মাহিরা আইলানের দিকে চেয়ে বলল, "আমি বুঝতে পারছি কেমন এখন আপনার মনের অবস্থা কেননা এত অল্পদিন ওকে আমি চিনি তাতেই এতটা কষ্ট লাগছে আমার | আর আপনি এমন সবসময়কার সঙ্গী তার | আপনার কষ্টটা আমার না বোঝার কারণ নেই কোন |"
আইলান বলল, "আমার নিজের কাছেই খুব অবাক লাগছে যে কিকরে তিনটা বছর ওকে ছেড়ে আমি ছিলাম ! আমি বোধহয় তখন ঠিক আমি ছিলাম না | অন্যকেউ ছিলাম হয়ত |"
"সেটা সত্য |"
আইলান তাকিয়ে একটু হাসল |
মাহিরা বলল, "আচ্ছা সত্যিই কি আপনি ও আমেরিকা চলে যাবার আগের প্রায় দুইবছর সময় ওর সাথে ঠিকমত মেশেননি, সম্পর্ক রাখেননি ?"
আইলান মাথা নিচু করে মলিন হেসে বলল, "হ্যা !"
মাহিরা অবাক হয়ে বলল, "সত্যি বলছেন ?"
আইলান যেন একটা দীর্ঘশ্বাস চেপে বলল, "হ্যা | সত্যি |"
মাহিরা চেহারায় বিস্ময় লুকানোর কোন চেষ্টা না করে বলল, "আশ্চর্য !"
আইলান তাকালো, মাহিরা বলল, "এরকম একটা ব্যাপারের পরেও ও এতটা ভালোবাসে আপনাকে | অনেক বড় মন থাকতে হয় কাউকে এতবড় অপরাধের জন্য ক্ষমা করার জন্য |"
আইলান অন্যদিকে তাকাল | খুবই কষ্ট হচ্ছে তার নিজের আবেগ চাপতে |
মাহিরা ডাকল, "মি আহমেদ | আমার কথা শুনুন |"
আইলান কোনরকমে বলল, "বলুন |"
"আপনি এভাবে কষ্ট পাবেননা | এতে শুধু আপনি নন, আলিজাও কষ্ট পাবে | দেখুন ও সেই পাঁচবছর সময়টা ভুলে রয়েছে আমার বিশ্বাস হয়না | কিন্তু আলিজা সেই সময়টাকে মনে করেনা আর ! আপনাকেও সেটা ভুলতে হবে |"
"আমি আজ সারাদিন এই চিন্তাই শুধু করেছি যে কিকরে আমি এই দিনগুলোকে, ওকে ভুলে থাকবো আর পাঁচদিন পর থেকে !"
"কষ্টের কিন্তু আপনাকে নিজেকে সামলাতে হবে | তবেই ও পারবে আপনাকে রেখে যেতে |"
আইলান আর অশ্রু চাপতে পারলনা, তার চোখ ভিজে উঠল, সে আর্দ্রস্বরে বলল, "আমি সত্যিই চাই না ও চলে যাক আমাকে রেখে | আমার খুব কষ্ট লাগছে এটা ভেবেই যে ও থাকবেনা আমার কাছে |"
আইলান কাপটা রেখে উঠে দাঁড়ালো |
মাহিরা উঠে দাঁড়িয়ে বলল, "বসুন মি. আহমেদ | প্লিজ বসুন | আপনি কেন এতটা কষ্ট পাচ্ছেন আমি বুঝতে পাচ্ছি | কিন্তু প্লিজ বোঝার চেষ্টা করুন ব্যাপারটা | এরকম যদি করেন তো ও হয়ত ফেরার সিদ্ধান্ত নেবেনা আপনাকে ফেলে রেখে | সেটা কি ভালো হয় ? কেমন হয় সেরকম কিছু হলে ?"
আইলান মাহিরার দিকে তাকাল, মাহিরা বলল, "ও এখন এখানে থেকে গেলে যা হতে পারে তা হল আপনি ওর সমালোচকদের সেই সুযোগটা করে দেবেন যেটা ওরা চায় |"
আইলান প্রশ্নের চোখে তাকিয়ে বলল, "মানে ?"
