আলিজা স্টাডিতে গিয়ে দেখল আইলান জানালার সামনে সিগারেট হাতে বসে | আলিজা ভাইয়ের পাশে এসে বসল |
আইলান একটু হেসে বলল, "এপাশে এসে বস | সামনাসামনি মুখে ধোঁয়া লাগবে তোর |"
আলিজা হেসে বলল, "এত মন ভার হল বৌয়ের কথায় !"
আইলান অবাক হয়ে বলল, "মানে ?"
"তুই সিগারেট ধরেছিস ইন্টার পরীক্ষার পরপরেই | এপর্যন্ত কখনও সিগারেট খাবার সময় আমাকে খেয়াল করেছিস কোথায় বসলাম আর ধোঁয়া লাগল কিনা ! এমনকি আমি অসুখে পরে শুয়ে রয়েছি আর তুই বই নিয়ে এসে আমার পাশে বসে সিগারেট ধরতি | যদি বলতাম 'সর ধোঁয়া লাগছে !' তখন বলতি 'ইস দেখা যাবে তোর বর যখন মুখের সামনে বসে বিড়ি ধরাবে তখন কি করিস !' কখনোই আমাকে হিসেবে করা লাগেনি আজ হঠাৎ ব্যতিক্রম !"
আইলান হেসে বলল, "এই পাজি ! খোঁচা মারছিস কেন হ্যা !"
"খোঁচা মারছিনা | তবে দ্যাখ তোর কথা কিন্তু সত্যি হয়নি ! এরিক ননস্মোকার |"
"কিন্তু এলকোহলিক |"
"অবশ্যই না | ও লিকার কনজিউম করে এটা সত্যি কিন্তু এলকোহলিক বলার মত লিকার এডিক্টেড না এরিক |"
"ইস ! কি মায়ারে স্বামীর প্রতি |"
"খুব কষ্ট পেয়েছিস ?"
"না আসলে ব্যাপারটাই জটিল |"
"হুম | শোন এখন |"
"এই তুই এখন এরিকের কাছে যাতো ! ও বেচারা শ্যাম্পেন হাতে বসে রয়েছে তোর জন্য | এতসুন্দর বৃষ্টিভেজা রাত আর তুই আমার কাছে সিগারেটের ধোঁয়ায় বসে আছিস !"
আলিজা আইলানের উরুর উপর একটা চাপড় মেরে বলল, "যাহ ! কিসব বলিস !"
"আঃ ! কেউ করলে দোষ না আর আমি বললে দোষ !"
"এমন কিছুই না !"
"আমি কি বুঝিনা নাকি ?"
আলিজা বিব্রতভাবে বলল, "বেশি বুঝিস !"
"হুম | ও খাবি খাচ্ছে তুই যাবি কখন ! আর প্লিজ আমি অনুরোধ করছি আজকে ওকে নিরাশ করিস না | ওর আগ্রহ উপচে পড়ছে !"
"ইস ! থামবি ভাইয়া ?"
আইলান হাসতে লাগল |
আলিজা বলল, "ভাইয়া ওঠ তো | চল এখন ভাবীর কাছে |"
"কেন ?"
"কেন আবার কি ! উনি খুব আপসেট |"
"সেটা জানি | এজন্যই তো এখানে এলাম |"
আলিজা আইলানের হাতটা ধরে বলল, "ভাইয়া উনি কি ভয়টা পেয়েছেন তা দেখেছিস তো ! সাবিনা যা করতে গিয়েছিল তা বলার ভাষা নেই কোন |"
"সেটা তো আমিও দেখেছি | আর আমি তো ওর হাজব্যান্ড ! তো ? বুঝতেই তো পারছিস কি অবস্থাটা হয়েছিল আমার মনের তখন |"
"দ্যাখ উনি আসলে এতগুলো মানসিক চাপ এক সন্ধ্যায় নিতে পারেনি | এজন্যই এরকম নার্ভাস আউটব্রাস্ট হয়েছে আর যেটা সে আনলাকিলি তোর উপরেই করে ফেলেছে | তুই হয়ত এক্সপেক্ট করিসনি সেটা আর কষ্টও পেয়েছিস | কিন্তু উনার দিক থেকেও বিবেচনা কর | প্রথমত যার হাতে উনি লাঞ্ছিত হলেন সে হল আমাদের আত্মীয় যা দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি ! এরপর মন্টি পার্টিতে খুবই অশান্তি করে গিয়েছে আর তোকে গলা চেপে ধরেছিল | এটা কতটা ভীতিকর উনার জন্য বুঝছিস সেটা ? আর পুরো ব্যাপারটায় মামা, খালামণিরা এরা নীরব দর্শক হয়ে ছিল | কিছুই করেনি তারা | তো খারাপ তো উনার লেগেছে ! এরপর দ্যাখ, একটা মা উনি | আমি নিজে কনসিভড হয়ে অসুখে পড়েছিলাম তাই আমি জানি যে একটু কিছু নিজের হলে কি ভয়টা হয় সন্তানকে নিয়ে | তো উনাকে ইচ্ছাকরে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিচ্ছিলো সাবিনা | কি অবস্থাটা গিয়েছে উনার মনে বলতে পারিস ! এরপর আবার এতদিন পর উনার বাবা এলো আর তাও এই চেহারায় | একটা সন্ধ্যায় অনেক বেশিই হয়ে গিয়েছে |"
"হুম |"
"এখন যা উনার কাছে | ঘরে যা তোর | কান্নাকাটি করছিল তখন |"
আলিজা আইলানের হাতটা ধরে তাকে দাঁড় করলো |
আইলান সিগারেট নিভিয়ে বলল, "আচ্ছা তোর এত সাহস কেন বলত ?"
