ক্লান্ত লাগছিলো বলে শুয়ে ছিল মাহিরা আর কিছুক্ষনের মধ্যেই তার চোখ লেগে এসেছিল ঘুমভাবে | কিন্তু মনজুরের ফোনে মাহিরার তন্দ্রা কেটে গেল |
মাহিরা ফোন ধরতেই মনজুর বললেন, "বৌমা বলছো ? কই তুমি গো ? কোর্টে ?"
মাহিরা ঘুমঘুম স্বরে হাই তুলে বলল, "না বাবা | আমি ঘরেই আছি | ঘুমাচ্ছিলাম | আপনি কোথায় ?"
মনজুর সে প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে বললেন, "তুমি কি কোর্টে নাকি গো ?"
"না বাবা | এখন তো কোর্টে যাইনা খুব দরকার না পড়লে | ডাক্তার সাহেব বলেছেন যেন একটু স্ট্রেস মুক্ত থাকি | আমার এসিস্টেন্ট তো রয়েছে সেখানে | আর এরপর প্রয়োজন হলে তো মক্কেলরা আসতে পারবেন | কোন দরকার কি বাবা ?"
"ইয়ে তুমি যাওনি আজ কোর্টে ?"
"বললামই তো বাবা যাইনি | আর আজতো এমনিতেও শনিবার | কাজেই প্রশ্নই ওঠেনা |"
মাহিরা শুনল মনজুর কাকে যেন বলছেন ফিসফিসিয়ে, "ওতো বলছে ও যায়নি ! তো ?"
কে যেন পাশথেকে ঝাঁঝিয়ে বলল, "যায়নি না ? তো কি হাওয়ায় হাওয়ায় হল সব ? ধান্দার কথা যত্তসব !"
মনজুর আবার বললেন, "ইয়ে মা .....একটা কথা বলার ছিল |"
"কি বাবা ?"
"দ্যাখো মা, দুনিয়ায় অনেক রকমের মানুষ আছে | সবাই কি এক ? না এক না ! হাতের পাঁচ আঙ্গুল যেমন সমান না তেমন সব লোকজন একরকম না | এখন শোন মা, আত্মীয় যেমনই হোকনা কেন আত্মীয় তো ! কাজে ভুল করুক শুদ্ধ করুক আত্মীয় | এখন শোন কালকে রাতে ওরা মানে তোমার শাশুড়ির বাড়ির আত্মীয়েরা যা করেছে আমি মানলাম ঠিক হয়নি কিন্তু মা তাইবলে কি এতবড় শাস্তি দেয়া চলে ? ওরা যা করেছে, করেছে ! এতে ছোট কারা হয়েছে ? ওরাই হয়েছে | এখন ওরা যে এইযে এমন লোকের চোখে ছোট হল সেটাই তো লজ্জা ওদের | এখন আরকি কোন দরকার আছে কিছু করার ? নেই | আর শোন মন্টি কে হয় ? তোমার খালাশাশুড়ির ছেলে | ওতো আত্মীয় তাইনা ? এখন নিজেদের মধ্যে ঝগড়া হয়েছে তো এজন্য কেসটেস করতে যাওয়াটা বাড়াবাড়ি হয়ে যায়না খুব বেশি ?"
মাহিরা চুপ করে শুনতে লাগল |
মনজুর বলল, "তুমি একবার কথা বলতে আমার সাথে | তোমার উচিত ছিল সেটা | তা না করে এখন তুমি কি করলে ওদের নামে মামলা করে দিলে ! ব্যাপারটা বাড়াবাড়ি হয়ে গেল না ? এতটা কেন করলে ? এজন্যই বলে মেয়েদের বুদ্ধি সর্বনাশ আনে |"
মাহিরা গম্ভীরভাবে বলল, "আমি কোন মামলা দায়ের করিনি বাবা |"
''এইতো না এটাই তো ক্ষতিকর | মিথ্যা বলাটা খুবই খারাপ | এটা অনেকবড় অপরাধ আর বড়দের সাথে মিথ্যা বলাটা রীতিমত পাপ | এটা হাদীস-কুরআনেও নিষেধ আছে যে বড়োরা যারা আমাদের উপর রয়েছে তাদেরকে তাদের কাজ করে যেতে দিতে হবে | শোন এখন তুমি, আমি ঘরে আসছি কিছুক্ষনের মধ্যে তোমার মামাশশুরকে নিয়ে | তুমি কেস তোলার ব্যবস্থা করো | আর তোমরা সবাই বসে কথা বলে এর মীমাংসা করো |"
মনজুর ফোন রেখে দেবার পর মাহিরা স্তব্ধ হয়ে বসে রইল কিছুক্ষন | তার মাথা কেমন ঘুরছে আর বুকজ্বালা করছে | খুব তেষ্টা পেয়েছে |
মাহিরা গলা ছেড়ে ডাকল, "আলিজা ! আলিজা ! এসো তো একটু আমার কাছে |"
আলিজা পাশের ঘরে ছেলের সাথে খুনসুটি করছিল | সে মাহিরার ডাকে দ্রুত সেদিকে গেল |
আলিজা ঘরে ঢুকে দেখল মাহিরা কেমন বিদ্ধস্ত চেহারায় খাটের কোন ঘেঁষে পা ঝুলিয়ে বসে আছে |
.
