এরিক তার বুকের উপর রাখা আলিজার হাতটার দিকে মুগ্ধচোখে চেয়ে আছে | আলিজার বাঁহাতের অনামিকার অঙ্গুরীয়র পান্নাটা ঝকমক করছে আধো আলোছায়ায় | তাকে ঘিরে দাঁড়ানো দুসারি হীরাগুলোও নিজেদের উজ্জ্বলতায় বিশাল পান্নাটিকে আরো জ্বাজ্যল্যমান করে তুলছে |
এরিক হাতটা ধরে হাতে ঠোঁট ছোঁয়ালো |
"ঘুমাচ্ছনা কেন এরিক ?"
এরিক মাথাটা একটু তুলে খানিকটা অবাক হয়েই বলল, "তুমি জেগে আছো লিজ ? আমি ভাবলাম ঘুমিয়ে কাদা !"
"না ঘুমাইনি | এরিক এখন ঘুমাও তো তুমি !"
"চেষ্টা করছি |" এরিক একটা হাই তুলল |
আলিজা উঠতে গেল, এরিক খপ করে ধরে ফেলল |
আলিজা এরিকের হাতের উপর হাতরেখে বলল, "ছাড়ো |"
"উঠছো কেন লিজ ?"
"অনেকক্ষনই তো রইলাম | এবার ঘুমাও তুমি |"
এরিক আবারো জিজ্ঞাসা করল, "কেন উঠছো ?"
"কেন কি ! কতক্ষন এভাবে থাকবো ? এত বেশিসময় রইলে পরে যদি তোমার বুকে ব্যাথা করে তখন ?"
এরিক আলিজাকে ঝটকায় কাছে টেনে বলল, "যদি উঠে যাও তো ব্যাথা করবে !"
আলিজা হেসে ফেলল, আবার এরিকের বুকের উপর মাথা রেখে শুয়ে পড়ল | একটু পর এরিক হেসে উঠল |
আলিজা একটু মাথাটা তুলে জিজ্ঞাসা করল, "হাসছো কেন ?"
এরিক আলিজার মুখের উপরে পড়া চুলগুলো আলতোকরে সরিয়ে দিয়ে বলল, "হঠাৎ মধুর এক পুরোনো স্মৃতি মনে পড়ল লিজ !"
"কি স্মৃতি ?"
"মিশিগান ! মনে পড়ে ?"
আলিজা সুন্দরকরে হেসে মাথা নেড়ে বলল, "পড়ে |"
এরিক আলিজাকে জড়িয়ে ধরে বলল, "কি দারুন ছিল সময়টা !"
.
.
.
এরিক প্রথমে প্রায় সাত সপ্তাহ ও পরবর্তীতে চারসপ্তাহ ও ছয় সপ্তাহ কর্মদিবসের বাইরে ছিল বলে সে পেশার স্বার্থে আর বর্ধিত ছুটি নিলো না | কিন্তু তার মনে খচখচ করতে লাগল যে সে কোথাও মধুচন্দ্রিমায় যেতে পারেনি বিয়ের পর |
ট্রায়ালের জন্য আলিজা কোথাও যায়নি আর তখন দম্পত্তি হিসেবে তাদের দূরত্ব ছিল অনেক ট্রায়ালের কিছু জন্য | কিন্তু ট্রায়াল শেষ হবারপর যখন সব দূরত্ব কয়েকমুর্তেই মিটে গেল সব তখন থেকেই এরিক স্ত্রীকে নিয়ে বেড়াতে যেতে চায় শুধু | কিন্তু সময় এতো কম যে ভেবে উঠতে পারছেনা সে গেলেও যাবেটা কই ! অবশেষে ভাবলো একটা ছোট্ট ভ্রমনে স্পেন যাবে | কিন্তু সপ্তাহখানিকের মধ্যে শুধু মাদ্রিদ-ই ঘুরে দেখা সম্ভব নয় তো পুরো স্পেন তো অসম্ভব ! কিন্তু তাও মনের শান্তি এই চিন্তাই করল এরিক |
এক পড়ন্ত বিকেলে ট্যারেসে এরিকের গায়ের উপর হেলান দিয়ে আলিজা বসে কফি খাচ্ছিলো দুজনে | কফি শেষ করে কিছুক্ষন আলিজার লম্বা চুলগুলো নিয়ে খেলা করে এরিক আলিজাকে জড়িয়ে ধরে বসে রইল |
কিছুক্ষন পর এরিক জিজ্ঞাসা করল, "লিজ কোথায় যেতে চাও ?"
আলিজা এরিকের হাতের উপর গালটা ছোঁয়ানো রেখে বলল, "কোথাও নয় এরিক !"
"তা বললে তো হবে না সুইটহার্ট ! বলো কিছু | কি ইচ্ছা ?"
"কিছুই না এরিক ! তুমি সাথে রয়েছো এই তো অনেক | আর কি করবো কোথাও গিয়ে !"
"লিজ ! বলো সুইটহার্ট কোথাও তো যেতে চাও !"
"হুমম | কিন্তু তোমার ছুটি শেষ প্রায় | এখন গিয়েও লাভ হবেনা | খুব তাড়াহুড়োয় থাকতে হবে !"
