এরিক নিজের আর আলিজার জন্য একত্রে একটা বিশেষ উপহার কিনেছে | সে আলিজার আর নিজের জন্য একজোড়া ভোলগারি-র 'হিম এন্ড হার' ওয়াচ কিনেছে | প্রায় একই রকম দেখতে একজোড়া ঘড়ি | এরিকের হাতেরটা বড় আর কিছুটা নকশায় পুরুষালি অন্যদিকে আলিজারটা আকারে একটু ছোট আর স্ত্রীসুলভ | তবে ঘড়িদুটো একই জোড়ার দুটি তা স্পষ্ট বোঝা যায় |
আলিজা এরিকের জন্য তার অতি পছন্দের ইজিপ্সিয়ান কটনের শার্ট আর কারেন্ট এলিয়ট জিন্স উপহার দিয়েছে |
সকালে সবার সাথেই নাশতায় বসল এরিক আর আলিজা |
আইলান আলিজাকে কিছুক্ষন দেখে হেসে বলল, "আজ বুঝছি কেন গতকাল ওই ছোকরা তোকে দেখে লাইন মারছিলো !"
আলিজা বিব্রতভাবে বলল, "ভাইয়া ! কি বলছিস ? আজব সব কথা ! এখানে আমার বাচ্চারা, ড্যাড, বাবা সবাই রয়েছে |"
"তোর বাচ্চাদের বাবাই আমাকে সবার আগে দেখিয়েছে !"
"যাহ ! কি বলিস !"
"জিজ্ঞাসা কর তোর বাচ্চাদের বাপ এন্ড ড্যাডের ছেলে এরিককে ! দ্যাখ ও কি বলে ! ও হেসে অস্থির ছেলেটা তোকে ফলো করছিলো দেখে !"
"তোরা দুটোই বদ !"
মাহিরা কৃত্রিম ধমক দিয়ে বলল, "আলিজা তুমি আমার সামনে আমার স্বামীকে বদ বলছো !"
"বদ না ভাবি ! ও একটা মহাবদ হয়ে গেছে দেখছি !"
মাহিরা হা হা করে হেসে ফেলল |
আলিজা ছেলেকে খাইয়ে দেবার জন্য কোলে নিতে গেল কিন্তু রজার দিলেননা |
রজার নাতিকে টেনে নিজের কোলে বসিয়ে নিয়ে বললেন, "না প্রিয় এলিজ ! আজকে নয় ! আজ তুমি শুধু স্ত্রী আর প্রণয়িনী | আর আমি আজ ফুলটাইম গ্র্যান্ডড্যাড এন্ড ম্যানি !"
আলিজা বাধা দিয়ে বলল, "কিন্তু ড্যাড আপনি সারাদিন নিজে ঘোরাফেরা না করে ওকে নিয়ে ব্যস্ত থাকবেন কেন ? এন্ড হিজ কোয়াইট আ হ্যান্ডফুল ( ওকে সামলানো খুব সহজ নয় ) !"
এরিক বাপের দিকে চেয়ে হাসল |
রজার বলল, "না ! আমি রয়েছি আজ ওর জন্য | আর ম্যাডিও রয়েছে |"
ম্যাডিসন বলল, "হ্যা মা ! তুমি আমাদের নয়, আজ শুধু ড্যাডিকে সময় দাও |"
আলিজা একটু হেসে বলল, "ঠিক আছে | কিন্তু আমি অন্তত আমার বাচ্চাদের নাশতা করাই |"
ম্যাডিসন বলল, "মা আজ তাও নয় |"
মাহিরা ওয়েটারকে চা দিয়ে যেতে বলল |
চায়ের কাপ হাতে রজার এরিককে চোখটিপে হেসে নিচুগলায় বললেন, "সান ! জাস্ট এজ আই প্রমিজড ! ( বাবা ! তোমাকে আমি যা কথা দিয়েছিলাম ! )"
আলিজা শুনে ফেলে দুজনের দিকে চেয়ে বলল, "মানে কি এর ? এরিক ?"
এরিক দ্রুত চা শেষ করার জন্য বড় চুমুক দিয়ে বলল, "কিছুনা |"
"তুমি ড্যাডকে বলেছো ?"