.
.
আলিজা একগ্লাস ঠান্ডা পানি নিয়ে এলো | মাহিরা প্রায় এক নিঃশ্বাসে পানি শেষ করল |
আলিজা জিজ্ঞাসা করল, "আর এনে দেব ভাবি ?"
"না | আর লাগবে না |"
"তুমি শোও তো এখন আর কিছুক্ষন | আমি মাথায় তেল মালিশ করে দেই |"
"আচ্ছা |"
মাহিরা আবার বিছানায় হেলান দিয়ে শুয়ে পড়ল | আলিজা তেল আর পানি মিশিয়ে তার মাথায় বিলি কেটে দিতে লাগল |
কিছুক্ষন চুপচাপ চোখ বন্ধ করে থেকে মাহিরা বলল, "আলিজা জানো আমি কিন্তু ঠিক বিশ্বাস করিনি কাল রাতে তোমার কথা |"
"জানি ভাবি |"
"আমি ভাবিই নি যে সত্যিই বাবা এমন হবে |"
"বিশ্বাস করাটা কষ্টের কিন্তু ব্যাপারটা সত্যি |"
"উনি কিকরে এমনটা করলেন ?"
"ভাবি সবাই সমান নয় | আমার বাবা এরকমই | তিনি সব সময়ই ঘরের চেয়ে পরের মূল্য বেশি দেন |"
"সেটা বুঝেছি | কিন্তু কালকের ঘটনায় উনি আমাদের কেন দোষ দিচ্ছেন ? আমরা কি এতে দোষী ?"
"মোটেই নয় |"
"তাহলে ? আর যা হয়েছে তা কি উনি দেখেন নি ? এরপরে উনি কিকরে ওদের পক্ষ নিলেন ? আর আমাকে এভাবে কেমন করে দোষারোপ করলেন উনি ? আচ্ছা আলিজা তুমিই বলো যে কি বাড়াবাড়ি করলাম আমি ?"
"তুমি মুখ বুজে অন্যায় সহ্য করেন নি এটাই হল দোষ | তুমি চুপচাপ শুধু সহ্য করতে তো আর কথা উঠতো না |"
"এটা কিকরে সম্ভব আলিজা ?"
"বললামই তো ভাবি | এই দোষ আমি আর আমার ভাই আজীবন করে এসেছি যে আমরা দুজন নীরবে জঘন্য আচরণ সহ্য করে যাইনি | এ নিয়ে বাবার আক্ষেপের কোন শেষ নেই | যখনই কেউ অকারনে কোন দুর্ব্যবহার করেছে আমরা এর প্রতিবাদ করতাম আর এজন্য প্রচুর কথা শুনতাম |"
"প্রতিবাদ করার জন্য কথা শুনতে ? আচ্ছা তোমাদেরকে ওরা এরকম কিছু করলে বাবা কোন প্রতিবাদ করতো না ?"