"কেন ?"
"তুই কিকরে মোস্তাকিম সাহেবের মত একটা মানুষের সাথে নির্দ্বিধায় এমন তর্ক করে গেলি ! জানিস উনি কি প্রকার সাংঘাতিক মানুষ ? আচ্ছা তোকে যদি গুলি করে বসত !"
"করত না ! হলফ করে বলতে পারি যে করত না |"
"কিভাবে বললি সেটা ?"
"জানি বলে |"
"আচ্ছা সত্যি সত্যি যে তুই পিস্তল চালাতে শিখেছিস তাতো বলিসনি কখনও |"
"বলার কি আছে ভাইয়া ! এরিক আর ড্যাড দুজনেই মিলিটারি পার্সোনালস | তো ?"
"সেটা বুঝলাম ! কিন্তু এনআরএ ? সেটা কিকরে হল ?"
"ভাইয়া তুইতো এটা নিশ্চই জানিস যে এনআরএ-এর HQ হল ভার্জিনিয়াতে | আর ফেয়ারফ্যাক্স চেষ্টার থেকে মাত্র দুঘন্টার পথ | সপ্তাহে তিনটা করে ক্লাস আর দুটো ফায়ারিং সেশন | আমার খুবই দারুন লাগে এখনও |"
"পারিসও তুই !"
"উহু ! সবকিছু তো পারিনা ! তবে নিজেকে যা করে খুঁজে পাই তা পারি করতে | আমি খুবই ইনজয় করি শুটিং সেশনটা | আর আমি কিন্তু বেশ ভালো করছি মার্কসম্যান ( নিশানাবাজ ) হিসেবে !"
"তোর বরের মত ভালো ?"
"আরে না ! জানিস এটা ড্যাডও স্বীকার করে যে এরিক উনার চেয়ে ভালো মার্কসম্যান | এরিক একটা কোল্ট দিয়ে রেঞ্জ লিমিটে ( একটা বন্দুকের গুলির সর্বোচ্চ অতিক্রম্য দূরত্ব ) থাকা ইয়েল লক শুট করতে পারে | ওর হাতের নিশানা খুবই ভালো |"
আইলান আলিজার দিকে একবার চেয়ে নিচুস্বরে বলল, "হাতের সাথে চোখের নিশানাও খুবই ভালো !"
আলিজা ভাইয়ের পিঠে চাপড় মেরে বলল, "ধ্যাৎ ! হয়েছে কি তোর ! যাতো দ্রুত ভাবীর কাছে যা |"
আইলান হেসে বলল, "সত্যি রে আলিজা তুই দিনকে দিন এত চমৎকার কেন হচ্ছিস রে ! এমনিতে এরিক এত পাগল তোর জন্য ? ও তোকে যত দেখে তত প্রেমে পড়ছে | আর স্বাভাবিক সেটা | এত চমৎকার একটা মেয়ে তুই !"
"ভাইয়া আমি ওর স্ত্রী ! নতুন করে ওকে আমার প্রেমে পড়তে হবে না |"
"ও তাই পড়ছে আর বলতে গেলে রোজই তোকে আরেকটু বেশি করে ভালোবাসছে | ওকে মাঝেমাঝে লক্ষ করি আমি | কি পাগল ও তোর জন্য ! তুই ছাড়া যেন অচল ও |"
"ভাইয়া আমরা মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ | একজনকে ছাড়া অন্যজন অচল | আমিও ওর প্রতি নির্ভরশীল |"
"কে বলবে তুই এমন একটা মেয়ে হবি একদিন ! অথচ কেমন ছিলি তুই | এটা সত্যি যে বেশ আলাদা ছিলি সবসময় | সবসময় ছেলেদের থেকে দশ হাত দূরে | তোকে দেখে মনে হত খুব ভোগাবি তোর বরকে তুই | অথচ এখন তোকে দেখি আর আমি অবাক হই | কি প্রকার ভালোবাসিস তুই এরিককে ! তুই এতটা ওকে ভালোবাসিস বলেই ও এতটা তোর প্রতি আসক্ত | তুই যেভাবে তাকাস ওর দিকে ওর বোধহয় তখনই মনে হয় যে আরো বেশি তোর প্রেমে পড়া দরকার |"
আলিজা হেসে বলল, "হয়েছে তোর গবেষণা ? এবার থাম তো রে ! আর কোনকিছু বলিস না | যা প্লিজ ঘরে যা !"