মনজুর পাশফিরে রজারের কাছ থেকে এইব্রাহামকে কোলে নিতে গেলেন | মনজুর ঘুরতেই এরিক চট করে আলিজার ঠোঁটে চুমু বসিয়ে দিল | আলিজা ব্যস্ত হয়ে সরে গেল | লজ্জায় তার চেহারা লাল হয়ে উঠল | ভাগ্যিস মনজুর তখন নাতিকে কোলে নিতে ব্যস্ত বলে দেখেননি !
এরিক মৃদুস্বরে বলল, "যদি এটা না চাও যে আমি আবার একই কাজ করি তো এ নিয়ে আর কথা নয় | আজকের দিনটা আমাদের শুধু |"
মনজুর ফিরে অবাক হয়ে বলল, "কিরে আলিজা খাচ্ছিস না কেন ?"
আলিজা কোনরকম একটু হেসে বলল, "খাচ্ছি বাবা |"
এরিক হাতটা আলিজার কোলের উপর রাখল |
নাশতা শেষ হলে আইলান এরিককে বলল, "এরিক আজকের দিনটা মেঘলা | তোমরা আজ লেকের পাড়ে ঘুরে আসো কিছুক্ষন |"
.
.
.
আলিজা তার চায়ের কাপটা নিয়ে তাদের ভিলার বারান্দায় এসে বসল |
এরিককে আরো এককাপ চা নিয়ে বসতে দেখে আলিজা বলল, "তুমি তো এত চা খাও না এরিক তো আজ কি হল ?"
এরিক বলল, "আজ ইচ্ছা হল |"
"এরিক ?"
"কি সুইটহার্ট ?"
"আজ অনেক দারুন লাগছে তোমাকে |"
এরিক আলিজার গালে গাল লাগিয়ে বলল, "ধন্যবাদ মাই সোয়ান !"
"একটা চিন্তা হয় আমার প্রায়ই এরিক ?"
"কি লিজ ?"
"থাক এখন বলবোনা |"
"বলো লিজ |"
"চিন্তা হয় যে তুমি কি পরেও এভাবেই আমাকে ভালোবাসবে, এতটাই চাইবে ? তুমি এখনও আগেরমতোই আকর্ষণীয় আছো ! আমি কখনোই খুব সুন্দরী ছিলাম না | আর আমি হয়ত আগেরমত নেই আর | এরপর যদি তুমি আমাকে ধীরে ধীরে কম ভালোবাসো ? তখন কি হবে ?"
এরিক হেসে আলিজার কাঁধের উপর হাত রেখে বলল, "কি মনে হয় তোমার আমি বদলে যাব ? আচ্ছা যদি তুমি বদলে যাও ?"
আলিজা চমকে উঠে বলল, "আমি কেন বদলাবো ?"
"যদি তুমি কম ভালোবাসো আমাকে তো ?"
"কি যা তা বলছো ?"
"যদি তুমি আমাকে এখন যতটা চাও তা না চাও তো ?"
"এরিক থামো তো !"
"লিজ একটা সত্যি বলি তোমাকে আমি আজ | সেটা হল তুমি আমার চিরদিন | তোমার প্রতি অন্যকারো দৃষ্টি আমি সহ্য করতে পারিনা |"
এরিক ভিলা থেকে বেরুবার পর একটু দূরে বারান্দায় দাঁড়ানো ছেলেটার দিকে আবার তাকালো |
এবার সামনে গিয়ে একটা থাপ্পড় বসিয়ে বলল, "তোমাকে গতকালই বলেছি যে ওর দিকে তাকিওনা ! ও আমার স্ত্রী | আমার সন্তানদের মা ও | এই কথা কয়েকবার তোমাকে কালই বলেছি আমি | কিন্তু তুমি এরপরেও এসবকিছু ভুলে গিয়ে শুধু একটা 'আকর্ষণীয় রমণী' বলে ওকে অনুসরণ করে যাচ্ছ কাল থেকে ! তুমি কি ভেবেছো ওর পিছুপিছু এমন জোঁকের মত এঁটে থাকলে ও তোমাকে ভাও দেবে ? আর একবারও যদি ওকে হয়রানি করো তুমি তো আমি তোমাকে ওই ইটগুলো বেঁধে পানিতে ফেলে দেব |"
আলিজা হতবাক হয়ে দেখছিলো এতক্ষন | ছেলেটাকে সে গতকাল থেকে দেখছে সেটা সত্যি | কিন্তু আলিজা ভেবেছিল ছেলেটা ম্যাডিসনকে দেখছে তাই সে মেয়েকে সামলে রেখেছিল | কিন্তু এখন তো দেখাগেল সম্পূর্ণ উল্টো কাহিনী !