"পরে যেতে চাও ? ভেবে দেখো | আমি এবার কাজে গেলে কিন্তু একটানা কয়েকমাস আমাকে ইন্টারন্যাশনাল লংরুট ফ্লাইট এক্সক্যাজুয়েলড করা হবে | অন্তত চারমাস পর ফিরব |"
"এতদিন ?"
"হুম | কষ্ট হবে আমাকে ছেড়ে থাকতে ?"
আলিজা কিছুই বলল না, মলিনমুখে বসে রইল এরিকের বুকে মাথা রেখে |
এরিক আলিজার গালে হাত রেখে বলল, "আমার খুবই কষ্ট হবে এবার কাজে ফিরে | প্রতিটা মুহূর্ত তোমাকে মনে করব শুধু |"
আলিজা আহতস্বরে বলল, "এরিক কোথাও যেতে হবেনা | তুমি আর যে কয়েকদিন রয়েছো ঘরেই থাকো | এখন বেড়াতে গেলে অকারণ অনেকগুলো সময় নষ্ট হবে |"
"কিন্তু কোথাও কি যাবেনা ?"
"না |"
"তা কিকরে হয় লিজ ? আচ্ছা তুমি আমাদের বিয়ের পর ঠিকমত বাইরেও গেলে না | আমার কাছে কিছু চাইলেও না | শপিংয়ে যাবে লিজ ? চলো তাহলে আজ |"
"না এরিক | ভাইয়া এবার এতগুলো শাড়ি, জুতো, এক্সসেসোরি কিনে দিয়েছে যে অন্তত ছয়মাস আমার কিছুই কিনতে হবেনা |"
"ওগুলো তোমার ভাই দিয়েছে, আমি তো না | আমার কাছে কিছু চাও |"
আলিজা এরিকের হাতটা নিজের দুহাতের মাঝে নিয়ে বলল, "এরিক আমি কিছুই চাইনা আর | আমি তোমাকে পেয়েছি, আমি একজন সত্যিকারের ভালোবাসার মানুষ পেয়েছি | আমার এতবড় চাওয়া পূরণ হয়েছে তাই আর কিছুই চাইতে ইচ্ছা করে না |"
"কি অদ্ভুত কথা লিজ ! আচ্ছা তোমার কাছে আমার সাইন্ড চেক আর ক্রেডিটকার্ড দুটোই আছে | যা ভালোলাগে কিনো তুমি |"
"দুঃখিত এরিক ! ওই চেকটা আমি প্রাণ থাকতে কোনদিন ভাঙবোনা |"
এরিক হেসে আলিজার চুলের উপর চুমু দিয়ে বলল, "কি পাগলামো লিজ ! ভেঙে ফেলো ওটা |"
"না | কখনোই না |"
"আচ্ছা | রেখে দিও | আমি আরেকটা সই করে দিয়ে যাবো যাবার আগে |"
"দরকার নেই এরিক |"
"সেটা আমাকে বুঝতে দাও |"
"রাগ করলে এরিক ?"
"হাহ ! রাগ কেন করবো ! লিজ চল কোথাও যাই | আচ্ছা এককাজ করি | চলো সপ্তাহখানেকের জন্য স্পেন যাই |"
"এরিক তুমি এবার কাজে গিয়ে ফেরার পর প্রথমে বেলিজ যাবো | বেলিজ গিয়ে গ্রেট ব্লু হোল, গ্লোভারস এটল, জুনানটুনিক, একটুঁ টুনিচিল, ওরাকল স্টেপ পিরামিড, কিয়ে কালুকার, এম্বারগ্রিস কিয়ে, ব্লুহোল ন্যাশনাল পার্ক এসবকিছুই দেখবো | এরপর দক্ষিণ আমেরিকা যাবো |"
এরিক হেসে আলিজাকে জড়িয়ে ধরে আদরকরে বলল, "সব দেখাবো কথা দিচ্ছি | কিন্তু এটা আমার পরবর্তী ছুটির আগে নয় | আমরা আমাদের বিয়ের পর কোথাও তো গেলাম না |"
"যেতে হবে না |"
"গেলে ভালো হত | আচ্ছা যদি তোমার মত পাল্টায় তো বোলো আমাকে |"
.
সেরাতে ঘুমনোর সময় আলিজা এরিককে বলল, "এরিক তুমি সত্যিই যেতে চাচ্ছো কোথাও ?"
এরিক তার হাতের হুইস্কির গ্লাসে চুমুক দিয়ে বলল, "হ্যা | তবে সময় নেই বেশি | আমার ছুটি শেষ হতে আর চৌদ্দদিন | যাবার আগে প্যাকিং এর জন্য কিছু সময় রাখতে হবে | একদিন হলেই হবে |"
এরিক হাতের ড্রিঙ্কটা শেষ করে এসে আলিজাকে জড়িয়ে ধরে বলল, "এখন বলো কি বলতে চাও |"
আলিজা বিনা ভূমিকাতেই বলল, "আমি ভাবছিলাম একটা জায়গায় যাবার কথা |"
"কোথায় লিজ ?"
"মিশিগান |"
এরিক একটু অবাক হয়ে বলল, "মিশিগান ? মিশিগান কেন যেতে চাও ?"