আলিজা আইলানকে দরজা পর্যন্ত রেখে নিজের ঘরে গেল |
.
.
.
আলিজা ঘরে ঢুকে দেখল এরিক নেই | হয়ত বাথরুমে গিয়েছে | আলিজা ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে কানের দুল খুলতে গেল |
হঠাৎ ঘরের আলো নিভে গেল |
আলিজা অবাক হয়ে তাকিয়ে বলল, "এরিক ! কোথায় তুমি ?"
আলিজা হাতড়ে হাতড়ে দরজার দিকে গেল, দরজা বন্ধ | তার হঠাৎ ভয় হল | আজকে যা হয়েছে অনুষ্ঠানে তাতে ভয় হওয়াটা স্বাভাবিক |
আলিজা আন্দাজে সামনে এগিয়ে এসে আবার ডাকল, "এরিক ! আমার ভয় করছে | কথা বলো এরিক |"
হঠাৎ কেউ পিছন থেকে জড়িয়ে ধরল | আলিজা অস্ফুট আর্তনাদ করে উঠল | তৎক্ষণাৎ ঘরে ডিমলাইট জ্বলে উঠল |
আলিজা ঘুরে দাঁড়িয়ে এরিককে শক্তকরে জড়িয়ে ধরে বলল, "ভয় দেখাচ্ছিলে কেন আমাকে তুমি !"
এরিক আলিজাকে বুকের মাঝে চেপে ধরে বলল, "ভয় ? আমি রয়েছি সাথে আর তোমার ভয় হচ্ছে ? আমি থাকতেও ভয় ?"
"আজকে যা হল এরপর ..........."
"এরপর তোমার ধারণা হল আমাদের শয়নকক্ষে ওই স্ক্যামব্যাগ (বদ) তার কোন বন্ধুকে এসে লুকিয়ে থাকতে বলেছে | ওতো আর আসতে পারবেনা কারন আজরাতে ওর অন্তত নড়াচড়া করার মত অবস্থা নয় শরীরের | আশ্চর্য লিজ তুমি ভয় পেয়েছো !"
"হ্যা |"
"তাও আমি থাকতে ?"
"হ্যা | তুমি ছিলে না | লুকিয়ে ছিলে |"
"ওহ ! আমি দুঃখিত লিজ | আমি শুধু একটু চমকে দিতে চেয়েছি তোমাকে |"
"দিয়েছো |"
"তাই ?"
"হুম |"
এরিক আলিজার থুতনীটা তুলে ধরে তাকে অধরবন্দি করল |
.
.
.
"ঘরে যাবে লিজ ?"
"চলো |"
এরিক আরো শক্তকরে আলিজাকে জড়িয়ে নিজের কাছে টেনে নিয়ে মেঝেতে ছড়িয়ে বসল |
আলিজা হাতটা এরিকের বুকের উপর রেখে জিজ্ঞাসা করল, "কি হল ? চলো ঘরে |"
"না | আরো কিছুক্ষন পর |"
"বৃষ্টি জোরে আসবে |"
"আসুক |"
"ভিজে যাবো তখন |"
"ভিজতে হলে ভিজবো |"
আলিজা হেসে বলল, "কোন লাভ নেই তোমাকে কোনকিছু বলে | আচ্ছা অন্তত মেঝে থেকে ওঠো |"
"না | এখানেই বেশি ভালো লাগছে আমার |"
"তুমি পারোও |"
"হুম |"
আলিজা এরিকের থুতনিতে আলতোকরে একটা চুমু দিলো | এরিক শক্তকরে নিজের বুকের মাঝে চেপে ধরল আলিজাকে |
ঠান্তা ভেজা বাতাস বইছে আর বাতাসে সোঁদা মাটির ঘ্রান | আকাশটা লালচে হয়ে রয়েছে জমাট মেঘের আলোয় | আলিজা প্রানভরে একটা বড় নিঃস্বাস নিলো | জীবনের কিছু মুহূর্তের কোন ভাষায় প্রকাশ নেই সত্যিই |
এরিক আলিজার মাথায় একটা চুমু দিয়ে বলল, "লিজ, বলো আমাকে |"
"কি এরিক ?"