ছি ! এসব কি আচরণ এই ছেলের !
তার ছেলেমেয়েরা "মা" "মা" ডাকছে তাকে আর এরিক সারাদিন সঙ্গে অথচ তাও একটা বিবাহিতা, সন্তানের জনয়িত্রীকে সে এমন নোংরা দৃষ্টিতে দেখছে ! আলিজার গা ঘিনঘিন করে উঠল |
এরিক সেখান থেকে নেমে এসে বলল, "লিজ এসো একটু ঘুরে আসি আমরা | সতেজ বাতাসে তোমার খারাপ লাগা কমে যাবে | আর মনও ভালো হবে |"
এরিক হাত বাড়িয়ে দিল | আলিজা হাতটা ধরে এগিয়ে এলো |
.
.
.
লেকের পাড়ে এসে আলিজার মন ভালো হয়ে গেল | কি সুন্দর দৃশ্য চারিদিকে ! মেঘলা আকাশ যেন লেকের আয়নায় মুখ দেখছে, ঢেউগুলো যেন ছন্দের নৃত্য করছে, বাতাসে গাছের পাতার ঝিরিঝিরি কম্পন আর বাতাসে মাটির ঘ্রান ! কি চমৎকার মাদকতা !
আলিজা এরিকের হাতটা জড়িয়ে ধরে হাটতে লাগল | খুব দারুন লাগছে এ মুহূর্তগুলো |
আলিজা চুলগুলো উড়ে বারবার এরিকের গায়ে পড়ায় আলিজা এলোখোঁপা করতে গেল |
এরিক বাঁধা দিয়ে বলল, "থাক লিজ |"
"কেন ?"
"এমনিতেই |"
"তোমার গায়ে পড়ছে বারবার |"
"আমার তো কোন সমস্যা হচ্ছেনা তাতে | তুমি কেন ব্যস্ত হচ্ছো ?"
"ঠিক আছে |"
এরিক হাতটা আলিজার কাঁধে রেখে বলল, "খোলাই থাক |"
"কেন ?"
এরিক আলিজার চুলের উপর চুমু দিয়ে বলল, "অনেক সুন্দর লাগছে তাই | আর আজ আমার সব চাওয়াই রাখতে হবে তোমাকে |"
আলিজা হেসে বলল, "এখনও মনে আছে তোমার এ কথাটা ?"
"সবসময় থাকবে |"
এরিক আর আলিজা তাদের প্রথম বিবাহবার্ষিকীতে পরস্পর এই অঙ্গীকার করেছিল তারা তাদের প্রতি বিবাহবার্ষিকীর দিনে একে অন্যের সব ভালোবাসাময় চাওয়া পূরণ করবে কোন দ্বিধাদ্বন্দ না করে |
এরিক আলিজাকে আরো কাছে টেনে নিয়ে হাঁটতে লাগল ধীরপায়ে |
অনেকখানি এগিয়ে আসার পর আলিজা বলল, "এরিক বেশ অনেক দূরেই এসে পড়লাম |"
এরিক বামঃহাতটা আলিজার কাঁধের উপর রেখে ডানহাতে আলিজার ডানহাতটা ধরে বলল, "আমি রয়েছি তাও কেন চিন্তা করছো ! আপাতত শুধু এই সময়টাকে সময় দাও | আরকিছু ভেবোনা |"
এরিক একটা গাছের সামনে এসে বলল, "এ জায়গাটা খুবই সুন্দর | বৃষ্টি আসার আগে পর্যন্ত এখানে থাকতে পারি আমরা |"
"বৃষ্টি আসবে তোমাকে কে বলল ?"
"কেন তোমার মনে হচ্ছে না ?"
আলিজা হেসে ফেলল এরিকের কথায় | গাছের শিকড়ের উপর বসল দুজনে |
আলিজা ঠোঁটের কোনে একটু হাসির আভাস নিয়ে একদৃষ্টিতে দেখছে এরিককে |
এরিক একটু হেসে বলল, "কি লিজ ?"
"কিছুনা |"
"তোমার এই কিছুনাটা সবসময়ই অনেককিছু হয় !"
আলিজা সুন্দরকরে হেসে বলল, "দেখছি !"
"আমাকে ?" "হুমম !"