"পাগল তুমি ? বাবা করবে প্রতিবাদ ! হয়েছে ! একটা ঘটনা শোনো | অনেক ছোট তখন আমরা | তখন কেবল চারমাস হয় আমরা নয়াপল্টন গিয়েছি | একদিন আমাদের একজন মেহমান এলো গ্রাম থেকে | বাবা যত কষ্টেই থাকুক না কেন সে তার গ্রামের কোন লোককে ফিরিয়ে দিতনা | কখনোই না | এমনও অনেক হয়েছে যে ঢাকা ঘুরতে এসে একটা ছয় পরিবারের সদস্যের অন্তত দেড়মাস হয়েছে তাও যাবার নাম নেই | আমি ঘরের মেঝেতে আর ভাইয়া বারান্দার মেঝেতে ঘুমাচ্ছে কিন্তু বাবার ভ্রূক্ষেপ নেই | এখন আগের কথায় আসি | ভাইয়া তখন ক্লাস এইটে পড়ে সম্ভবত | আমি বোধয় ফোরে | ঠিক মনে নেই | তখন একদিন মেহমান আসার জন্য ভাইয়াকে গিয়ে নানুর ঘরে থাকতে হল | ভাইয়া নানুর ঘরের মেঝেতে ঘুমাত কেননা মেজমামা তাকে খাটে শুতে দিত না | পরপর দুদিন থাকার পর তৃতীয়দিন খুব ভোরবেলা ভাইয়া কেঁদে চোখ ফুলিয়ে ঘরে এলো | এর কারন হল সেরাতে ঐঘরে ঘুমাবার জন্য মামা দুবার ভাইয়াকে বাথরুমে যাবার সময় লাথি মেরেছিল | সম্পূর্ণ ইচ্ছাকৃতভাবে | এতবড় একটা অন্যায় করল সে অথচ নানু কি ভাইয়াকে বলল জানো 'ছি এসব বলে না ! মামা হয় | বড়মামা | কত বড় বয়েসে এসব বলে না | কত আদর করে তোমাকে |' নানু তো খুবই পক্ষপাতী মানুষ | অথচ বাবা এমনকি মা যে কিনা খুবই আদর করে ভাইয়াকে সেও এর কোন প্রতিবাদ করল না |"
"আশ্চর্য ! কেন ? আর কেমন মানুষ তোমার মামা যে কিনা একটা শিশুকে লাথি মারল ? ইনি সেই না যে মায়ের মৃত্যুর চারমাস পর একসময় বাবাকে আটকে রেখেছিল ভয় দেখিয়ে উনি ঘরটা যাতে ছেড়ে চলে আসেন সেজন্য ?"
"হ্যা |"
"আমিই তো পরে স্টে অর্ডার করে দিয়েছিলাম |"
"হ্যা |"
"আশ্চর্য ! এ লোককে কেন বাবা গতকাল আসতে বললেন ? সেতো এসেছিল গতকাল !"
"হ্যা | ওকে কখনও নিমন্ত্রণ করতে হবে না | ও এমনিতেই আসে যেখানে মেয়েলোক আছে আর ফ্রি খাবার আছে |"
"এই লোককে কিকরে বললেন আসতে বাবা ? এ তার ছেলেকে লাথি মেরেছিল আর বাবা একে নিমন্ত্রণ করলেন ? কেন ?"
"ভাবি শুধু এই ওর অপরাধ না ! আমার মায়ের এই ভাই আমার বয়স যখন পনেরো তখন আমাকে একবার মলেস্ট করতে গিয়েছিল |"
মাহিরা প্রায় গাল হা করে বলল, "বলো কি ! এরকম জঘন্য একটা লোক ও ?"
"হ্যা | তখন আমি কিশোরী আর সেদিন ঘরে একা ছিলাম | মা নিচে গিয়েছিল আর সে এক সুযোগে ঘরে ঢুকে পড়ে | আমি সবসময়ই জানতাম ও একটা কুলাঙ্গার তাই ওকে কোনদিনই পছন্দ করতাম না | আর সেদিন তো বুঝলামই যে মেয়েদেরকে আল্লাহ্পাক এজন্যই এই অদ্ভুত অনুভতি শক্তিটা দিয়েছেন যাতে তারা চোখের দৃষ্টির অনুমানেই এই দানবদের চিনে নেয় |"
মাহিরার চোখে পানি চলে এলো, সে মলিনকণ্ঠে বলল, "আলিজা আমি সত্যিই দুঃখিত | আমি ভাবিইনি যে এরকম একটা ভয়ংকর স্মৃতিও আছে তোমার জীবনে |"
"ভাবি ও যা চেয়েছিল তা করতে পারেনি | ও ঢুকেছিল ঠিকই ঘরে এ উদ্দেশ্যে কিন্তু তা সফল হয়নি | আমি ওকে দেখেই ওর মাথা লক্ষ করে ফুলদানি উড়িয়ে এশট্রে উড়িয়ে মেরে টেবিল উল্টে ফেলে দিয়ে বারান্দায় ঢুকে দরজা লাগিয়ে দেই | আমি প্রচন্ড চিৎকার শুরু করি | আর তা শুনেই মা চলে আসে |"
"তারপর ? মা কি করলেন ?"
