এরিকের চেহারা বদলে গেছে রাগে | তার নীল চোখের দৃষ্টি তীক্ষ্ন হয়ে গেছে, চোয়াল শক্ত হয়ে গেছে | আইলান পেছন থেকে ডাকছে থামার জন্য কিন্তু সে শুনছেই না |
এরিক নিচতলার দরজার সিঁড়ির সামনে আলিজাকে দেখতে পেল | সাথে ওই মহিলা যে ওকে ডেকে নিয়েছিল আর একটা লোক |
এরিক সামনে গিয়ে কোন ভদ্রতার তোয়াক্কা না করে আলিজাকে বলল, "লিজ আমার সাথে আসো |"
শাহানা বিরক্তভাবে বলল, "না আমরা কথা বলছি |"
এরিক তাকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে আলিজাকে আবার ডাকল, "লিজ আসো | চলো আমার সাথে |"
শাহানা মেজাজ দেখিয়ে বলল, "আরে বললাম তো ওর সাথে কথা বলছি |"
এরিক প্রচন্ড এক ধমক দিয়ে শাহানাকে বলল, "শাট আপ ! ইউ জাস্ট কিপ কোয়াইট লেইডি !"
শাহানার মেজাজ এরিকের এক ধমকে বেলুনের মত চুপসে গেল |
এরিক একেবারে রাগে ফেটে পড়ে বলল, "তুমি একটা পিশাচ ! মানুষ বলার যোগ্যই না তুমি | তোমার মধ্যে কি কোন বিবেক নেই ? তুমি তোমার ৯০% মৃত বোনের জন্য একজন সুস্থসবল মানুষকে মৃত্যুর মুখে ঠেলতে চাও ? কি তুমি ?"
শাহানার সাথে ডাক্তার লোকটি বহুকষ্টে সাহস জোগাড় করে বলল, "আসলে ডোনার হলেই কেউ মারা যায়না !"
এরিক এবার তাকে ক্ষিপ্রভাবে বলল, "আচ্ছা ? রেশিও দেখাও তো যে ডোনার হবার পর একজন মানুষ ঠিক কতটা শঙ্কামুক্ত থাকে ? আর তুমি কোথা থেকে নিয়েছো তোমার মেডিসিন ডিগ্রি ? ওই রুগীর কি এই মুহূর্তে এরকম একটা অর্গান ট্রান্সপ্লান্ট করার মত শারীরিক ক্ষমতা আছে ? তার কোন ভাইটাল স্টেবল না আর তোমরা এরকম একটা ফাজলামো করতে চাচ্ছো ?"
এরিক আলিজাকে হাত ধরে টেনে ভিতরে নিয়ে গেল |
আইলান সিঁড়ির সামনে দাঁড়িয়ে সব দেখছিল | সে ধীরপায়ে ভেতরে গেল | যাক আর কোন বিপদ তার আলিজার নেই |
লিফটে উঠেই এক লোক আলিজার গা ঘেঁষে দাঁড়াতে লাগল | এরিক তাকে সরতে বলায় সরল কিন্তু আবার একই কাজ করতে লাগল | এরিক তার হাতটা দিয়ে বাধা দিয়ে আলিজার সামনে এসে দাঁড়িয়ে আলিজাকে আড়াল করল | আলিজা এই লোককে চেনে | এ লোকের স্ত্রী তাদের একটা কেবিন পরের কেবিনে ভর্তি সিজারিয়ান ডেলিভারি হয়ে | কি বিকৃত মানুষের আচরণ !
লিফট থেকে নামার সময় এরিক একটু সরতেই লোকটা আবার আলিজার কাঁধ ঘেঁষে নেমে গেল | আইলান রাগ করে লোকটাকে কিছু বলতে যাবার আগেই দেখল এরিক দ্রুত এগিয়ে গিয়ে একটা দশাসই থাপ্পড় বসালো তাকে |
আলিজা এরিকের মেজাজ জানে | ও রাগ ধরে রাখতে পারে, প্রকাশ করেনা কিন্তু রেগে গেলে ওর মাথা ঠিক থাকেনা | আলিজা দ্রুত গিয়ে এরিককে ধরে টেনে সরালো |
লোকটা হতভম্ব হয়ে বলল, "উনি এমুন কেন করল ? এই আমাকে মারল কেন ?"