এরিক হাতটা আলিজার হাঁটুর উপর রেখে বলল, "কি ?"
"দেখছি প্রথম যেদিন দেখা হয় তখন কখনও কি ভেবেছিলাম, কি অনুমানও করেছিলাম কোনদিন যে তুমি এতটা কাছের একজন আমার ! কখনও কি চিন্তাও করেছিলাম যে তুমি আমার সবকিছু হয়ে যাবে একদিন !"
এরিক হেসে বলল, "সেটা আমিও বলতে পারি ! এন্ড ওয়ান্স কট আই নেভার থট দ্যাট এভার দ্যাট আই উইল গেট ট্যাংলড ইন ইওর ট্রেইল ফর ফরএভার ! ( আর আমি কখনোই ভাবিনি যে একবার আটকানোর পরেই যে আমি চিরদিনের জন্য তোমার আঁচলে বাঁধা পড়ে যাবো ! )"
এরিক ঘেঁষে কাছে বসল আলিজার |
.
.
.
মাহিরা আইলানকে বলল, "ওরা গেল কোথায় ?"
আইলান মাহিরার মুখের দিকে চেয়ে বলল, "আছে আশেপাশেই কোথাও |"
"একটু দেখলে হত না ?"
"নাহ ! দরকার নেই | থাকুক ওরা কিছুক্ষন নিজেদের নিয়ে | আর কিছুদূর গেলেই বা কি ! এরিক আছে তো সাথে তো আর ভয় কি !"
আইলান জুসের গ্লাসটা মাহিরার দিকে এগিয়ে দিল |
মাহিরা আইলানকে বলল, "তুমি একটু খাও না ?"
"না | তোমার দরকার এর | আর তাছাড়া আমি কখনোই জুস খুবএকটা পছন্দ করিনা | জুস আলিজা ভালোবাসে আর মা পছন্দ করত |"
মাহিরা একটু চুপ থেকে জিজ্ঞাসা করল, "আচ্ছা আইলান মায়ের কথা তোমার মনে পড়ে ?"
আইলান ছোট একটা হাসি দিয়ে স্ত্রীর হাতের উপর হাতরেখে বলল, "মাহিরা সত্যিকারের সন্তানরা মাকে ভুলে কখনোই থাকতে পারেনা | আমি বা আলিজা আমরা দুজনের কেউই কখনো সবার সামনে কাঁদিনা মায়ের কথা নিয়ে কিন্তু আমি নিজে আর হলফ করে বলতে পারি আলিজাও এমন কোন দিন হয়ত নেই যেদিন মাকে মনে করে অন্তত একবার চোখ ভিজে ওঠেনি আমাদের | মাহি মা একটু হতভাগ্যই ছিল বলা চলে ! নইলে আজকের এই দিনগুলো সে বেঁচে থেকে দেখে যেতে পারলনা কেন !"
মাহিরা দ্রুত আইলানের কাছে এসে স্বামীর হাতটা ধরে গালে হাতরেখে বলল, "আইলান প্লিজ মন খারাপ করোনা | আমারই ভুল যে এমন আজব প্রশ্ন করে বসলাম ! আজ বুঝলাম যে প্রায়ই তুমি অনেক রাতে বারান্দায় চুপচাপ বসে সিগারেট খেতে খেতে কি ভাবো ! আইলান মা হারানোর কষ্ট আমি জানি | প্লিজ মন খারাপ করো না | তুমি তাকে মনে করছো আর তার জন্য ভালোবাসা সবসময় জমা রেখে চলেছো মনে এটাই সবচেয়ে বড় | এটার দাম ওই লোকদেখানো ফিচফিচ কান্নার চেয়ে অনেক দামি |"
আইলান সিক্তচোখে মাথা নেড়ে সায় দিয়ে বলল, "মা অনেক বোকা ছিল মাহি ! অনেক অনেক বোকা ! এজন্য তাকে খুব কষ্ট দিয়েছে সবাই | আমিও |"
"তুমি তো তোমার অন্যায়ের প্রতীকরণীয় অনেকবার করার চেষ্টা করেছো | আর আমি তোমাকে নিশ্চয়তা দিয়ে বলছি, ফ্ল্যাটে প্রথম ওঠার সময় তুমি উনাকে নাওনি এইতো তোমাকে বেশি আঘাত করে তাইনা ? তো শোনো আমি একবারই দেখলাম তোমার নানুজানকে তখনই বুঝলাম একেবারে প্রথম যদি আনতে চাইতে মাকে তো তখনও উনি বাঁধা তৈরী করত ! সুবিধাবাদী স্বার্থপর লোকজন কখনোই কারো ভালো দেখতে পারেনা তা সে যত আপনজনেরই ভালো হোকনা কেন !"