"মা বিশ্বাস করেনি | উল্টো সে একটা থাপ্পড় দিয়েছিল আমাকে |আর পরে বাবাও না | পরে ভাইয়া এ শুনে খুব চটে গিয়েছিল যখন তখন মা আমাকে এটাই বলেছিল যে এরকম কিছু হলে তিনি ভাই আর মায়ের কাছে মুখ কিকরে দেখাবেন ! কোন অবস্থাতেই তার পক্ষে তার ভাইয়ের বিপক্ষে যাওয়া সম্ভব না | আর কেউ আমাকে মলেস্ট করতে গিয়েছিল এটা বললে বদনামটা আমরাই হবে | তো চুপ করে যাই যেন | কিন্তু ভাইয়া চুপ থাকতে পারেনি | সে এনিয়ে ঝগড়া করে অসম্ভব কথা শুনেছিল |"
মাহিরা আলিজার হাতটা ধরে বলল, "আলিজা ভয়ংকর স্মৃতি আর ভয়ংকর অভিজ্ঞতা | আমি আজ বুঝলাম যে কেন তুমি চাওনি এই পার্টির আয়োজন হোক তা |"
আলিজা মলিন হেসে বলল, "ভাবি, এজন্যই চাইনি কারন আয়োজন হলে বাবা ওদেরকে অবশ্যই বলবে আর ওরা এলে কামরানও আসবে | আর তাকে দেখলেই এখনও সেদিনটা মনে পড়ে যায় আমার |"
আলিজার চোখে পানি চলে এলো |
মাহিরা তার গালে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল, "স্যরি আলিজা | ভুল হয়ে গিয়েছে আমার | সত্যিই আমারই রাজি হওয়া উচিত হয়নি |"
"এতে তোমার কোনোই দোষ নেই ভাবি | যার বোঝার কথা সে বোঝেনি | দুঃখটা সেখানেই |"
"আলিজা এরিক কি জানে ?"
আলিজা চমকে উঠে বলল, "না না ! ভাবি ওকে কখনোই বলা যাবে না | ওর মেজাজ কি জানোই তো ! ও শুনলে ও মেরেই ফেলবে কামরানকে | এতদিন আগের সেই জাহান্নামকে আমি আমার সাজানো জীবনে আবার টানতে চাইনা | দ্যাখো, জানি ভাবছো যে এখন কেন কিছু করবো না ! উত্তরটা হল এই যে তখন আমার মাবাবা নিশ্চুপ ছিল | এখন হয়ত এরিক শুনলেই এনিয়ে ওকে আর ছেড়ে কথা বলবে না | অনেক পুরোনোদিনের আঘাত নতুনকরে আমি জাগাতে চাইনা |"
"বাট হয় ট্রাইড টু মলেস্ট ইউ ! এন্ড ইউ ওয়ার জাস্ট ফিফটিন, এ চাইল্ড অনলি ! হাও ক্যান ইউ লেট গো ? ( কিন্তু ও তোমাকে হয়রানি করতে গিয়েছিল ! আর তখন তোমার বয়স ছিল মাত্র পনেরো বছর, একটা শিশু ছিলে তুমি ! তুমি কিকরে ভুলতে চাও এটা ?)"
"আমি বাধ্য এখন ভাবি | আমি চাইনা এখন এরিক, ড্যাড, ম্যাডিন আর এইব এসব জানুক | যখন এ নিয়ে কিছু করার কথা ছিল তখন বাবামা চুপ ছিল আর তারা যে এতবড় নোংরা কাজটা করতে গিয়েছিল তাকে ডিফেন্ড করেছিল | তাই এখন ওসব ভাবতে ইচ্ছা হয়না ভাবি | আর দেখলেই তো ! এখনও এটা বাবার কাছে গুরুত্বপূর্ণ না | নইলে সে কিকরে কামরানকে নিমত্রন করল !"
মাহিরা আহতকণ্ঠে বলল, "এটা আমারও মাথায় আসছে না | কিকরে উনি এমনকিছু ক্ষমা করলেন !"