আইলান সবার সামনে বলল, "লিফটে আর কোন মেয়ের সাথে খারাপ কিছু করার আগে এই থাপ্পড়টা মনে করে নেবেন |"
আলিজা এরিকের হাত ধরে টেনে নিয়ে গেল কেবিনে | আইলান এসে দরজা ঠেলে দিল |
আলিজা অবাক হয়ে এরিককে বলল, "এরিক কি হয়েছে তোমার ? এমন কেন করলে ?"
এরিকের রাগ পড়েনি, সে বলল, "লোকটা তোমার গায়ে হাত দেবার চেষ্টা করছিল | তাই |"
আলিজা এরিককে ধরে বলল, "এরিক তুমি বসো একটু | আমি আসছি |''
আলিজা দরজার দিকে যেতে গেলে এরিক তার হাতটা টেনে ধরে বলল, "কোথাও যাবে না তুমি |"
আলিজা বিস্মিত !
এরিক আলিজার কাঁধঝাকি দিয়ে বলল, "তুমি কি করতে যাচ্ছিলে হ্যা ? লিজ তুমি একটা সাহসী আর বুদ্ধিমান মেয়ে হয়ে ওই মহিলার কথায় ম্যানিপুলেটেড কিকরে হলে ? কিভাবে ?"
আলিজা চুপ করে রইল | আইলান সোফায় এসে বসল | আর কোন চিন্তা তার নেই |
এরিক বলল, "লিজ তোমার মা বাচঁবেনা | তুমি যাই করোনা কেন তোমার মা বাচঁবেনা ! তুমি নিজের শরীরের একটা অংশ দিয়ে কি চেষ্টা করতে চাইছিলে ? মনের স্বস্তি ? এতে তোমার মায়ের মৃত্যু হয়ত কিছুটা পেছাতে পারে এই ? কেন ?"
আলিজা কোনরকমে বলল, "হয়ত একটা চেষ্টা |"
এরিক ভুরু কুঁচকে বলল, "চেষ্টা ? কিসের ? কিছু মানুষের মনের শান্তির ? আর কি তাছাড়া ?"
আলিজা কিছু বললনা |
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে এরিক দুহাতে একবার নিজের মাথা চেপে বলল, "লিজ তোমাকে আমি বলেছিলাম মনে হয় যে আমরা পাঁচ ভাইবোন |"
"হ্যা | নিনা, পোর্টার, প্রেস্টন, তুমি আর রবার্ট |"
এরিক একটা লম্বা শ্বাস নিয়ে বলল, "লিজ আমি আমার সব ভাইবোনের কথা তোমাকে বললেও কোনদিন রবার্টকে নিয়ে কিছুই বলিনি তাইনা ?"
"না | তুমি ওর ব্যাপারে কিছু বলার সময় চুপ হয়ে যেতে | হয়ত তোমার ভালো লাগত না | তাই আমি কখনোই প্রশ্ন করিনি |"
"আমি রবার্টকে নিয়ে কথা বলতে চাইনা | কিন্তু আজ আমি নিজ থেকে বলছি | লিজ রবার্ট আমার তিন বছরের ছোট | ও আমার সবচেয়ে কাছের ছিল সব ভাইবোনদের মধ্যে | লিজ আমার বাবা রজারের একটা বড়বোন ছিল | নাম রেভানা | বাবা খুব ভালোবাসত রেভানাকে | রেভানা একটা বদমেজাজি, অসামাজিক আর উগ্র স্বভাবের মানুষ | রেভানা খুব মদ খেত আর ক্রিস্টাল মেথ ( একধরনের মাদকদ্রব্য ) নিত | ওর এই জঘন্য অভ্যাসের জন্য ওর একসময় কিডনি ফেইলর দেখা দিল | বাবার ডায়বেটিস তাই সে ডোনার হতে পারল না | আমাদের ভাইবোনদের মধ্যে নিনা আর রবার্টের সাথে ম্যাচিং হল | নিনা কোনভাবেই ডোনার হতে রাজি হল না | রবার্ট খুব নরম