"মাহি মার কথা প্রায়ই মনে হয় আমার ! সেদিন রাস্তায় এক ভিখারি হঠাৎ 'আব্বা' বলে ডাকল | আমার বুকের ভেতরে ছ্যাৎ করে উঠল ! মা আমাকে আব্বা ছাড়া ডাকতো না কখনও ! সেই মাকে আজ আর দেখিনা ! জানি অনেকগুলো ভুল তার কিন্তু তাও তো মা !"
"আইলান বাবামায়ের ভুলগুলো সন্তানেরা কিন্তু ভুলেই থাকে | দ্যাখো আমাকে ! আমার বাপির ব্যাপারটা তো সবই জানো তুমি ! তার শুধু নিজের সুখচিন্তা ! এতই পর করেছে সে আমাকে যে আমার সন্তানটাকে পর্যন্ত সে দেখতে আসেনি একবারও ! কিন্তু আমার মা আমাকে ভালোবাসত ! অনেক ভালোবাসত | সেজন্যই মা আমার একটু বুঝ হতেই নয় বছর বয়েসেই ছোটমামার কাছে পাঠিয়ে দিল | কারন সে চায়নি আমার বাপির এই বিকৃত চেহারা আমি দেখি | কিন্তু কপাল খারাপ তাই দেখতে হল ! আমার বাপি আর ওই নার্স নুরজাহান মিলে আমার মাকে খুন করেছে !"
আইলান মাহিরাকে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে বলল, "মাহি প্লিজ ! এসব মনে করোনা ! আজকে কতটা আনন্দের দিন আর আজ আমরা এসব ভেবে কষ্টে রয়েছি | প্লিজ মাহি কেঁদোনা ! আমরা তাদের ভালোবাসব, চিরদিন মনে রাখব |"
আইলান আর মাহিরার প্রথম সন্তান মেয়ে হওয়ায় আলিজা আর তারা দুজনেই খুব খুশি ছিল | আলিজা তাদের কন্যাসন্তানের নাম রেখেছে 'ফাহমিদা শাহরীন কথা' | শাহরীন মাহিরার মায়ের নাম | শুধু তার ডাকনাম 'কথা' নামটা আলিজার রাখা |
মাহিরা কথাপ্রসঙ্গ পাল্টে বলল, "আচ্ছা আমি কিন্তু একটু অবাকই হই একটা ব্যাপারে |"
"কি মাহি ?"
"আচ্ছা আইলান জানি এখন অনেকদিন পার হয়ে গিয়েছে আর এখন জিজ্ঞাসা করাও হাস্যকর | তাও বলছি !"
আইলান হেসে বলল, "মাহি প্লিজ ! আবার একই প্রশ্ন !"
"এই বলোনা ! তুমি তোমার 'এক্সপেক্টিং ওয়াইফ'-কে ( গর্ভবতী স্ত্রী' ) খুশি করতে এটুকুও করবে না ?"
"ভালো ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল তো !"
"বলোনা !"
"বলছি ! উত্তরটা হল হ্যা এবং হ্যা !"
মাহিরা উচ্ছাসিত হয়ে বলল, "আলিজার কথা তো সত্যি দেখছি ! আচ্ছা কবে থেকে ?"
"তুমি যখন আমার কেসটা হাতে নিয়েছিলে তার কিছুদিন পরই |"
"আজ সাতবছর পর অবশেষে স্বীকার গেলে ! মেনে নিলে যে তুমি আলিজা আমাকে তোমার জন্য পছন্দ করার অনেক আগে থেকেই তুমি আমাকে পছন্দ করতে ! স্বীকার গেলে তাহলে ?"
"যেতে হল মাহি ! আমি কখনোই তোমাকে কষ্ট দেবোনা বা আপসেট করবোনা |"
মাহিরা হেসে বলল, 'আচ্ছা কোন দিনটা থেকে ?"
"এটাও বলতে হবে ?"