"এজন্যই বলছি বাবাকে নিয়ে মাথা ঘামাবে না | শুধু নিজে যা ঠিক ভাবো তাই করবে |"
"ঠিকই বলেছো |"
"আর বাবা আজ ওদেরকে নিয়ে এলে আমি কথা বলব | তুমি বলো না কিছু |"
মাহিরা দৃঢ়স্বরে বলল, "না আলিজা | আজকে আমিই কথা বলব বাবার সঙ্গে |"
"ভাবি ওদের মুখ বেসামাল | ওরা কি না কি বলবে !"
"না ! কথা আজ আমিই বলব | আজকে আমিই সব দেখবো | দেখবো আর সত্যি কিছু জিনিস জানবো |"
"ঠিক আছে এখন রেস্ট নাও |"
"আচ্ছা আলিজা আমি তো কোন কেস ফাইল করিনি আর তুমি বলছো তুমিও করোনি | তো ? করলোটা কে ?"
আলিজা মুখটিপে হেসে বলল, "মোস্তাকিম মাহফুজ সাহেব |"
মাহিরা চমকে উঠে বলল, "বাপি ? না না ! এটা হতেই পারেনা !"
"কি হতে পারে আর কি পারেনা তা জেনেই যাবে |"
.
.
.
আলিজা সদ্যসন্ধ্যার আবীরমাখা আলোয় চায়ের কাপ হাতে বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে | আকাশটা এতো দারুন দেখাচ্ছে ! লাল লাল মেঘগুলো একটু পরপর নিজেদেরমত নতুননতুন রূপে সারি ধরে আকাশে খেলা করছে | দূরে একটু কালোমেঘ উঁকি দিয়ে রয়েছে, যেন আসবো আসবো জানাচ্ছে | ঝিরঝির ঠান্ডা হাওয়ার পরশ একটু পরপর গালে ছোঁয়া দিচ্ছে | পাখিরা সব ঘরে ফিরছে | পাশের বাড়ির কার্নিশে একজোড়া কাক এখনও বসে ঝিম ধরে আর তারই পাশের আরেকটা কার্নিশে একটা মোটাতাজা বিড়াল চোখদুটো আধবোজা রেখে আয়েসে গুটিসুটি মেরে বসে আছে |
একটা অদ্ভুত সময়ের বলয় যেন ঘিরে সবকিছুকে |
"কি দেখছো লিজ ?"
আলিজা ফিরে তাকিয়ে হেসে ফেলল |
এরিক এগিয়ে এসে আলিজার পাশে দাঁড়িয়ে বলল, "আকাশের কি এত ডেকে তুমি সুইটহার্ট !"
"অনেককিছু ! কত বিশাল আর কত রহস্যভরা | আর কত রকমের রং খেলা করে |"
"হুম |"
"তোমার আকাশ ভালো লাগেনা কেন এরিক ?"
"ভালো লাগেনা ঠিক তা নয় | তবে দেখে দেখে বোর হয়ে গিয়েছি |"
আলিজা হেসে ফেলল আবার |
এরিক একদৃষ্টিতে চেয়ে আছে দেখে আলিজা জিজ্ঞাসা করল, "কি দেখছো এরিক ?"
"তোমাকে দেখছি |"
"আমাকে কি দেখার আছে ?"
"অনেককিছু | আকাশের মত |"
"হাঃ ! ভালো রসিকতা !"
আলিজা বারান্দার আলো জ্বালাতে গেল কিন্তু এরিক বাধা দিল |
"অন্ধকার হয়ে গিয়েছে এরিক |"
"থাক | আবছায়াতেই ভালো লাগছে |"
"কি হয়েছে তোমার ?"
"কিছু না | লিজ এসো কিছুক্ষন এখানেই থাকি |"
"আচ্ছা |"
কিছুক্ষন পর একটু একটু মেঘ জমা হওয়া শুরু করল | আলিজা তাকিয়ে দেখছে মেঘগুলো |
আলিজা ভেজা ঠান্ডা বাতাসে প্রানভরে শ্বাস নিয়ে বলল, "কি সুন্দর তাইনা এরিক |"
এরিক ভারীগলায় বলল, "হ্যা | খুবই সুন্দর |"
আলিজা ফিরে তাকাতেই এরিক চট করে তার ঠোঁটদুটিকে গভীর আদরে অধরবন্দী করল | এরিক ঠোঁট সরিয়ে নিয়ে আলিজার কপালে একটা চুমু দিল |
আলিজা এইরকমের আকস্মিকমধুর আদরে বিস্মিত হয়ে বলল, "কি এরিক ? কি হয়েছে ? হঠাৎ এমনকিছু কেন ?"