"মানে হল এই ও এখন যেখানে রয়েছে সেটা ত্যাগ করতে ওকে আপনি কিকরে বলতে পারেন ? ওখানে এই তিনবছরে অনেক কষ্ট অনেক সাধনায় সে নিজেকে গড়েছে | সেটা নষ্ট করবেন না |"
আইলান বসল, মাহিরা তাকে একগ্লাস পানি এনে দিয়ে বলল, "আপনি প্লিজ বুঝতে চেষ্টা করেন | ওর সব সম্ভব ওখানে | পড়াশুনা, রিসার্চ, ক্যারিয়ার, একটা সঠিক সম্পর্ক, সুন্দর জীবন সব | ও যেটাকে এভাবে তিলে তিলে গড়েছ সেটাকে এভাবে আবেগে ভাসিয়ে দেবেন না |"
আইলান চোখমুছে বলল, "ওর এতকষ্ট করার কোন দরকার নেই | আমি রয়েছি ওর জন্য | আমি ওকে সামলে রাখবো | আমি ওকে নিজের সাথে নিজের কাছে রাখব সবসময় |"
আইলান অশ্রুসিক্ত চোখে তাকিয়ে বলল, "আমার দুনিয়া অন্ধকার ও পাশে না থাকলে |"
মাহিরা আইলানের পাশে বসে বলল, "আচ্ছা ওকি চিরদিনের জন্য চলে যাচ্ছে ? না | তা একেবারেই নয় | ও আবার ফিরে আসবে, আপনার কাছেই আসবে | ও যেমন আপনার একমাত্র পরিবার তেমনি আপনিও ওর একমাত্র আপনজন | তো ? মনের বন্ধনটা শক্ত হওয়াটা খুব জরুরি | যেটা আপনার আর আলিজার আছে | ওর ভবিষ্যৎটা ভাবুন |"
"ভাবছি বলেই ঠিক এতটা দোটানায় পড়ছি আমি | আমি বুঝছিনা কি করব !"
মাহিরা সুন্দরকরে হেসে বলল, "আমি বলছি আপনি কি করবেন !"
আইলান একটু অবাক হয়ে তাকিয়ে বলল, "কি করব ?"
"আপনি এই পাঁচটা দিন প্রতিটা মুহূর্ত ওর সঙ্গে উপভোগ করবেন ঐশ্বরীয় কোন বস্তুর মত !"
"মানে ?"
"ওর সঙ্গে চমৎকার সময় কাটান, একটা একটা মিনিট উপভোগ্য করে ব্যয় করুন | ওকে খুশি রাখুন | ওর মায়াভরা মুখটায় হাসি রাখুন সবসময় | ওকে ওর পছন্দের খাবারগুলো খাওয়ান, ওকে ওর পছন্দের কোন জায়গায় নিয়ে যান, সুখের স্মৃতিগুলোকে পুনরুজ্জীবিত করুন | ওর ইচ্ছাগুলো পূর্ণ করুন |"
আইলান চুপ করে কিছুক্ষন বসে থেকে চোখ মুছে একটু হেসে মাহিরার দিকে চেয়ে বলল, "ঠিকই বলেছেন | এই পাঁচটা দিনের একটা একটা মুহূর্ত দামি | অনেক দামি |"
মাহিরা ঠোঁটের কোনে একটু হাসি এনে বলল, "অনেক ধন্য আপনি যে এরকম কেউ এতটা ভালোবাসে আপনাকে | অনেক ভাগ্য থাকতে হয় সেজন্য |"
আইলান মৃদুস্বরে বলল, "আপনি সত্যিই খুব সুন্দর পরামর্শ দিলেন আমাকে | অনেক ভালো লাগল আপনার কথাগুলো | আলিজার কথাটা ঠিক আপনাকে নিয়ে |"
মাহিরার দুচোখে অধীর আগ্রহ কিন্তু মুখে শান্তভঙ্গি বজায় রেখে সে বলল, "কি ?"
"ও আমাকে বলেছে আপনার সম্পর্কে যে, খুব সঠিক সময়ে সঠিক একটা আপনজন হওয়াটা খুব কম মানুষের পক্ষে সম্ভব | আপনি সেটা পেরেছেন |"
মাহিরা ধীরকণ্ঠে বলল, "আপনার কি মনে হয় ?"
আইলান বলল, "আমার মনে হয় আমিও আলিজার সাথে একমত |"
আইলান কাপটা তুলে নিলো আবার হাতে |
কফিটা শেষ করে আইলান বলল, "আমি উঠি তাহলে ?"
মাহিরা বলল, "এখনই ? আরেকটু বসুন |"
"না মানে ভাবছি একটু শপিং সেন্টার যাবো |"
"ওহ |"
"আপনার এডভাইসিং ফিসটা আপনার পিএস কে পাঠিয়ে দেব আমি |"
আইলান উঠতে গেলে মাহিরা বলল, "প্লিজ একটু অপেক্ষা করুন |"
"কেন ?"
মাহিরা দৃঢ়কণ্ঠে বলল, "আমি যেতে চাই আপনার সাথে শপিং কমপ্লেক্সে |"
আইলান হেসে বলল, "না দরকার নেই |"
মাহিরা বলল, "আছে | আমি চাই যেতে |"
মাহিরা আইলানের হাতের উপর হাত রাখল | আইলান বিস্মিত হয়ে মাহিরার দিকে তাকাল | আইলানের দৃষ্টি মাহিরার চোখের ভাষা পড়ল তখন |
আইলান একটু হেসে বলল, "চলুন |"
মাহিরা আইলানের হাতটা ধরল | ভালোবাসার মধুর মায়াময় প্রেমপূর্ণ স্পর্শ |
আইলানও মাহিরার হাতটা ধরে বলল, "চলো |"