"হ্যা |"
"উম ....তুমি সেদিন একটা সাদা আর গোলাপি টাইডাই শাড়ি পড়ে এসেছিলে | তুমি জানালার পাশে বসে ছিলে | তুমি একমনে আমার বয়ান লিখেছিলে | এরপর তুমি কাকে যেন সায়মার মায়ের অতীতের খোঁজে সাভারে পাঠিয়েছিলে তার সঙ্গে ফোনে কথা বলছিলে একধ্যানে | জানালার বাতাসে তোমার এলোখোঁপার চুল উড়ে এসে চেহারায় পড়ছিলো, কানের দুলটা নড়ে উঠছিলো, তুমি আঁচলটা সামলে কোলের উপর রাখলে | আমি এসার্টমেন্ট বাদ দিয়ে তোমাকে দেখছিলাম | হঠাৎ তুমি আমাকে ডেকে ধমকে উঠে বললে, 'কি হল আপনার ! কোন দুনিয়ায় আছেন ? কি বললাম উত্তর কেন দিচ্ছেননা ?' আর একটা ধমকেই বুঝলাম এখন সময় নয় | আরো অনেকটা পথ হাঁটতে হবে | কিন্তু আমার ভাগ্য ভালো যে আমার পথটুকু আমার আলিজা পাড়ি দিয়ে দিয়েছে |"
মাহিরা আগ্রহের সাথে বলল, "আমার কবে মনে হল তোমাকে ভালোবাসি জানো ?"
"কবে ?" "যেদিন কেস শেষ হলো আর তুমি ফি আর ফর্মালিটি সব মিটিয়ে চলে যাবে কেন যেন মনটা খারাপ হল যে আর কি দেখাই হবে না তোমার সঙ্গে ? এরপর যেদিন শুনলাম তোমার মা আর নেই | তুমি আর আলিজা খুবই মুষড়ে পড়েছো | খুব কান্নাকাটি করছো তুমি আর ও | সেদিন যে কেন আর কিজন্য এত অস্থির লাগল কথাটা শুনেই জানিনা ! একটাই চিন্তা আমাকে খেয়ে ফেলল শুধু যে কেমন আছো তুমি ! এরপর এলাম তোমাদের ঘরে | সত্যি বলছি আমি সেদিন আলিজার সাথেই দেখা করতে এসেছিলাম | আর ও কেন যেন আমাকে যেতেই দিলো না | পরে........."
আইলান কৌতূহলী গলায় বলল, "পরে কি মাহি ?"
"পরে একটা অদ্ভুত ইচ্ছা হল যে তোমার সঙ্গে দেখা করেই যাই !" কথাটা বলেই মাহিরা লজ্জিতভাবে হেসে ফেলল |
আইলান মাহিরার মুখটা থুতনি ধরে তুলে ঠোঁটের উপর একটা চুমু দিয়ে বলল, "তো ব্যাপারটা কখনোই একপাক্ষিক ছিল না !"
মাহিরা আইলানকে জড়িয়ে ধরে বুকের উপর মাথাটা রেখে বলল, "না ! ছিলনা | এটা একজনই বুঝেছিল একদেখাতেই | আলিজা !"
.
.
.
দুপুরে খেতে বসে মনজুর আলিজা আর এরিককে না দেখে বলল, "কি ব্যাপার ওরা আসলোনা এখনও ?"
আইলান বলল, "এখন খাবেনা মনে হয় |"
"ওরা এখনও আসেনি লেকের পাড় থেকে ?"
"এসেছে অনেকক্ষন |"
"তো ডাক ওদেরকেও | সেকি ! সবার সঙ্গে বসবেনা ?"
"ওরা এখন খাবেনা বাবা |"
"কেন ?"
মনজুর উঠতে গেলেন কিন্তু রজার তার হাতটা ধরে বসিয়ে দিয়ে বলল, "ডোন্ট বদার ! দে আর নট হাংরি টুডে ! ( ব্যস্ত হয়োনা ! আজ ওদের খিদে নেই ! )"
মাহিরা মনজুরকে বলল, "বাবা পরে খেয়ে নেবে ওরা |"
মনজুর তাও বললেন, "এটা কেমন কথা হল ! সবার সঙ্গে একসঙ্গে বসত ! এটা ঠিক না |"
আইলান বাপের স্বভাবের এই অবুঝ খিটখিট জানে বলেই বাধ্য হয়ে বলল, "বাবা আজ ওদের জন্য এটাই ঠিক ! আজ ওদের বিবাহবার্ষিকী বাবা ! ওদেরকে ওদের মত থাকতে দাও আজ |"
"বিবাহবাষিকী তো সেটা তো কথা না ! সবার সাথে খাবে তো !"