স্বভাবের মানুষ | ওকে রাজি করলো বাবা | আমরা কেউই এতে মত দিলাম না | কিন্তু বাবা ওকে ডোনার করে ট্রান্সপ্ল্যান্ট করলো রেভানাকে | সফল ট্রান্সপ্ল্যান্ট হল | কিন্তু আমার সেই ফুপু রেভানা নতুন জীবন পাবার বছর খানিকের মধ্যে আবার আগের মত বেপরোয়া হয়ে গেল | আমাদের সাথে, বাবার সাথে এমনকি যে ওকে নতুন জীবন দিয়েছে সেই রবার্টের সাথেও সব সম্পর্ক ছিন্ন করে এবার সে এক তাহিতিয়ান হিপ্পির প্রেমে পড়ে দেশ ছেড়ে চলে গেল | সে ওই হিপ্পির পাল্লায় পড়ে আবার মদ আর ড্রাগ ধরল | এরপর কিভাবে যেন ওই হিপ্পির সাথে ছাড়াছাড়ি হয়ে গেল তার | এই শোকে সে আরো তিনগুন মদ আর ড্রাগ নেয়া শুরু করল | পাঁচ বছর পর সে আবার আগের মত তার কিডনি বিকল করে মৃত্যুশয্যায় পড়ল |"
আলিজা বিস্মিত হয়ে চেয়ে রইল |
আইলান উঠে এসে এরিকের কাঁধে হাত রেখে বলল, "এরিক শান্ত হও |"
এরিক বহুকষ্টে নিজেকে একটু সামলে বলল, "রেভানা মারা গেল কিডনি ট্রান্সপ্ল্যান্টের পাঁচবছর সাতমাস পর |"
আলিজা কোনরকমে বলল, "কিন্তু রবার্ট ?"
এরিক আলিজার চোখের দিকে চেয়ে বলল, "রবার্ট ? ট্রান্সপ্ল্যান্টের একবছর চারমাসের মাথায় রবার্ট মারা গিয়েছে | ওর বয়স ছিল মাত্র চব্বিশ বছর | স্কলারশিপ নিয়ে ও স্ট্যানফোর্ডে 'ল পড়ছিল | ওর সামনে একটা চমৎকার জীবন ছিল |"
এরিক চোখ মুছে বলল, "রবার্ট যে হয়ত আরো চল্লিশবছর বাঁচত তাকে বাবা তার আবেগী ভুল সিদ্ধান্তের কারণে মেরে ফেলল ! আর যেই কিডনি ট্রান্সপ্ল্যান্টের জন্য সে মারা গেল সেই কিডনিটা রেভানা মদ, ড্রাগ আর এসটিডি দিয়ে নষ্ট করেছে !"
আলিজা এরিককে ধরে সোফায় বসালো | আইলান তাকে পানি এনে দিল একগ্লাস |
এরিক একনিমেষে পানির গ্লাস শেষ করে বলল, "আমার বাবার এই ভুল আমাদের সবাইকে ভিন্ন করে দিয়েছে |"
এরিক আলিজার হাতদুটো চেপে ধরে বলল, "লিজ, আমি তোমার কাছে অনুরোধ ভিক্ষা করে বলছি | এইরকম সিদ্ধান্ত নিওনা | কখনো না |"
আলিজা মাথা নাড়ল |
এরিক আলিজার দুইগালে হাতরেখে বলল, "আমি ভাবিনি কোনদিন যে এভাবে একই ঘটনা আবার আমার জীবনে ফেরত আসবে তাও তোমার উপর দিয়ে ! আমি আমার খুব কাছের অনেক মানুষকে হারিয়েছি | তোমাকে হারাতে চাইনা আমি | কখনো না |"
শাহানা ঘরে ঢুকে দেখল আইলান বেডের সামনে চেয়ারে বসা, সোফায় আলিজার গা ঘেঁষে তার হাতদুটো ধরে এরিক বসা | দুজনে মাথানিচু করে চুপচাপ বসে আছে |
শাহানা তাদের দিকে বিস্মিত হয়ে চেয়ে আইলানের দিকে তাকাতে আইলান নির্বিকারভাবে বলল, "কিছু বলবেন আরো ? জবাব পাননি ?"