"অনেক সুন্দর আর নিরিবিলি | আরেকটা সত্যি হল আমি কখনোই লেকসিটি দেখিনি |"
"ওহ ! মিশিগান সুন্দর জায়গা সেটা অস্বীকার করছিনা | কিন্তু মিশিগানেই যেতে চাও ? লিজ যদি চাও তো বেলিজেই নিয়ে যেতে পারি | হয়ত তোমার সব চাওয়ার জায়গায় যেতে পারবেনা কিন্তু দেশের বাইরে যেতে পারবে হানিমুনে |"
"এরিক যদি তোমার আপত্তি না থাকে তো মিশিগানেই চলো | আমি শুধু তোমার সময় আর সঙ্গ চাই | সেটার জন্য এই জায়গাটাই আমার পছন্দ হল |"
এরিক একটু হেসে বলল, "কোন আপত্তি নেই সুইটহার্ট !"
আলিজা শুয়ে পড়ে আবার এরিককে বলল, "এরিক এখন না হয় থাক | তুমি ফিরে এলে পরে আমরা যাব |"
এরিক আলিজাকে জড়িয়ে ধরে বলল, "কেন লিজ ? এখন আবার যেতে অনীহা কেন ?"
"এমনিতেই | থাক বরং এখন |"
"আচ্ছা |"
আলিজার মনে হল এরিক মিশিগান যেতে আগ্রহী নয় | আর সেটা হবার কথাও না |
.
সকালে এরিক উঠে রান্নাঘরে এসে দেখল আলিজা দুপুরের রান্নার জন্য হাঁস বের করে রেখেছে ডিফ্রস্ট হবার জন্য | তার সব নাশতা বানানো শেষ | রজার নাশতা করেও ফেলেছে | সে বাগানে গিয়েছে | এরিক হাঁসটার দিকে চেয়ে রয়েছে |
আলিজা তার নাশতা বেড়ে দিয়ে বলল, "কি দেখছো এরিক ?"
এরিক স্যান্ডউইচে কামড় বসিয়ে বলল, "তুমি কি খাবে ?"
আলিজা নিজের প্লেটের দিকে ইশারা করে বলল, "তুমি যা যা খাচ্ছো |"
"লিজ আমার জানামতে তুমি 'ডাক রেসিপি' কোনটাই খাওনা |"
"না | হাঁস আমি খেতে পারিনা |"
"তো ? তোমার জন্য কিছু রান্না করো |"
"দেখা যাক |"
এরিক এনিয়ে আরকিছুই না বলে খাওয়া শেষ করে ঘরে গেল | সে এখন আবার ঘুমিয়ে পড়বে |
আলিজা ঘরদোর সব পরিস্কার করে দোতালায় গিয়ে দেখল এরিক ঘুমাচ্ছে | আলিজা এরিকের পায়ের জুতো খুলে দিয়ে গায়ে চাদর টেনে দিয়ে এলো |
দুপুরের খাবারের আগেই এরিক উঠে গেল | এরিক মধ্যাহ্নভোজের সময় দেখল আলিজা শুধু ম্যাশড পটেটো, ব্রকলি আর ম্যাক এন্ড চিজ খাচ্ছে | সে ডিক্সি ডাক বা হইসিন সেসিমি গ্লেজড রোস্ট ডাক কোনটাই খাচ্ছেনা | এরিক কোন কথা না বলে খাওয়া শেষ করল |
.
রাতে আলিজা ঘরে ঢুকে দেখল এরিক ব্যাগ গুছাচ্ছে |
আলিজা হতবাক হয়ে বলল, "এরিক ? তুমি কি করছো ?"
এরিক ভাবলেশহীনভাবে বলল, "কাপড় গুছাচ্ছি | দেখতেই তো পাচ্ছো |"
"কিন্তু কেন ?"
"কালকের ফ্লাইট ধরতে হবে |"
"কিন্তু তোমার ছুটি তো শেষ হয়নি |"
"না |"
"তো ? এখনই কোথায় যাচ্ছো ?"
এরিক চুপ করে রইল |
আলিজার কোন কারন ছাড়াই কান্না পেয়ে গেল | কোনরকমে নিজেকে সামলে আলিজা জিজ্ঞাসা করল, "এরিক তুমি কি আমার উপর কিছু নিয়ে রাগ করেছো ?"
এরিক আলিজার দিকে না তাকিয়েই বলল, "হুমম | করেছি |"
আলিজা বিস্ময়ে থমকে গেল, সে কিছুই বললনা আর | আলিজা চুপচাপ ট্যারেসে চলে এলো |
কিছুক্ষন পর কফির মগ হাতে এরিক ট্যারেসে এলো | সে নীরবে কয়েকচুমুক খেয়ে মগটা আলিজার দিকে এগিয়ে দিলো, আলিজা মাথা নেড়ে না জানালো |
এরিক জিজ্ঞাসা করল, "তুমি দুপুরে নিজের জন্য কিছু রান্না কেন করলে না কেন ?"
আলিজা গম্ভীরভাবে বলল, "এই সামান্য কথাকে কেন্দ্র করে তুমি ছুটির আগেই কাজে ফিরতে চাও ?"
"কাজে ফিরছি কে বলল !"
