পর্ব ২৪

710 33 3
                                    

আলিজা সিলিংয়ের দিকে শূন্যদৃষ্টিতে চেয়ে রয়েছে | একটুআগে নাফি, নাহিদ আর শাহানা এসেছিল | হয়ত অনেক ভয়াবহ কিছু বলত তারা কিন্তু শাহানা এরিকের সামনে থেমে গিয়েছে আর তার ছেলে বিপ্লবও মাকে থামিয়ে দিয়েছে | আর নাফি আর নাহিদকে আইলান সরিয়ে নিয়ে গিয়েছে | আলিজা আজ এবাড়িতে ফিরেই অনেকের অনেক সমালোচনার শিকার হয়েছে | সে কারো কোন কথারই জবাব দেয়নি কোন, শুধু শুনে গিয়েছে |
আইলানকে সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে বলতে শুনল সে, "আপনারা যদি সত্যিই কোন কেয়ার করতেন তো অন্তত আজকের দিনে আমাদের সাথে এমনটা করতেন না |"
এবার নাফির গলা শুনল, "কি করেছি হ্যা যে এতো নসিয়ত দিছিস ! যা দেখাচ্ছিস না তোরা ভাইবোন !"
আইলান উপরে উঠতে উঠতে বলল, "এতই যখন জঘন্য আমরা তো দেখেন না আমাদের | আর বেশিক্ষন দেখতেও হবেনা | আমার বোনকে আমি এই নরকে রাখবো নাকি !"
নাফি উঁচুগলায় শুনিয়ে শুনিয়ে বলল, "হ্যা হ্যা দেখা যাবে ! আজীবন পড়েছিলি ওই দু'কামরায়, আবার এসে ওখানেই উঠবি !"
আইলান ঘুরে দাঁড়িয়ে দৃঢ়স্বরে বলল, "আপনি ছোটলোক সেটা আমি জানি ! কতটা নিচু আজকে জানলাম | আমার একটা কথা শুনে রাখেন আজ | আমি আর আমার বোন এখান থেকে অনেক অনেক দূরে চলে যাব | কিন্তু আপনারা আজীবন এই বাড়ি নিয়ে, এই ঘর নিয়ে একে অপরকে খোঁটা দিয়ে যাবেন আর খুব খুব জঘন্যভাবে জীবন পার করবেন | আজকে আলিজার কথাটা আমি বলছি আপনাদের, 'সময় কথা বলবে |'"
আইলান চোখ মুছে দ্রুত উপরে উঠে এল | আলিজা সবই শুনেছে | সে আইলানের দিকে একবার চেয়ে আবার সিলিংয়ের দিকে চেয়ে বসে রইল |
আইলান আলিজার শালটা নিচতলা থেকে হাতে করে নিয়ে এসেছিলো |
সে শালটা খুলে আলিজার সামনে এসে ঝুকে দাঁড়িয়ে তার গায়ে জড়িয়ে দিতে দিতে বলল, "শীত করছে তো শাল গায়ে দিচ্ছিসনা কেন ? আমাকে বললেই তো হত যে ভাইয়া শীত লাগছে শালটা এনে দে |"
আলিজা উদাসভাবে বলল, "কি দরকার !"
আইলান আলিজার দুইগালে হাত রেখে বলল, "কি দরকার মানে ? কেন দরকার নয় ? তোকে যেকোন সমস্যা হলে আমাকে বলতে হবে ! অবশ্যই বলতে হবে আমাকে ! আর কাকে বলবি নয়তো ? শোন, ওদের কোন কথা তুই শুনবিনা ! তুই আমার দায়িত্ব | আমার সবকিছু এখন | তোকে আমার জন্য ভালো থাকতেই হবে |"
আলিজা আইলানের হাতদুটোর উপর নিজের হাত রাখল |
আইলান তাকে নিজের গায়ের সাথে চেপে ধরে ভেজাকণ্ঠে বলল, "কতকষ্টে তুই ফিরেছিস আমার কাছে জানিস ? কাল রাতের মত রাত আর কোনদিন যেন না আসে ! ওরা কি বুঝবে আমার যে আমি কেমন হারাতে হারাতে আবার ফিরে পেয়েছি ? আমার কেমন লাগছে তোকে কি বোঝাবো আমি !"