এরিক আলিজার নাকের উপর একটা আলতোকরে চুমু দিয়ে বলল, "এমনিতেই লিজ | ইচ্ছা হল আদর করি তোমাকে |"
আলিজা একবার এরিককে জড়িয়ে ধরে বলল, "ধন্যবাদ | আর এখন ছাড়ো | ঘরে যাই | দেখি এইব আর ম্যাডিন কি করছে |"
.
.
আলিজা মেয়ের ঘরে গিয়ে দেখল ম্যাডিসন নেই | রজার আর এইব্রাহামও নেই ঘরে | গেল কোথায় সব !
মাহিরার ঘরে গিয়ে দেখল মাহিরা ফোনে তার এসিস্টেন্টকে ডিকটেশন দিচ্ছে |
আইলানের ঘরে গিয়ে দেখল আইলান প্রিন্টারে কি যেন প্রিন্ট করছে | কথা মুগ্ধচোখে বাবার কাজ দেখছে | আলিজাকে দেখে আইলান একটু হাসল |
আলিজা বলল, "বাব্বা ! বাপের কর্মশৈলীতে মুগ্ধ কন্যা !"
"হ্যা !"
"ভাইয়া আমার এইবকে দেখেছিস ?"
"একটু আগে এরিক কোলে নিয়ে ঘুরছিল | বাপের কাছে বোধহয় |"
"না নেই | এরিক এতক্ষণ আমার সঙ্গে কথা বলছিল |"
আইলান যেন একটু চমকে উঠল, বলল, "তোর সাথে কথা বলছিল ?"
"হ্যা | কেন কি হয়েছে ?"
"না মানে ?"
"মানে কি ? আচ্ছা যাই হোক ! ওরা কই ? কোথাও কি গিয়েছে ?"
"না | ইয়ে আলিজা একটু কথা ছিল রে তোর সাথে |"
আলিজা ঘর থেকে যেতে যেতে বলল, "পরে | আগে দেখি ওরা কই |"
ডাইনিং রুমে এসে আলিজা দেখল খাবারের ঘ্রানে ম ম করছে | রান্নাঘরে ঢুকে দেখল রজার দুই নাতিনাতনীকে নিয়ে রান্নায় মত্ত |
আলিজা ঘ্রান টেনে বলল, "উমম ! ড্যাড এত সুন্দর খাবারের গন্ধ পাচ্ছি ! কি তৈরী হচ্ছে ?"
রজার হেসে বললেন, "দেখি আন্দাজ করো তো প্রিয় !"
"আমি কয়েকরকম চিজ, বিফ আর টমেটোর ঘ্রান পাচ্ছি | আর একি টেবিলের উপর ? আটা মনে হচ্ছে !"
আলিজা মুখে হাসি এনে বলল, "ওহহ ড্যাড ! আপনি আমার খুব পছন্দের একটা খাবার বানাচ্ছেন !"
"হুম প্রিয় ! বিফ চিজ রাভিওলি ইন টমেটো পারমেজান পিউরি |"
"আপনার বানানো খাবারের মধ্যে এটা আমার সবচেয়ে প্রিয় | অনেক ধন্যবাদ ড্যাড |"
রজার হাসলেন |
.
.
.