"তো ব্যাগ কেন গুছিয়ে রেখেছো ? তুমি কোথায় যাচ্ছ ?"
"আমি নয়, আমরা যাচ্ছি | মিশিগান |"
আলিজা অবাক হয়ে বলল, "মিশিগান ?"
"হ্যা |"
"এরিক কোন দরকার নেই |"
"লিজ টিকেট হয়ে গিয়েছে |"
আলিজা এবার ব্যতিব্যস্ত হয়ে বলল, "কিন্তু এরিক আমি তো বললামই দরকার নেই |"
"কেন দরকার নেই ?"
"মানে তুমি চাচ্ছনা |"
এরিক আলিজাকে দুহাতে জড়িয়ে বলল, "আমি চাচ্ছি যদি বলি ?"
"তুমি তো ডোমেস্টিক ভ্যাকেশন পছন্দ করো না |"
"অবশ্যই করি | লিজ গোছগাছ করে নাও | কাল বিকেলে ফ্লাইট | ঘন্টা চারেক লাগবে | রাতে পৌঁছে যাবো ডেট্রয়েট |"
আলিজা উচ্ছাস চেপে কোনরকমে বলল, "এরিক সত্যিই তুমি যেতে চাও ?"
"লিজ আমরা যাচ্ছি | এমনিতেও পাঁচবছরের বেশিই হবে মিশিগান যাইনা | তোমার কল্যানে এবার একটু দর্শন দেয়া হবে |"
আলিজা উচ্ছাসে এরিককে জড়িয়ে ধরে বলল, "এরিক তুমি রাগ কেন করেছো ?"
"কারন তুমি এখনও সংকোচ করো আমাকে সেজন্য |"
"আর করবোনা |"
"যাও গুছিয়ে নাও জামাকাপড় | আজকেই সব সেরে নাও |"
আলিজা দ্রুত দৌড়ে গেল সব গুছিয়ে যাবার প্রস্তুতি নিতে |
এরিক বিছানায় বসে বলল, "লিজ কিছু গরম কাপড় নিও | লেকসিটি ওটা | প্রায়ই আবহাওয়া এলোমেলো হয়ে যায় |"
আলিজা ক্লোজেট থেকে শাল নামিয়ে বলল, "অনেক ঠান্ডা পড়বে নাতো ?"
"একটা ট্রেঞ্চ নাও |"
"এরিক পথে কোথাও কি থামবে ?"
"হুমম | ডগলাস |"
"ডগলাস ? মানে শেরোলেট ?"
"হুম |"
"এরিক আমরা কি ............"
এরিক একটা ছোট নিঃশ্বাস ফেলে বলল, "হুমম লিজ | এই প্রথম আমি ফ্যামিলি ট্রিপ নিচ্ছি | কি করব বলো ! ইউনাইটেড আর জেটব্লু-তে কাল যাবার মত এভেইলেবল সিট নেই | তাই বাধ্যই হলাম একপ্রকার |"
আলিজা হেসে বলল, "কিন্তু চাইলে তো তুমি ননস্টপ টিকেটই নিতে পারতে ডেল্টা থেকে ! কিন্তু উঠবেনা তুমি !"
এরিক হেসে উত্তর দিল, "ব্যাগ গোছাও লিজ !" ( আমেরিকান এয়ারলাইনস-এ কর্মরত বৈমানিকেরা সচরাচর কখনোই 'ডেল্টা এয়ারলাইনস'-এ ভ্রমন করেন না | )
এরিক বিছানায় হেলান দিয়ে শুয়ে বলল, "লিজ কাল কিন্তু একটু সজ্জা করে বের হয়ো | যদিও তুমি ঘরে-বাইরে সবসময়ই গুছিয়ে সুন্দর রাখো নিজেকে কিন্তু তাও কাল বিশেষ লাগা চাই |"
আলিজা লাজুক হেসে বলল, "আচ্ছা এরিক |"
পরদিন রজার হাসিমুখে পুত্র আর পুত্রবধূকে বিদায় দিলেন |
.
.
.
আলিজা ট্যাক্সি থেকে নেমে দাঁড়ালো | বিয়ের পর আজকে এরিকের সাথে তার প্রথম আকাশযাত্রা | এরিক ব্যাগগুলো সব ট্রলিতে নিয়ে আলিজাকে সাথে আসতে ইশারা করল | তাদের টার্মিনালে গিয়ে এরিক প্রথমে ব্যাগগুলো তাদের ফ্লাইটের ব্যাগ সেকশনে দিয়ে এলো |
এরিক ব্যাগ দিয়ে এসে দেখল অনেকেই দেখছে অদূরে দাঁড়িয়ে থাকা আলিজাকে | আলিজা এরিকের কথা রেখেছে, আজকে তাকে দর্শনীয় আর অতি আকর্ষণীয়াই মনে হচ্ছে | পরনে অফহোয়াইট লেসের শাড়ি আর কাঁধে ক্রিমরঙের সিল্কের শাল, পায়ে রুপালি হিলস্যান্ডেল, লম্বা চুলগুলো আজ বাম্প করে ছেড়ে রেখেছে যা কোমর ছাড়িয়ে নেমে পড়েছে, কাজলটানা চোখ, হালকা সাজগোজ, কানে আর হাতে চকচকে সাদা পাথরের গহনা আর কপালের চিকচিক করতে থাকা পাথরের টিপটা | সবমিলিয়ে এক মনোরম মুগ্ধতা ! এজন্যই অনেকেই তাকাচ্ছে তার দিকে |
এরিক এসে আলিজার হাতটা ধরে বলল, "চলো সুইটহার্ট ! ফ্লাইটের দেরি নেই | আমরা লাউঞ্জে বসি |"
এরিক আলিজাকে নিয়ে লাউঞ্জে বসার একটু পরেই একজন "ড্যানিয়েলস ? ইজ দ্যাট ইউ বাডি ? ( ড্যানিয়েলস ? বন্ধু তুমি নাকি ? )" বলে ডেকে উঠল |
এরিক ঘুরে তাকিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে হাসিমুখে এগিয়ে গেল | সে একটুপর একজন একজন মেক্সিকান ভদ্রলোককে নিয়ে আলিজার সামনে এলো |
এরিক সেই বৈমানিকের পোশাক পড়া ভদ্রলোককে বলল, "পেরেজ এই হচ্ছে সেই | মাই সোয়ান !"