আলিজা কান্নাভেজা স্বরে বলল, "বোঝাতে হবে না | আমি তোকে তোর চেয়েও ভালো বুঝি |"
"তো ওদের কোন কথা আর তুই শুনবিনা | কিচ্ছুতে কান দিবিনা ! বুঝেছিস |''
আলিজা কান্না একটু থামালে এরিক আইলানকে বলল, "এলান আই নিড টু ইউস দা রেস্টরুম | ( আইলান আমার বাথরুমে যেতে হবে )"
আইলানের মনে হল এরিক কিছু বলতে চায় তাকে কিন্তু আলিজার সামনে বলতে চাচ্ছে না |
আইলান বলল, "এসো আমার সাথে |"
বারান্দায় এসে এরিক বলল, "এলান লিজকে সরাতে হবে এখন থেকে | এমনিতেই ও কঠিন যন্ত্রনায় রয়েছে | এ অবস্থায় এসব ওর জন্য ভয়ঙ্কর | আর এঘরে ওর মা থাকত | সেই স্মৃতিতে ও কষ্ট তো পাবেই আর আজ এখানে থাকলে তোমার বাবার কোনরকম কটু কথা ওর জন্য সাংঘাতিক হবে |"
আইলান বলল, "ওকে এখানে আর একটাদিনও আমি রাখবো না ! আজকেই নিয়ে চলে যাবো | এখনতো অনেক লোকজন রয়েছে আর কিছুক্ষন পর সন্ধ্যা হলে ওকে বাবাকে দুজনকেই সাথে নিয়ে চলে যাবো | বাবা গেল তো গেল তার ইচ্ছা কিন্তু আলিজাকে যেভাবে হোক নিয়ে চলে যাবো | না যদি চায় যেতে তো জোর করে উঠিয়ে নিয়ে যাবো ওকে | আমি এসব খারাপ মানুষগুলোর আর একটা কথা ওকে শুনতে দেবোনা | এদের ছায়া পড়তে দেবোনা ওর উপর |"
এরিক আইলানের কাঁধে চাপড় মেরে বলল, "খুব ভালো কথা | তোমাদের দুজনেরই এখন দুজনকে দরকার | আর এদের চিন্তা করোনা |"
"করবোও না কোনদিন ! এরা কখনোই আপন মনে করেনি আমাদের | এরিক আমাদের মাকে ওরা সবসময় দখল দিয়ে রেখেছিল | ওদের কারণে আমরা বঞ্চিত হয়েছি সবসময় | এখন আর কোন সম্পর্ক নেই আমাদের | আর আমি কোনদিন কোন সম্পর্ক রাখবোও না ওদের সাথে |"
"এলান রাগ করোনা | এরা নিজেদের কর্মফল এড়াতে পারবে না | কেউ পারেনা |"
এরিক সামনের দিকে যেতে গেলে আইলান বলল, "আরে ঘরের দরজা এদিকে তো |''
এরিক বলল, "সেটা তো জানিই !"
"তো ওদিকে কেন যাচ্ছো ?"
এরিক ফিরে তাকিয়ে বিরক্তহয়ে বলল, "বাডি আই ডু হ্যাভ টু পি | আই হ্যাভেন্ট পিড সিন্স সেভেন আওয়ার্স |( বন্ধু আমাকে সত্যিই মূত্রত্যাগে যেতে হবে ! আমি প্রায় সাতঘন্টা বাথরুম ব্যবহার করিনি | )"
আইলান বিস্মিত হয়ে চেয়ে বলল, "ওহ !"
এরিক আগেরমত বিরক্তভাবেই বলল, "কি দেখছ ! তুমি কি ধারণা করেছিলে আমি এমনি বলেছি ?" বলে বাথরুমে ঢুকে গেল |
আইলান বিস্মিতহয়েই ঘরে এসে আলিজার পাশে এসে বসে বলল, "ও কি সবসময়ই এমন ?"