আইলান অসহায়ভাবে মাথা নেড়ে বলল, "বাবা প্লিজ খাও তো তুমি ! আর প্লিজ আমার অনুরোধ তোমার প্রতি আজকে ওদেরকে ওদের মত থাকতে দাও | ডাকাডাকি করতে যেওনা !"
মনজুর তাও ফোন করলেন, দেখলেন আলিজা আর এরিক দুজনেরই ফোন বন্ধ |
.
.
.
"এরিক খিদে পায়নি তোমার ?"
"না | তোমার খিদে পেলে বলো | রুমে দিয়ে যেতে বলি |"
"না | পরেই খাই |"
"ওকেই সুইটহার্ট |"
এরিক আর আলিজা তাদের ভিলার ভেতরের ব্যালকনিতে বসে রয়েছে |
এরিক জিজ্ঞাসা করল, "লিজ শীত লাগছে নাকি ?"
"না |"
"এরিক তাকে দুহাতে জড়িয়ে ধরে বলল, "আমাকে মিথ্যা বলে কিন্তু লাভ নেই কোন !"
আলিজা হেসে ফেলল |
বৃষ্টি পড়ছে এখনও | এরিক আধশোয়া হয়ে বসে আছে আর এরিকের গায়ের উপর হেলান দিয়ে বসছে আলিজা |
এরিক আলিজার ঘাড়ে একটা চুমু দিয়ে বলল, "খুব মিস করছো ওদের ?"
আলিজা বলল, "হুমম |"
"ভেবোনা লিজ ! ম্যাডি খুবই স্মার্ট ! ও জানে কখনও কখনও আমাদের একে অপরের সঙ্গ প্রয়োজন | আর এইব ? ওতো আমার টডলার ভার্সন ! ওর শুধু ওর গ্রান্ডপা আর দৌড়াদৌড়ি দরকার ! বরং আজ ও খুশি যে তুমি জোরকরে ওকে খাওয়াবে না !"
"হুমম |"
"লিজ ?"
"বলো এরিক |"
"ভেবোনা লিজ ! আমার কাছে থাকো আজ |"
"আছিই তো !"
এরিক আলিজার কানের উপর ঠোঁট রেখে বলল, "সম্পূর্ণভাবে !"
আলিজা হেসে বলল, "আছিই এরিক |"
"আর কিছুক্ষন সুইটহার্ট | এরপর একত্রে ডিনার আমাদের | ততক্ষন শুধু আমরা একে অপরের !"
এরিক আলিজার গলা জড়িয়ে ধরে বলল, "আমার আজ শুধু তোমাকে চাই !"
আলিজা এরিকের হাতের উপর হাতরেখে বলল, "হুমম ! দিলাম !"
.
.
.
এরিকের ইচ্ছা ছিল রোমান্টিক ডিনারের তাই আলিজাকে একান্তে নৈশভোজে বসতে হল তার সঙ্গে |
আলিজা এরিকের মুখে খাবার তুলে দিয়ে বলল, "এরিক আমার জানামতে তুমি এসব খাওয়ানো, ঘুম পাড়ানো পছন্দই করো না !"
এরিক খেতে খেতে বলল, "সত্যি নয় | সবার কাছে পছন্দ করিনা |"
"আমি কি ব্যতিক্রম ?"
"না |"
"ওহ !"
এরিক আলিজার মুখে খাবার খাইয়ে দিয়ে বলল, "তুমি ব্যতিক্রম নও, তুমি অনন্য আর অদ্বিতীয় |"
আলিজা মিষ্টি হেসে মাথা নিচু করল |
.
.
.
এরিকের ঘর থেকে বেরুবার ইচ্ছা নেই | সে আলিজার আরো সান্নিধ্য চায় | কিন্তু অনিচ্ছাসত্বেও বেরুতে হল |
আলিজা এরিকের হাতধরে রাত সাড়ে বারোটার সময় তাদের ভিলা থেকে বেরিয়ে আইলান আর মাহিরার ভিলায় গেল | গিয়ে দেখল সবার রয়েছে সেখানে তারাই সবার পরে এলো |
মাহিরা মৃদু হেসে বলল, "তো ছুটি পেলে ননোদিনী ?"