আলিজাকে উদ্দেশ্য করে এরিক বলল, "আর লিজ ও হচ্ছে কনজুয়েল পেরেজ | আমাদের আজকের ফার্স্ট অফিসার আর আমার একজন ভালো বন্ধু ও সহকর্মী |"
আলিজা হেসে কুশল বিনিময় করল |
ভদ্রলোক এরিকের দিকে তাকিয়ে বিশেষভাবে মাথা নেড়ে বললেন, "এরিক ! তুমি সত্যিই ভাগ্যবান !"
লোকটা যাবার আগে এরিকের টিকেট দেখে বললেন, "এরিক একি কথা ? প্রিমিয়াম ইকোনোমি কেন ?"
এরিক বলল, "কি করব বলো ! বিজনেস আর ফার্স্টক্লাস টিকেট নেই আর যখন স্টিভকে ফোন করি আমি |"
পেরেজ ভদ্রলোকটি বললেন, "আমার জানামতে একটা রিজার্ভ ফার্স্টক্লাস আছে | আমি সুইং ( পরিবর্তন ) করে দিচ্ছি |"
আলিজা বলল, "না না | এর দরকার নেই |"
পেরেজ বললেন, "আরে এটা আমাদের কর্তব্য আপনার প্রতি |"
এরিক হেসে আলিজাকে সাথে নিয়ে এসে বসল | ফ্লাইট এনাউন্স হবার পর উঠল এরিক আলিজার হাতটা ধরে | ট্রান্সমিট থেকে রানওয়ে পর্যন্ত অনেকসংখ্যক এএ কর্মকর্তা ও বৈমানিকরা সবাই নিজ থেকেই পরিচিত হল আলিজার সঙ্গে |
প্লেনে উঠার আগে পিছন থেকে কেউ বলল, "আর যদি ফ্লাইটে কোন সমস্যা হয় কি আমার হার্টএটাক হয় তো আমরা একজন খুব দক্ষ আর অভিজ্ঞ অতিরিক্ত ক্যাপ্টেন পাচ্ছি !"
এরিক ফিরে তাকিয়ে হেসে এগিয়ে এসে এক পঞ্চাশোর্ধ বয়স্থ ব্যক্তির সঙ্গে হাতমিলিয়ে জড়িয়ে ধরল তাকে | ভদ্রলোক বৈমানিকের পোশাক পড়া |
এরিক আলিজাকে কাছে আসতে বলে বলল, "লিজ আমার বন্ধুর সঙ্গে দেখা করে নাও | আমাদের আজকের ফ্লাইটের ক্যাপ্টেন ও |"
আলিজা এগিয়ে এসে হেসে সামনে দাঁড়াল |
এরিক বলল, "লিজ ও আমার সহকর্মী আর খুব ভালো বন্ধু রেক্স হার্পার | আর হ্যা খুবই দক্ষ একজন বৈমানিক ও ! কাজেই ওর কথা বিশ্বাস করোনা | আজকে আমি শুধুই আমেরিকান এয়ারলাইনসের একজন যাত্রী, ক্যাপ্টেন নই |"
এরিক আলিজাকে পরিচয় করিয়ে দিল তার বন্ধুর সঙ্গে |
.
.
আলিজা এই প্রথম আজ আমেরিকান এয়ারলাইনসের একটা 'এয়ারবাস' প্লেনে উঠল | তার কেমন অদ্ভুত লাগছে ! আচ্ছা এরিক কি একদিন দেরি করে অন্যকোন এয়ারলাইনসের টিকিট নিতে পারল না !