"যা তুমি চেপে রাখো নিজের মাঝে |"
"আমি কি লুকালাম ?"
"তোমাকে প্রতিটা নিঃশ্বাসে জানি লিজ | এজন্যই আজ জিজ্ঞাসা করলাম |"
আলিজা এরিকের হাতটা নিজের হাতে নিয়ে বলল, "কি বলব এরিক ?"
"প্রায়ই এমন বৃষ্টির রাতে দেখি তুমি আমার এতটা কাছে থেকেও তুমি হঠাৎ কিছু মুহূর্তের জন্য নিজের মাঝে চলে গিয়ে কোথায় যেন হারাও | আবার ফিরেও আসো | কিন্তু একটা অন্যরকম ভাবনার জগতে থাকো কিছুসময় | এ আমি বিয়ের পর থেকেই দেখেছি প্রতিটা বৃষ্টিমুখর রাতে | আমাকে কি বলা যায় লিজ ? আমি শুনতে চাই |"
আলিজা হেসে বলল, "এমন কোন বিশেষ কারন নেই এরিক | এমনিতেই |"
এরিক আলিজার খোলা চুলে আঙ্গুল চালিয়ে দিয়ে বলল, "থাক, হয়ত এ অনুভুতিটা তুমি শুধু নিজের রাখতে চাও | না বললে আমার এতে জোর নেই কোন | তোমার ভালোলাগাটাই মুখ্য আমার জন্য |"
আলিজা মাথাটা এরিকের বুকের মাঝে রেখে চুপ করে রইল |
এরিক দুহাতে আলিজাকে জড়িয়ে ধরে নরমকণ্ঠে বলল, "আমি যতদিন রয়েছি তোমার সব ভাবনা আমার | কখনও নিজেকে একা ভাববে না লিজ | আমি কাছে থাকি বা দূরে থাকি সবসময় তোমার পাশে তোমার সাথে আছি আমি |"
আলিজা চোখবন্ধ করে চুপ করে রইল |
আলিজা কিছুক্ষন পর কথা বলল, "এরিক ?"
"বলো সুইটহার্ট |"
"জানো এই বৃষ্টির রাতগুলোতে আমার মাকে আমার খুব মনে পড়ে |"
"বলো |"
"একটা রাতের ঘটনা মনে পড়ে |"
"কি ঘটনা ?"
"তখন আমি সদ্য ইউনিভার্সিটিতে ঢুকেছি | তোমরা যাকে বলো কলেজ | তখন | একরাতে অনেক বৃষ্টি | ইলেক্ট্রিসিটি নেই | বাবা ব্যবসার কাজে কোথায় যেন গিয়েছে আর ভাইয়া স্টাডিট্যুরে | ঘরে শুধু মা আর আমি | রাতে খেয়েদেয়ে মা আর আমি আমরা দুজন দুঘরে ঘুমাতে গিয়েছি | অনেকরাতে ঘুম থেকে উঠে আমি দেখি কি জানো মা বারান্দায় বসে আছে | আমি ধীরপায়ে সামনে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম 'মা ? কি করছো ?" মা বলল 'বৃষ্টি দেখি ! কি সুন্দর বৃষ্টি হচ্ছে !' মা একটা লম্বা শ্বাস নিয়ে বলল 'দ্যাখ বাতাসে কি সুন্দর সোঁদা মাটির ঘ্রান ! কি সুন্দর না ?' জানিস বৃষ্টিতে মাটি ভিজলে এই ঘ্রান বের হয় | আমার এতো ভালোলাগে এই ঘ্রাণটা !' আমি তাকিয়ে রইলাম মায়ের দিকে | মা উঠে দাঁড়িয়ে বলল 'চা খাবি ? আয় খাই !' সে আমার অনুমতির অপেক্ষা না করেই চা বানাতে গেল আর দুকাপ চা নিয়ে আমার কাছে এসে বসল | সেরাতে মায়ের মুখটা ছিল অদ্ভুত আনন্দময় ! কোন দুশ্চিন্তা কোন ভাবনা কোন উদ্বেগ কোন টানাপোড়ন ছিলোনা সে মুখে | তখন দেখলাম মায়ের আরেকটা চেহারা আছে | যে চেহারাটা শিশুসুলভ আনন্দে হাসে | যে বৃষ্টি দেখলে চোখ চকচক করে তাকায়, মাঝরাতে জেগে উঠে | মার সেই মুখটা আমার প্রতিটা বৃষ্টির রাতে মনে পড়ে |"
এরিক আলিজার চুলে আঙ্গুল চালিয়ে কপালে একটা চুমু দিয়ে বলল, "লিজ তুমি খুবই ভালোবাসো তোমার মাকে | এতটাই যে তার চলে যাওয়াটা কোনোই প্রভাব ফেলেনি তোমার ভালোবাসার তীব্রতায় | আর কি জানো ?"