আলিজা চোখবন্ধ করে হেলান দিয়ে বসে ছিল, সে শুধু মাথা নেড়ে বলল, "হুমম |"
আলিজা যেতেই চাইল না প্রথমে ঘর ছেড়ে, মায়ের স্মৃতি ছেড়ে কিন্তু আইলান কোনোকথাই শুনলনা | সে আজ একেবারে অন্যরকম এক শান্ত দৃঢ়তায় আলিজাকে বাধ্য করল তার সাথে আসতে | আলিজার তার বড় ভাইয়ের সাথে সখ্যতা, বন্ধুত্ব, মমতা, ভালোবাসা, রাগ, অভিমান এসব সব থাকলেও অসম্মান, অবাধ্যতা, বেয়াদবি কোনদিনই নেই তার আইলানের প্রতি | সে খুব সহজ স্বাভাবিক মমতাপূর্ণ একটা বন্ধুবৎসল সম্পর্ক আইলানের সাথে রাখলেও কোনদিনই এমনকিছু করেনি যাতে আইলানকে অসম্মান করা হয় বা তার প্রতি অমর্যাদা প্রকাশ পায় | আলিজার চরিত্রের এই অসামান্য দিকটাই আলিজার প্রতি আইলানের ভালোবাসাটাকে এতটা দৃঢ় করেছে | সম্মানটা মূলত আন্তরিকভাবে অনুভবের ব্যাপার, তা আস্ফালনের কিছু নয় | আলিজা তাই করে আইলানের প্রতি | আইলানের প্রতি ভক্তি তার এমন যে ব্যাপারটায় বাড়াবাড়ি নেই কোনরকম কিন্তু এতটাই দৃঢ় যা অদৃশ্য হয়েও সুস্পষ্টরূপে নিজের অবস্থান জানান দেয় |
আলিজার চোখটা আবার মুছে দিল এরিক, বলল, "কিছু জিনিস খুব আপন আমরা জানি | কিন্তু তাও এর মায়া কাটাতে আমাদের শিখতে হয় |"
আলিজা আদ্রস্বরে বলল, "আমি আরেকবার দেখে আসি সব ?"
"যাও |"
আলিজা ভেতরে গেল তাদের ঘরের | শৈশব থেকে যৌবন তার আর তার ভাই আইলানের এই ঘরে | এই ঘরের প্রতিটা দেয়ালে তাদের জীবনের স্মৃতি গাঁথা |
আলিজা আবার এসে সোফায় বসল, কুশনগুলো ছুঁয়ে দেখল | কোথায় একটু সস্তা আর কমে ভালো ও সুন্দর জিনিস পাওয়া যেতে পারে তাই খোঁজে কোথায় না যেত ফাহমিদা | বেচারি ! কিনে এনেও শত ঝামেলা কেননা প্রায়ই ভালো কিছু কিনে নিয়ে এলে তার বোনেরা তা 'আমাকে দে তোকে দাম দিয়ে দিচ্ছি' বলে নিয়ে চলে যেত আর বলা বাহুল্য কোন টাকা দিত না এর জন্য |
ফাহমিদা আলিজা বড় হবার পর তাকে নিয়ে যেত কখনও নিউমার্কেট, কখনও গাউসিয়া, কখনও টিকাটুলীর রাজধানী মার্কেট, কখনও আজিমপুর ছাপড়া মসজিদ, কখনও শিশু একাডেমির সামনে, কখনও মঙ্গলবারের দিন নীলক্ষেত বলাকা সিনেমাহলের সামনের ফুটপাতে বা শুক্রবারের দিন শহরের কতগুলো প্রসিদ্ধ স্কুলকলেজের সামনে বসা ফুটপাতের বিপনীতে | আলিজাকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে নিয়ে যেতেন আর অনেক বেছে অনেক দামদস্তুর করে শখের জিনিসগুলো কিনে ঘর সাজাতেন | কুশনকভার, সোফার ফোমকভার, বিছানার চাদর, কাপড়ের ফুল, বিভিন্ন শোপিস সে আলিজাকে নিয়েগিয়ে কিনত | আলিজাকে নিত কারন ফাহমিদার পছন্দ ভালো ছিল না | কিন্তু আলিজা ফুটপাথ থেকেও চমৎকার সব জিনিস পছন্দ করে ফেলত | তাই এসব কেনার স্মৃতি ফাহমিদার যত আলিজারও ঠিক ততটা | মনজুর এসব একেবারেই পছন্দ না করলেও তার লাঞ্ছনা আর বকাঝকার সত্বেও ফাহমিদা এসব কিনত | আলিজার শৈশবে তার মধ্যবিত্ত পরিবার আর্থিকভাবে অসচ্ছল ছিল কিন্তু মনের দৈন্যতা তাদের কখনও ছিলোনা |

মেঘের আলোয়Kde žijí příběhy. Začni objevovat