আলিজা লজ্জিতভাবে হেসে ফেলল |
সে এগিয়ে গিয়ে প্রথমে ম্যাডিসনকে জড়িয়ে ধরে বলল, "অনেক রাগ করেছো কাপকেক ?"
ম্যাডিসন বলল, "না ! তবে এর আগে বেরিয়ে এলে সত্যিই রাগ করতাম |"
আলিজা হেসে এবার এইব্রাহামকে কোলে নিয়ে বলল, "সোনা আমার !"
এইব্রাহাম মায়ের গালে চুমু দিয়ে বলল, "আই মিসড ইউ মা !"
আনন্দে চোখে পানি চলে এলো আলিজার !
আলিজা ছেলের কপালে গালে চুমু দিয়ে বলল, "আমিও অনেক মিস করেছি তোমাদের সোনা !"
ম্যাডিসন বলল, "মা এবার আংকল এলানের বিবাহবাষিকী পালন করি এসো |"
"হ্যা চলো মামনি |''
আলিজা মুগ্ধ হয়ে মাহিরাকে দেখছে | কি সুন্দর লাগছে তাকে এই সবুজ শাড়ি আর হাতভর্তি সবুজ চুড়িতে !
আলিজা মাহিরার জন্য রাখা উপহারটা ভাতৃবধূর গলায় পড়িয়ে দিয়ে বলল, "সেই অসাধারন মানুষটার জন্য যে আমার সবচেয়ে দামি সম্পদটাকে এভাবে যত্নে আগলে রেখেছে নিজের চেয়েও বেশি ভালোবেসে !"
মাহিরা বলল, "আর এ মানুষটা এই যত্নের ক্ষমতাটা শিখেছে তোমাকে দেখে !"
আইলান হেসে বলল, "বানি আমার গিফট কই !"
মাহিরা বলল, "নাই ! তুমি ওকে কিছুই দাওনি তাই তোমারও কোন গিফট নেই |"
আইলান হা হা করে হেসে ফেলল |
আইলান বলল, "নারে বানি গিফট হচ্ছিস তুই ! আমার লাইফে তোর চেয়ে বড় গিফট আর নেই !"
এরিক বড় একটুকরো কেক প্লেটে নিয়ে খেতে লাগল |
আইলান এগিয়ে এসে আরো একটা টুকরো দেখিয়ে বলল, "এটার চেয়ে ওটা বড় !"
এরিক তাকিয়ে অসহায়ভাবে বলল, "আগে দেখাতে পারলে না এলান ! কোন কথা হল ! জানোইতো বাটারস্কচ আমার কত প্রিয় !"
"ওহ দুঃখিত ! অসুবিধা নেই কোন | এটা শেষ করে ওটাও নিতে পারো !"
"নাহ থাক !"
''কেন ?"
"কেন আবার কি ! আজ রাতে আমি ব্যস্ত !"
আইলান কৌতুকের চোখে চেয়ে বলল, "কেন ?"
এরিক নির্বিকারভাবে বলল, "যে কারনে তুমিও আজ ব্যস্ত সে কারণেই !"
আইলান একটু চুপ থেকে উচ্চস্বরে হেসে ফেলল |
"ইউউ ! কিসব কথাবার্তা !" দুজনেই সামনে তাকিয়ে দেখল আলিজা দাঁড়িয়ে |
আলিজা নাকমুখ চোখা করে বলল, "তোরা দুজনেই অসভ্য !"
আলিজা যেতেই এরিক আর আইলান একত্রে হেসে ফেলল হা হা করে !
একটুপর আইলান হাসি থামিয়ে বলল, "তুমি আমার বোনটাকে এতো জ্বালাও কেন ?"
এরিক বলল, "আমার কাজই তো ওকে জ্বালাতন করা !"
আইলান এরিকের কাঁধে হাত রেখে আইলান বলল, "এরিক তুমি ওর যেভাবে খেয়াল রাখো সেভাবে ওর যত্ন করা কারো পক্ষে সম্ভব নয় |"
এরিক চোখটিপে হেসে বলল, "আমি ওর নয় নিজের খেয়াল রাখি | কারন ও আমার অস্তিত্বের জন্য অত্যাবশ্যক | এজন্যই এ দায়িত্ব আমি সারাজীবন একভাবে করে যাবো |"