মনজুর গলা খাকারি দিয়ে মাহিরার স্টাডিতে গেলেন |
মাহিরা একটু অনাগ্রহের সাথেই বলল, "আসুন বাবা | বসুন |"
মনজুর বসে বললেন, "বৌমা ঝোঁকের মাথায় তো কোনকিছু করা যায়না তাই যা করতে হবে যে সিদ্ধান্ত নিতে হবে তা বুঝেশুনে নিতে হয় | এখন শোন, আমি আকবর আর নাফিসাকে নিয়ে এসেছি | তুমি বরং কথা বলো ওদের সাথে | এখন দ্যাখো ভুল যেহেতু আমাদের হয়েছে তাই যা বলে বলুক গিয়ে | কোনকিছু শুনবা না | এককান দিয়ে শুনে অন্যকান দিয়ে বের করে দেবে |"
মাহিরা শান্তভাবে বলল, "আচ্ছা |"
"এখন আত্মীয়দের মধ্যে এসব কি করা চলে বলো ! এখন যা হয়েছে মিটমাট করে নিলেই হলো |"
মাহিরা তার হাতের ফাইলটা রেখে ধীরে ধীরে বসল সোফায় |
মনজুর বললেন, "ওরা আসুক তাহলে কি বলো ? কথা বলে সব ঠিকঠাক করো |"
মনজুর উঠতে গেলেন কিন্তু মাহিরা নম্রভাবে বলল, "বাবা আপনি বসুন একটু | কথা আছে আপনার সঙ্গে |"
"এখন কি কথা আবার ? না এখন না | আগে কথা হয়ে নিক ওদের সাথে এরপর যা বলার বলো | এখন বললামই তো যা বলে বলুক |"
মাহিরা শান্ত কিন্তু দৃঢ়কণ্ঠে বলল, "বসুন বাবা | আগে আমার কথা শেষ হোক | এরপর ওদেরকে ডাকবেন কি ডিনার করাবেন সেটা আপনার ইচ্ছা |"
মনজুর বাধ্য হয়েই বসলেন |
মাহিরা বলল, "কয়েকদিন আগেও আপনি একেবারেই কোনরকম আগ্রহ দেখাননি ওদেরকে নিয়ে | ওদের সঙ্গে মেশেননি বা ওরা কি করবে না করবে এ নিয়ে কোন মাথাব্যথা আপনার ছিল না | তো হঠাৎ এই দুতিন দিনের মধ্যে কি এমন হল যে আপনি ওদের চিন্তায় এত পাগল হলেন ?"
"দ্যাখো গো আত্মীয়স্বজন হলে এরকম অনেক ছাড়ই দিতে হয় | এখন ওরা এরকমই তো কি করবে বলো ! ওটা মেনেই তো মিশতে হবে নাকি ?"
"আমি বিয়ের পর থেকে কখনও ওদেরকে আপনার বা আইলানের জন্য কিছুই করতে দেখিনি | তো ? যারা আগেপিছে কিছুতে নেই তাদের ভাবনা নিয়ে এত ব্যস্ত কেন আপনি ? বাবা আপনাকে বিয়ের আগে থেকেই দেখছি আমি | ভালোও নন, মন্দও নন, ব্যতিক্রমও নন | মোট কথায় আপনি বিচিত্র চরিত্র | কিন্তু যাই হননা কেন আপনি আমি কখনোই এটা ভাবিই নি কোনদিন যে আপনি জেনেশুনে ক্ষতি করবেন আপনার সন্তানদের | আইলান অনেক বলেছে আমাকে আগে যে আপনি শুধু নিজের মতেই চলেন আর খুব বাইরের মানুষের কথায় প্রভাবিত হন | আমি কিন্তু বিশ্বাস করিনি কথাটা খুব বেশি | ও অনেক বলেছে যে আপনি সবসময়ই নিজের সন্তানদের ছোট করে দেন মানুষের কাছে | তাও আমি খুববেশি বিশ্বাস করিনি কারন অনেক ভালো আচরণও আপনার আমি দেখেছি যে তাই | আমি বিশ্বাস করতাম না বলেই আইলান একদিন আমাকে বলল 'মাহিরা বাবাকে এতটুকু দেখেই তার সম্পর্কে ধারণা করে নিও না ! কারন বাবাকে আমি জানি ! বাবাকে খুব সহজেই ম্যানিপুলেটেড করা যায় আর সে মানুষের কথায় খুব নাচে |' এটা শুনেও আমি সন্দেহ করিনি | ঐযে বললাম আপনাকে, আমি ভেবেই নিয়েছিলাম যে যাই করেন না কেন আপনি কি নিজের সন্তানদের কষ্ট দেবেন অন্যের কথায় ! না | সম্ভব না | কিন্তু গতকাল রাতে আপনাকে নিয়ে আমার এই বিশ্বাসে আপনি চির ধরালেন আর আজকে যা করলেন আপনি তাতে আপনার সম্পর্কে আমার সব ধারনাই বদলে দিলেন আপনি |"
মনজুর হতবাক হয়ে বললেন, "কি বলো গো বৌমা এসব তুমি ! আমি কি করলাম ?"