"কি ?"
"উনিও তোমাকে ভালোবাসতেন | কিন্তু সেটা প্রকাশ করতে পারেননি বা এও বলা যায়যে তিনি দ্বিধা করেছেন | তোমার নানী অনেকবড় অন্যায় করেছেন তোমার মায়ের সঙ্গে | তিনি একটা দায়িত্বহীন আর আত্মকেন্দ্রিক মানুষ বলেই নিজের সুখের জন্য তোমার মাকে তিনি এতবড় বঞ্চনা করেছেন |"
"কেন ? বঞ্চনা বলছো কেন ?"
"এটা তো বঞ্চনাই লিজ | তিনি নিজের সন্তানদের তোমার মায়ের ঘাড়ে চাপিয়েছেন | এতে সে কতটা প্রতারিত হয়েছে তা ভাবতে পারো ? আর এটা সত্যি যে তোমার মা বুদ্ধিমান ছিলেন না | বুদ্ধিমান হলে সে তোমাদের চেয়ে বেশি নিজের ভাইবোন আর মাকে ভালোবাসতো না বিশেষকরে এটা জেনে যে তারা এতটা স্বার্থপর আর ঈর্ষাপরায়ণ | তোমার আত্মীয়রা খুব বড় অন্যায় করে গিয়েছে তোমাদের সাথে | তারা তোমাদেরকে শুধু বঞ্চিতই করেনি বরং অনেকবড় অপরাধ করেছে তোমাদের সাথে | তারা নিজেদের উদরপূর্তি করতে তোমাদের মাকে তোমাদের কাছ থেকে ছিনিয়ে রেখেছিল | একটা বোনের দায়িত্ব একটা মায়ের চেয়ে বেশি নয় |"
"জানি এসবই আমি |"
"লিজ ?"
"বলো |"
"মন খারাপ করো না | ভালোবাসা কখনও বিফলে যায়না |"
"সত্যি ?"
"হুম | নিজেকে দিয়েই জানি | তবে আমি ব্যতিক্রম | আমার ভালোবাসাকে আমি কারো জন্য ছাড় দেব এতবড় বদান্যতা নেই আমার |"
"পরিস্থিতি বাধ্য করে এরিক | তুমিও কি হওনি বাধ্য একসময় ?"
"সেটা সত্যি | এজন্যই তোমার কষ্টটা বুঝি আমি | একসময় ম্যাডিকে আমি এত ভালোবেসেও পাইনি | ওকে যখনই দেখতে যেতাম আর চলে আসার সময় ও কিছুক্ষন ছলছলে চোখে আমার দিকে তাকিয়ে থেকে হঠাৎ 'ড্যাডি ডোন্ট গো !' বলে আমার বুকের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ত তখন ভেতরথেকে আমি ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে যেতাম | উপায়হীন ছিলাম | কিন্তু সময় আর পরিস্থিতি সহায় হল আর সবচেয়ে বড় কথা তুমি আমার জীবনে এলে | তুমি ছিলে বলে ওকে পাওয়া হল আমার | তাই তো বললাম আমি তোমার কষ্টটা বুঝি | আমি ভাগ্যবান যে তুমি আমার পাশে ছিলে | কিন্তু তুমি এতটা ভাগ্যবান ছিলেনা কেননা তোমার পাশে কেউই ছিলোনা যখন তোমার আত্মীয়রা এই অন্যায়গুলো করেছে |"
"সেটা সত্যি এরিক |"
"লিজ ?"
"কি ?"
"আর কোনরকমের কোন অন্যায় কেউ তোমার সঙ্গে করতে পারবে না | আমি রয়েছি সবসময় তোমার পাশে |"
আলিজা হাসল একটু মিষ্টিকরে |
এরিক একটু হেলে মেঝেথেকে হাতড়ে হাতড়ে কি যেন খুঁজতে লাগল |
আলিজা সোজা হয়ে বসে জিজ্ঞাসা করল, "কি খুঁজছো এরিক ?"
এরিক কি যেন হাতে নিয়ে বলল, "পেয়েছি |"
"কি ?"
"কিছুনা |"
আলিজা এরিকের হাতে ধরে দেখে বলল, "এরিক এটা টম ফোর্ড ! আর তুমি এই পোশাক এমন মেঝেতে ফেলে রেখেছিলে ?"