স্টিয়ার্ডেস অভিনন্দন জানাতে গিয়েই হেসে ফেলল এরিককে দেখে | তাও কোনরকমে নিজের পেশাদারিত্ব বজায় রেখে বলল, "ওয়েলকাম এবোর্ড টু এমেরিক্যান এয়ারলাইনস স্যার ! ( আমেরিকান এয়ারলাইনসে আপনাকে স্বাগতম )"
এরিক একটু হেসে মাথা নেড়ে ভেতরে চলে গেল আলিজার হাতটা ধরে |
এরিক একটু এগুতেই একজন ফ্লাইট এটেন্ডেন্ট এসে বলল, "ক্যাপ্টেন ড্যানিয়েলস দিস ওয়ে প্লিজ | ( ক্যাপ্টেন ড্যানিয়েলস এদিকে আসুন দয়া করে | )"
এরিক বলল, "শন আমাকে আজ ক্যাপ্টেন বলো না !" সেই এটেন্ডেন্টটি বলল, "আপনাকে ক্যাপ্টেনই বলতে হবে আমাকে | আসুন এদিকে | আপনাদের আসন ফার্স্টক্লাসে দেয়া হয়েছে |"
এরিক আলিজাকে নিয়ে বসার পর ফ্লাইট এটেন্ডেন্ট শন বিদায় নিয়ে গেল | তারপরেই একজন এয়ারহোস্টেস এলো | এরিক পরিচিত ভঙ্গিতে মৃদু হাসল |
এয়ারহোস্টেস এগিয়ে এসে সুন্দর একটা হাসি দিয়ে বলল, "গুড আফটারনুন ক্যাপ্টেন ড্যানিয়েলস ! এন্ড গুড আফটারনুন এন্ড ওয়েলকাম টু দা আমেরিকান এয়ারলাইনস ফ্যামিলি মিসেস ড্যানিয়েলস ! ( শুভ অপরাহ্ন ক্যাপ্টেন ড্যানিয়েলস ! আর শুভ অপরাহ্ন মিসেস ড্যানিয়েলস এবং আমেরিকান এয়ারলাইনস পরিবারে আপনাকে স্বাগতম ! )"
আলিজা বহুকষ্টে নিজের অস্বস্তি চেপে একটু হেসে বলল, "ধন্যবাদ |"
এরিক মেয়েটিকে বলল, "লৌনা আজকে অন্তত আমাকে বারবার ক্যাপ্টেন সম্বোধন করোনা | এমনিতেই আমার স্ত্রী খুবই বিব্রত এই পরিস্থিতিতে |"
মেয়েটি একটু ঝুঁকে আলিজাকে জিজ্ঞাসা করল, "ম্যাম আপনার কোন সমস্যা হচ্ছে কি ? আমাকে বলুন আমি যতদূর সম্ভব সাহায্য করব |"
আলিজা হাসার চেষ্টা করে বলল, "কোন সমস্যা নেই | আসলে আমি এরকম এতটা অভ্যর্থ্যনাময় পরিবেশে অভ্যস্ত নই |"
মেয়েটি হেসে বলল, "ম্যাম এটা আপনার প্রতি আজ আমাদের কর্তব্য | আর এমনিতেও ক্যাপ্টেন ড্যানিয়েলস ব্যক্তিগত ভ্রমন খুবই কম করেন তার কর্মস্থল বিমানে | আজকে উনি পারিবারিকভাবে ভ্রমন করছেন আমাদের সাথে তাই এটা আপনার আর তার সম্মানে আমাদের কর্তব্য | আপনি স্বস্তিতে বসে বিশ্রাম করুন | আর কোনরকম প্রয়োজন হলে আমাকে ডাকবেন | আপনাদের ভ্রমন সুখকর হোক |"
মেয়েটি চলে গেলে এরিক বলল, "আজকে তোমার কল্যানে আমিও অনেক সেবা পাবো |"
আলিজা এরিকের হাতের উপর হাতটা রেখে বলল, "তুমি সেবা নাও যত ইচ্ছা ! আমার খুবই অস্বস্তি লাগছে |"
"অস্বস্তির কিছুই নয় লিজ | এটা কর্তব্য | পেরেজের স্ত্রীকেও অনেক উষ্ণ অভ্যর্থনা দেয়া হয়েছিল | তবে তুমি বোধহয় একটু বেশিই পেলে !"
আলিজা এরিকের দিকে চেয়ে বলল, "এটা তোমার কল্যানে | তুমি এদের মাঝে খুবই জনপ্রিয় |"
এরিক ঠোঁটের কোনে হাসি এনে বলল, "তাই নাকি ?"
"তাই তো দেখছি !"
এরিক পাশে ঝুঁকে এসে আলিজাকে একবার আদর করল |
এরিক বলল, "তুমি একটু ঘুমাও | কাল রাতে গোছগাছ শেষ করে বড়জোর দুঘন্টা ঘুমিয়েছো |"
আলিজা মাথা নাড়ল, বলল, "আসবেনা বোধহয় ঘুম |"
এরিক আলিজার চুলে আঙ্গুল চালিয়ে বলল, "আমার মনে হচ্ছে কি জানো ? মনে হচ্ছে প্রিমিয়াম ইকোনোমি নিলে ভালো হত | এই চারঘন্টা তোমার একেবারে কাছে থাকতাম !"