"কি করেছেন ? আপনি জানতেন না যে আপনার এই আত্মীয়দের ব্যবহার এমন ? জানতেন কিনা ? জানতেন ! কিন্তু জেনেও দাওয়াত করলেন | ওরা কি অশান্তিটা কাল করল ! এমন নোংরা কথাগুলো আমাকে আর আলিজাকে বলল অথচ আপনি একটা শব্দও ওদের বিরুদ্ধে উচ্চারণ করলেন না |"
মনজুর দিশেহারাভাবে বললেন, "দ্যাখো তো ! আমি এখন কি বলতাম ওকে ? ও এরকম করছে আর তোমরাও তো বললে অনেককিছুই ! তো ? ওতো দেবর হয় তোমার সম্পর্কে নাকি ?"
"দেবর ভাবীর সম্পর্ক শিখতে হবে না আমাকে | দেবর ভাবীকে অশ্লীল কথা বলে না | তাকে গালাগালি করেনা | এরপর ও আইলানের গলা টিপে ধরল | তখনও কিছুই বললেন না আপনি | ও আলিজাকে এতগুলো কথা বলল, এরপর চেয়ার উড়িয়ে মারতে গেল তখনও চুপ আপনি | এরপর আমাকে ধাক্কা দিল সাবিনা | তখন যদি বাপি না ধরত তো আমি তো কি হাত নিজের জানিনা কিন্তু আমার বাচ্চাটা ? ওর কথা ? ওতো নির্দোষ ! ওর জন্যও কি একটু কষ্ট হলোনা আপনার বাবা ? আমি কোনদিন এই চেহারাও যে দেখবো তা কখনও ভাবি নি আমি |"
মাহিরার চোখে পানি চলে এলো | সে নিজের পেটের উপর হাত রেখে বলল, "আমার ভয়ে হাতপা ঠান্ডা হয়ে গিয়েছিল ! আমার বাচ্চাটার জন্য | আমি যদি পড়ে যেতাম তো ওর কি হত ! একবারের জন্যও কি এই কথাগুলো আপনার ভাবনায় আসেনি বাবা ?"
মনজুর চুপ করে রইলেন |
মাহিরা চোখের পানি মুছে বলল, "আমি আজ একটা প্রশ্নের জবাব চাই |"
মনজুর থতমত খেয়ে বললেন, "কি ? কি প্রশ্ন ?"
মাহিরা কঠিনস্বরে জিজ্ঞাসা করল, "আপনি কামরানকে কিকরে দাওয়াত করলেন ?"
মনজুরের পায়ের নিচ থেকে যেন মাটি সরে গেল | সে আমতা আমতা করে বলল, "সবাইকে বললাম যখন তখন ও ছিল এজন্য বলা |"
"আমি সবই শুনেছি বাবা ! এরপরেও কিকরে বললেন ওকে আসতে |"
মনজুর নির্বাক হয়ে বসে রইল |
মাহিরা আবারও চোখমুছে বলল, "একসময় মনে হয়েছিল যে সত্যিই অনেক বদলে গিয়েছেন বাবা | হয়ত এবার সত্যিই আমাদের মাথার উপর একজন ছাদের মত অভিভাবক হয়ে থাকবেন এখন | আপনি যেমন আমাদের জন্য ভাবতে শুরু করেছিলেন আর সুবিধাবাদী মানুষদেরকে সরিয়ে রেখেছিলেন তাতে এই বুঝেছিলাম আমি যে মানুষ বদলায় | যেমন আপনি বদলাচ্ছিলেন | যখনই দেখতাম আপনাকে একটা শান্তিভাব হত মনে | কিন্তু আজকে শুধুই আফসোস হচ্ছে | কেন জানেন ? বদলানো সম্ভবই নয় আপনার পক্ষে | কখনোই না | একটু হয়ত পরিবর্তন হবে আর কিছুদিন ভালো থাকবেন কিন্তু আবার কেউ একজন আপনার কানভারী করবে আর কুবুদ্ধি দেবে অমনি আপনি আবার আগের মত হয়ে যাবেন | এখন যেমন হয়েছেন ! আসলে এটাই আপনি | কেন বাবা এমন আপনি ? কেউ আপনাকে এত সহজেই ভুল পথে চালাতে পারে ? এত সহজেই ? নিজের কি কোন চেতনা কোন বিবেক নাড়া দেয়না বাবা ? কেন ?"
মাহিরা সোফার হাতল ধরে উঠে দাঁড়াল | সে চলে গেল ঘর থেকে |
মনজুর স্তব্ধ হয়ে বসে রইলেন |