"তখন ফেলেছিলাম বলেই এখন খুঁজে পেলাম |"
"তুমি কখনই এসব কেন খেয়াল করো না ? এটা বৃষ্টিতে ভিজে নষ্টও তো হতে পারত |"
"হয়নি কারন ভেজেনি |"
এরিক কোটটায় আলিজার গা জড়িয়ে তাকে নিজের কাছে টানে নিলো আবার |
আলিজা হেসে ফেলে বলল, "পাগল তুমি !"
"হয়ত |"
"হয়ত না ! সত্যি |"
"তোমার গা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছিলো বাতাসে | ঠান্ডা লেগে যাবে | এই সপ্তাহখানেক আছি | এসময়টা অসুখে পড়ো আমি একেবারেই চাইনা |"
"আর তুমি ? এ অবস্থায় রয়েছো তাও কার্পেটে বসে | তোমার কোন শীত করছেনা এই বলতে চাও ?"
এরিক বিশেষভাবে হেসে বলল, "না | তোমার কারনে উষ্ণতা অনুভব করছি |"
আলিজা লাজুকভাবে হেসে বলল, "উফফ ! কিসব যে বলো |"
"কি বললাম ! বলো ?"
"কিছুনা |"
"লিজ ? একটা ব্যাপারকি জানো ?"
"কি ?"
"যেটুকু মুহূর্তগুলো আমি তোমার সঙ্গে থাকি, তুমি ছাড়া আমার আর কোন চিন্তা আর কোন ভাবনা থাকেনা |"
"এরিক !"
"সত্যিই তাই | লিজ ?"
"বলো ?"
"একটা প্রশ্ন করি ?"
"করো |"
"হয়ত রাগ হবে |"
"বলো এরিক |"
"আচ্ছা কখনও কি গ্লেনের কথা মনে পরে তোমার ?"
"মাঝে মধ্যে |"
"কি মনে পড়ে ওকে নিয়ে ?"
"অনেককিছুই |"
"যেমন ?"
আলিজা হেসে বলল, "যেমন উনি যেমন মানুষ ছিলেন | প্রচন্ড ব্যক্তিত্ববান, গম্ভীর কিন্তু সদালাপী, সুবেশা, প্রচন্ড সুদর্শন, অত্যন্ত সচেতন, বুদ্ধিদীপ্ত | অর্থাৎ প্রচন্ড পছন্দ হওয়ার মত ব্যক্তিত্ব একজন |"
এরিক একটু নীরব হয়ে গেল |
আলিজা বলল, "উনার কথাগুলো মনে পড়ে |"
এরিক একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, "তুমি কি এখনও গ্লেনকে পছন্দ করো ?"
"বললামই তো | উনার ব্যক্তিত্বই এমন যে পছন্দ হতেই হয় তাকে |"
এরিক ছোট করে বলল শুধু, "ও !"
"তার সম্পর্কে অনেক ভাবতাম তাই অনেককিছুই মনে হত আর ভাবতাম তাকে হয়ত জানি আমি | অবশ্য পরে জান্লামও |"
"আমাদের বিয়ের আগেই সেই ভাবাটা নিশ্চই ?"
"হুম |"
দুজনেই চুপ করে রইল |
আলিজা কথা বলল, "যখন জানলাম তখন এও জানলাম |"
"কি জানলে ? এই যে ও কতটা বিশেষ একজন মানুষ ? ও প্রেমে পড়ার মত ব্যক্তিত্ব এই ?"
"না | সেটা নয় |"
"তো ?"
আলিজা একটা ছোট নিঃশ্বাস ফেলে বলল, "জানলাম যে সে হয়ত অনেকবড় একজন ব্যক্তিত্ব আর প্রেমে পড়ার মত ব্যক্তিত্ব | কিন্তু একটা পার্থক্য !"
"কি সেটা ?"
"ড. মারলেইয়ের পক্ষে কখনোই তোমার মত কেউ একজন হওয়া সম্ভব না |"
এরিক কৌতুকের সাথে হেসে বলল, "আমি তো আমিই | আমার মত কেউ কেন হবে ? আর তাও গ্লেনের মত কেউ !"