ফার্স্টক্লাসের আসনগুলো প্রশস্ত আর আসনদূরত্ব কিছুটা বেশি |
আলিজা এরিকের হাতটা ধরে বলল, "আমরা কাছেই আছি এরিক |"
এরিক হেসে বলল, "তুমি সকালে তেমন কিছুই খাওনি | খেয়ে নিও ঠিকমত কেমন | এটা কোথাও থামবেনা, ননস্টপ ফ্লাইট এটা |"
"ঠিক আছে এরিক |"
ডিপার্চারের একটু আগে এরিক উঠে এসে আলিজার সিটবেল্ট লাগিয়ে দিলো |
আলিজা এরিকের দিকে মুগ্ধদৃষ্টিতে চেয়ে আছে দেখে এরিক ইশারায় জিজ্ঞাসা করল "কি ?"
আলিজা দারুন একটা হাসি দিয়ে বলল, "কিছুই না |"
এরিককে এত চমৎকার লাগছে এই কালো স্যুট আর ব্লুবেরি রঙের শার্টটায় |
ক্যাপ্টেনের এনাউন্সমেন্ট হবার পরেই আলিজার হাতটা ধরে আলিজার দিকে তাকাল এরিক | সম্পূর্ণ ডিপার্চারের সময়টা এরিক আলিজার হাতটা নিজের দুহাতের মাঝে ধরে রইল |
.
.
ডেট্রয়েট ডিএমডাবলুসিএ পৌঁছাতে রাত দশটা দশ বাজলো | সবার সাথে আরেকদফা কথা বলে এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়ে এলো দুজন | এরিক বলল, "লিজ কিছু খেয়ে নেয়া দরকার | হোটেল গিয়ে খাবে না এখানেই কোথাও খেয়ে নেবে ?"
আলিজা বলল, "আগে হোটেলেই চলো |"
রাতে হোটেল পৌঁছে খেয়েদেয়ে শুয়ে পড়ল এরিক দ্রুতই |
সকালে উঠে এরিকের হাত ছাড়িয়ে গায়ে চাদর টেনে দিয়ে আলিজা উঠে জানালার সামনে এসে থমকে গেল | হোটেলের জানালা দিয়ে লেক মিশিগান -এর ( যুক্তরাষ্ট্রের মিশিগান, ইন্ডিয়ানা, এলেনোয় ও উইস্কনসিন স্টেটের মধ্যে অবস্থিত মিশিগান হ্রদ ) চমৎকার নয়নাভিরাম সূর্যোদয় দেখা যাচ্ছে | লেকের পানি যেন উজ্জ্বল জাফরানি আবির মেখেছে ! পাখি উড়ে যাচ্ছে | লেকে দুএকটা ছোট কায়াকি ( ছোট নৌকাবিশেষ ) চোখে পড়ছে আর অদূরে মিশিগান লেকের অন্যতম দর্শনীয় বস্তু 'লাইটহাউজ' ( বাতিঘর , মিশিগানে ১২৯টি বাতিঘর রয়েছে ) দৃষ্টিতে এলো |
আলিজা তার রোবটা গায়ে জড়িয়ে ব্যালকনিতে এলো | বেশ ঠান্ডা বাইরে লেকের বাতাসে | কিন্তু চমৎকার আর শান্ত প্রাকৃতিক সৌন্দর্য তার অনুভুতিকে গ্রাস করে ফেলল |
আলিজা একদৃষ্টিতে লেকের দিকে তাকিয়ে আছে এমন সময় এরিক পেছনথেকে এসে কম্বলসহ তাকে জড়িয়ে ধরল | এরিক আলিজাকে কম্বলে জড়িয়ে নিজের গায়ের কাছে টেনে নিয়ে বলল, "এই লেকের বাতাসে গরম কাপড় ছাড়া সকালে দাড়িওনা লিজ | তোমার জোট ইচ্ছা লেকের দৃশ্য দ্যাখো কিন্তু গায়ে অবশ্যই গরম কাপড় পড়ে নেবে |"
এরিক একটুপর জিজ্ঞাসা করল, "আজকে কোথায় যাবে ?"
আলিজা বলল, "লেক মিশিগান ঘুরবো |"
"লিজ তাহলে কালকে কেন্টউড যাই কি বলো ?"
"তুমি যা ভালো বুঝবে এরিক ! আমি তো এসবের কিছুই জানিনা |"
এরিক আলিজার গালে চুমু দিয়ে বলল, "তোমাকে ওসব না ভাবলেও হবে | তুমি শুধু কোথায় কোথায় যেতে চাও সেটা ভাবো |"
"আজকে ওয়েস্ট দেখবো যতটা পারি | আচ্ছা এরিক যদি মিশিগান দেখা শেষ হয় তো আমরা কি লেক সুপিরিয়র দেখতে পারবো ?"
