ওর বিশ্বাসটা কতটা আর কি পর্যায়ের !"
"হুম l তাও এরিক কিছু বলোনা ওকে এ নিয়ে l কষ্ট পাবে ও l"
"এলান এই দানবটা এতটা কষ্ট আর হয়রানি ওকে করে যেতে পেরেছে শুধুমাত্র তোমাদের পরিবারের অসচেতনতার জন্য l আর এটা হয়েছে তোমার পরিবারের সদস্যদের জঘন্য মানসিকতার জন্য l এ একটা শিশুকে নিজের নজরবন্দী করে রাখছিল শুধুমাত্র লালসাপূর্ণের জন্য l আর এক্ষেত্রে তুমি ব্যাতিত তোমার পরিবার নিষ্ক্রিয় ছিল l এটা কখনোই একটা শিশুর দোষ নয় যে সে একটা রাক্ষসের কুদৃষ্টিতে পড়েছে l এক্ষেত্রে মারা উচিত রাক্ষসটাকে কিন্তু তোমার পরিবার রাক্ষসটাকে খাওয়া-পড়া-ঘুমানোর ঠাঁই করে দিয়েছিল l
"হুম l আমি একমত এরিক না ব্যাপারে l আর সবচেয়ে বড় কথা আমার মাবাবা দুজনেই দায়িত্বহীন আচরণ করেছে l"
"ঠিক বলেছো l অনেক কষ্টে কিছু শ্রদ্ধা তোমার বাবার প্রতি যুগিয়েছিলাম আমি l তা আজকে পুরোপুরি গেল l এখন লিজ বললেও তা আর ফিরবে না l"
আইলান অনুরোধের সাথে বলল, "এরিক আলিজাকে কিছুই বলো না এ নিয়ে l সবাই এ কথাই বলে ওকে যে এসব জানাজানি হলে তুমি কি ভাববে আর রজার আংকেল কি ভাববে | আর ও এখন এসবের চেয়ে অনেক দূরে এসেছে l এজন্যই বলছি l ওকে আর এসব মনে করিয়ে দিও না l"
এরিক গম্ভীরভাবে বলল, "আমি কি করব এ নিয়ে কারো পরামর্শ আমি নেব না l"
"কিসের পরামর্শ এরিক ? কি এলিজকে মনে করানো যাবে না ? কিসের কথা হচ্ছে ?"
দুজনেই ফিরে তাকালো l আইলান রীতিমত চমকে উঠল l দরজায় রজার দাঁড়িয়ে l
এরিক খুব স্বাভাবিকভাবে বাপের হাতথেকে বারবুনের গ্লাসটা নিয়ে চুমুক দিতে যেতেই রজার বললেন, "আঃ এরিক ! বাবা নিওনা l নীট ওটা l"
এরিক নির্বিকারভাবে চুমুক দিয়ে বলল, "আমার দরকার কড়া কিছু l বসো ড্যাড l"
আইলান ইতস্তত করল কিন্তু এরিক দুই চুমুকে কড়া বারবুন শেষ করে বাপকে বলল, "কি হল ? বসো l"
রজার বসে বললেন, "আমি কি কোন ব্যক্তিগত কথা শুনে ফেলেছি ?"
"হ্যা l"
"কিসের কথা হচ্ছিলো ? আর কি নিয়ে বলছো যে আমি কি ভাববো ?"
এরিক বলল "বসো ড্যাড ! আমি আরেকটা ড্রিংক আনি l"
"আরে না না ! এখন নয় !"
এরিক দরজার থেকে ঘুরে দাঁড়িয়ে বলল, "ট্রাস্ট মি ড্যাড, ইউ উইল নীড ওয়ান l ( বিশ্বাস করো বাবা, দরকার পড়বে তোমার ওটা )"
.
.
সব শুনে রজার একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, "আমি শুধু এটা ভেবেই শিউরে উঠছি যে একটা শিশু অবস্থা থেকেই ওকে সবসময় এটা ভেবেই প্রতিটা মুহূর্ত কাটাতে হয়েছে যে সবসময় একটা পিশাচ ওর উপর নজর রাখে আর যেকোন সময় একটা পিশাচ ওকে আক্রমন করবে l এখন হয়ত এটাই বলব আমরা যে ও সতর্ক ছিল বলে কোন বিপদ ওর হয়নি l কিন্তু কতটা যন্ত্রনাময় এই অনুভুতিটা ওর জন্য ছিল যে একমুহূর্তের অসতর্কতা সব শেষ করে দেবে l এত কষ্ট কিকরে নিজের মাঝে চেপে রেখে আমার এলিজ ? আমি তো ওর ড্যাড ! ও আমাকেও বলেনি !"
এরিক একপেশে হেসে বলল, "এত আক্ষেপের কিছুই নেই ড্যাড l আমিও এখনই জানলাম l"
আইলান বলল, "রজার আংকেল ও হয়ত দ্বিধায় ভুগেছে এজন্য বলেনি l ওর অপরাধ নেবেন না l"
রজার হতাশভাবে বললেন, "সত্যিটা হল আমি ওর কাছে অপরাধী l এরিক তো তাও কিছুটা আন্দাজ করেছিল l কিন্তু আমি ? আমাকে ও এতটা ভালোবাসে আর শ্রদ্ধা করে কিন্তু আমি ওর হাসিতে লুকানো কান্নাটা দেখিনি l"

মেঘের আলোয়Where stories live. Discover now