"সেটাই | ড. মারলেইয়ের পক্ষে সেটা সম্ভব না | তার পক্ষে একইসাথে 'ডাউন টু আর্থ এন্ড এট্রাকটিভলি সুইট' ( মাটিঘেঁষা আর আকর্ষণীয় মধুর ) হওয়া সম্ভব না | মন থেকে অর্থহীন কিন্তু সুশ্রাব্য কথা বলা সম্ভব না ! কার্নিভ্যালে ঘুরতে গিয়ে হুট করে কর্নকব ভেন্ডারের কাছে গিয়ে মসলাদার ভুট্টা অর্ডার করে কামড় বসানোর পর ওয়ালেট খুলে 'লিজ আমাকে ভুট্টাটা কিনে দাও ! আমার কাছে তো একটাও খুচরো নেই ! একে এখন কি দেই আমার একটা ১০০ ডলার বিল আছে শুধু ! একে যদি একথা বলি তো আমাকে ভুট্টা দিয়েই মারতে শুরু করবে !' এধরনের কথা বলা সম্ভব নয় ড. মারলেইয়ের পক্ষে |"
এরিক তাকিয়ে রইল |
আলিজা এরিকের চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, "তার পক্ষে কখনোই এরিক হওয়া সম্ভব নয় | এমন একজন মানুষ হওয়া সম্ভব নয় যাকে তার ত্রুটিসমেত ভালোবাসা যায়, অজান্তেই যাকে মনে মনে চাওয়া যায় এমন কেউ হওয়া সম্ভব নয় |"
এরিক হেসে ফেলল |
আলিজা বলল, "তোমাকে আমি যতটা ভালোবাসি এতটা কখনোই কাউকে ভালোবাসা আমার পক্ষে সম্ভব নয় | ড. মারলেইয়ের মত কেউ হলেও নয় | আর সবচেয়ে বড় সত্যিটা হল এই যে আমার জীবনে তুমি আমার জীবনসঙ্গী হয়ে আসার পর আর কোনকিছুর জন্য দেবার মত জায়গা আমার মনে নেই | সব শুধু তোমার দখলে | তাও আমার সবসময়ই মনে হয় কম পরে যাচ্ছে তোমার জন্য আমার ভালোবাসা |"
এরিক কোন কথা না বলে মৃদুহেসে আলিজার ঠোটদুটোকে নিজের ঠোঁটের মাঝে বন্দি করল |
.
.
.
মাহিরা চায়ের কাপটা টেবিলের উপর রাখল |
আইলান ব্যস্তভাবে বলল, "আরে করছটা কি ! তুমি কেন নিয়ে এলে ? ময়না আপাকে বললেই তো ও করে দিত |"
মাহিরা বসে বলল, "আপা সকাল থেকেই নাশতা বানানো নিয়ে ব্যস্ত | আর এ আর এমন কি কাজ যা আমি করে দিতে পারব না ? এতবেশি বিছানায় থাকাটা আমার অভ্যাস না | আর আমি চাইও না |"
আইলান হাতের সিগারেট নিভিয়ে দিতে গেল, মাহিরা বলল, "আরে কি করছো কেবল তো ধরালে ?"
"থাক পরে আবার ধরাবো |"
"আমার অসুবিধা হবে না | আমি তো এপাশে বসেছি | খাও তুমি |"
আইলান সিগারেট নিভিয়ে দিয়ে বলল, "না মাহি | ঠিক না এটা | রইল এখন, পরে খাওয়া যাবে | এখন চা-ই খাই বরং |"
মাহিরা হেসে বলল, "আচ্ছা এত চিন্তা কেন তোমার আমাকে নিয়ে বলো তো |"
"তোমাকে নিয়ে না ভাবলে কাকে নিয়ে ভাববো ? আর কে আছে যাকে নিয়ে এত ভাবা যায় ? আর ভাবার মানুষটা ভাববার মত হতে হয় | যেমটা তুমি |"
"ইস ! আজকে যেন প্রেম বেশি বেশি হচ্ছে |"
"কেন ? এ অভিযোগ কেন ? আগে কি কম কম প্রেম ছিল ? মোটেই না |"
মাহিরা হেসে ফেলল আবার |
আইলান চেয়ে চুমুক দিয়ে জিজ্ঞাসা করল, "আলিজাকে দেখছিনা যে ?"
মাহিরা মুখটিপে হেসে বলল, "এলে তো দেখবে !"
আইলান মাথানেড়ে হেসে বলল, "আজকে বোধহয় এতদ্রুত এরিক ওকে ছুটি দিচ্ছে না ! এ এক মানুষ বটে ! নিজের বৌয়ের বেলায় ষোলআনা নিজের ভাগ বুঝে নেয় ! কে কি ভাবল তা নিয়ে থোড়াই কেয়ার ওর |"
"এক্কেবারে সঠিক করে | এরিক যেমনই হোকনা কেন খুবই দারুন একজন মানুষ | আসলে ওকে বোঝা সবার পক্ষে সম্ভব না | আলিজা বুঝেছে বলেই ও এতটা সমীহ করে এরিককে | গতরাতে ও যা করেছে সেটার জন্য আমি কৃতজ্ঞ ওর কাছে |"
"এটা আসলেই ওর একটা বিরাট ব্যাপার যে ও কারো উপকার করতে দ্বিধা করেনা | বাংলায় আমরা যাকে বলি অকুতোভয় ও হচ্ছে সে চরিত্র |"
"আরেকটা ব্যাপার কি জানো ? এটা এরিক পারছে অনেকটা আলিজার জন্য | আলিজা ওর কাজে আর নীতিতে ওকে বাধা দেয় না | এজন্যই দুজনের বোঝাবুঝিটা এতটা শক্ত | আলিজা এরিকের স্বভাবটা বোঝে | ও জানে যে এরিক এরকম | সাহসী আর বেপরোয়া, একইসাথে প্রতিবাদী | যদি এ ব্যাপারটা আলিজা বাধা দিত বা দমিয়ে রাখত ওকে নিষেধ করে তো এরিক কখনোই ওকে এতটা ভালোবাসত না | এরিক এজন্যই ওর উপর এতটা আসক্ত কারন আলিজা ওকে ও হিসেবেই ভালোবাসে | আর সেটাই ওর জোর |"
আইলান একটু হেসে বলল, "এত কখন দেখলে তুমি ?"
"আগেই দেখেছি আমি সেটা তবে এই আড়াইমাসের প্রতিটা দিন বলতে পারো আমি আরো ভালোকরে লক্ষ করলাম ওদের | আর সেজন্যই জানলাম সবটা |"
মাহিরা একটু চুপ থেকে বলল, "আইলান একটা কথা বলব ?"
"বলো | এতে অনুমতির কি হল ?"
"আচ্ছা কাল বাপি এমন হুট করে এলো সেজন্য কি তুমি রাগ করেছো ?"
আইলান বলল, "অবশ্যই না | মাহি তুমি উনার মেয়ে | উনি আসতেই পারে তোমার কাছে |"
"আইলান বাপি কেমন সেটা আগেই বলেছি তোমাকে | কিন্তু কাল যা করেছে বাপি আলিজার সঙ্গে সেটার জন্য আমি ক্ষমা চাইছি |"
"ছি মাহি ! তুমি কেন ক্ষমা চাইছো ? প্লিজ এসব কিছু করো না | আর আলিজা যখন সে ব্যাপারটার জন্য উনাকে ইতোমধ্যে শায়েস্তা করেছে এরপর আর তোমার এনিয়ে একটুও বিব্রত হবার কিছুই নেই |" "তুমি রাগ করোনি ?" "করিনি তা বলা ঠিক না | আলিজাকে কেউ কিছু বললে আমি অবশ্যই কষ্ট পাই | আর কালকের ব্যাপারটাও অনেক বিব্রতকর | তবে উনি যতটা লজ্জিত হয়েছেন এরপর আরকিছু এ নিয়ে না ঘাঁটাঘাঁটি করাই ভালো |" "আমি একথা কাল বলেছি আলিজাকে কিন্তু ও কি ভাবছে আমি কিছুই বুঝতে পারছিনা |" "ও বলবেনা ও কি ভাবছে | তবে মাহি কাল নিজের অজান্তেই তোমার বাবা একটা ভালোকাজও করেছেন | কাল উনি বুঝিয়ে দিয়েছেন যে মন্টির মত একটা ইতর চাইলেই তোমার দিকে এগুতে পারবেনা কারন তোমার পেছনে তোমার বাবার মত একজন মানুষ আছে যে কিনা রীতিমত ভয়ংকর | আর একটা জিনিস আমি লক্ষ করেছি কাল |"
"কি ?"
"উনি হয়ত তোমাকে অপছন্দ করেন কিন্তু উনি নিজেও জানেননা যে উনি তোমাকে কতটা ভালোবাসেন | এটা আলিজা দেখেছে বলেই গতরাতে আলিজা এতটা নিশ্চিতভাবে উনার সাথে কথা বলেছে |"
"উনি আমাকে কখনোই ভালোবাসেনা আইলান | কখনোই না |"
"হয়ত ! কিন্তু তোমাকে ধাক্কা দেয়ায় সাবিনার প্রতি উনার রাগটা উনার মায়ার অদ্ভুত প্রকাশ ছিল গতরাতে | আমি লক্ষ করছিলাম উনার মুখের দিকে | যে সন্তানের খোঁজ রাখেননি অথচ তার সামনে সেই সন্তানের ক্ষতি চেষ্টায় কি ক্ষোভ তার ! আলিজা হয়ত ঠিকই বলেছে মাহি | হয়ত সাতবছরে অনেককিছুই বদলে গিয়েছে |"
মাহিরা চুপ করে রইল | দুজনে নীরবে চা খেতে লাগল |