এরিক হেসে বলল, "অবশ্যই লিজ | আর এটা আমি তোমাকে নিশ্চয়তা দিয়ে বলতে পারি যে লেক সুপিরিয়র খুব সুন্দর |"
সারাটাদিন কখন কেটে গেল বোনানজা ফলস আর সন্ধ্যা কেটে গেল গ্র্যান্ড হ্যাভেন বেড়াতে | পরদিন শুধু ওয়েস্ট মিশিগানে ঘোরা হল | এরপর একে একে আইল রয়াল পার্ক, সেন্ট এগনেস লাইটহাউজ, হল্যান্ডের বিশাল টিউলিপ বাগান, পেট্রোস্কি রোকস, সুগারলোফ মাউন্টেন, লেক হিউরোন, হেনরি ফোর্ড মিউজিয়াম, ম্যাকিনাক আইল্যান্ড, ম্যাকিনাক ব্রিজ, ফ্রাকেনমুথ ব্রনারস-এ ডিনার, লেক মিশিগানের বেলাভূমি, ডেট্রয়েট ইনস্টিটিউট অব আর্টস, গ্রান্ড রেপিডস, এন আরবর, স্লিপিং বেয়ার ডুনস, কালামাজু, গ্রেট লেকস বে, পিকচার্ড রক লেকশোর, গ্র্যাস রিভার, থর্ন সুইফট, এস্টিভেন্ট পাইনস, শিওয়াসী রিজার্ভ, মেইন্সটি ও অন্তত দশটা বিখ্যাত লাইটহাউজ দেখা হল | কিছু কিছু জায়গা একাধিকবার দেখা হল |
কখন যে বারোটা দিন পার হল এরিক টেরই পেলোনা | সবশেষের দিন লেক সেন্ট ক্লেয়ার দেখে রিচমন্ডের ফ্লাইট ধরল দুজন | ফ্লাইটে এরিক বারবার আলিজার দিকে তাকালো | কি চমৎকার গিয়েছে এই দিনগুলো ! এতোই দারুন কেটেছে যে তা কবে শেষ হল তাও যেন বুঝে উঠলোনা এরিক | সুন্দর সময় কেন এত দ্রুত ফুরায় !
এরিক ঘরে ফিরে একবেলা বিশ্রাম করে যাবার প্রস্তুতি নিলো | পরদিন বিকেলে তার হ্যাঙ্গারে উপস্থিত হতে হবে | রাত আটটায় তার ইন্টারন্যাশনাল ফ্লাইট |
আলিজা এরিককে সরিয়ে দিয়ে তার ব্যাগ গোছাতে বসল | সবকিছু একেবারে পরিপাটি করে গুছিয়ে ব্যাগে তুলল | নিজের মন নিজেই বুঝতে পারছেনা আলিজা | এমন তো নয় যে আজই প্রথম এরিক ছুটি শেষে কাজে ফিরছে | কিন্তু এরকম কেন লাগছে তার ! সবকিছু যেন অস্থিরতায় ভরা !
সেরাতে ঘুমানোর সময় এরিক জিজ্ঞাসা করল, "লিজ কি হয়েছে তোমার ?"
আলিজা স্বাভাবিকভাবে বলল, "কিছুই তো না এরিক |"
"লিজ স্পষ্ট দেখছি আমি তুমি কেমন অস্বস্তিতে আছো | তোমার কি শরীর খারাপ লাগছে ? অসুস্থবোধ করছো ?"
"না এরিক কিছুই না |"
পরদিন সকালে একসাথে ব্রেকফাস্ট করল সবাই |
এরপর আলিজা রান্না করতে গেলে রজার বলল, "প্রিয় আজকে নয় | একে তো আজ তোমার মন বিক্ষিপ্ত আর আজকে তোমার রান্নাঘরে নয় এরিকের কাছে থাকা দরকার |"
এসে দেখল এরিক টিভি দেখছে |
আলিজাকে সে বলল, "তুমি দেখছি আমার ইউনিফর্ম ইস্ত্রি করে রেখেছো |"
আলিজা বলল, "কেন কি হয়েছে ?"
"কিছুনা | আমি ভেবেছিলাম তুমি ভুলে গিয়েছো |"
আলিজা একটু হেসে উঠে গেল |
দুপুরে খাওয়া শেষে ঘন্টাখানিক ঘুমিয়ে নিলো এরিক | ঘুম থেকে উঠে কফি বানাতে এলো কিন্তু দেখল আলিজা আগেই কফি মেশিনে কফি বানিয়ে রেখে গেছে | এরিক কফি খেয়ে ঘরে গেল | তাকে বেরুতে হবে কিছুক্ষনের মধ্যে |
আজকে এরিক ক্যাজুয়াল আউটফিটে নয়, তার সার্ভিস ইউনিফর্মেই যাবে ঠিক করল | স
ম্পূর্ণ পোশাক, জুতামোজা, ঘড়ি, রুমাল সব গুছিয়ে রেখে গিয়েছে আলিজা | এরিক তৈরী হয়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে টাইটা হাতে নিলো | এরিকের টাই পড়তে ভালো লাগেনা কিন্তু সামরিক আর বৈমানিকের পোশাকে টাই পড়া বাধ্যগত তাই পড়তেই হয় তাকে অনিচ্ছাসত্বেও |
এরিক টাই পড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে তখন আলিজা এসে তার কাঁধে হাত রাখল |
এরিক হাসিমুখে পেছন ফিরে বলল, "অনেক বড় ঝামেলা কম করে দিলে !"
আলিজা মুখে একচিলতে হাসি এনে এরিকের হাত থেকে টাইটা নিয়ে যত্নের সাথে এরিকের গলায় বেঁধে দিল |
শেষ হতে আলিজা বলল, "ঠিক হয়েছে তো ? দেখে নাও তুমি |"
এরিক আলিজার গালে হাত রেখে বলল, "তোমার হাতে তো ভুল হবেনা |"
আলিজা হেসে ফেলল | এরিক আলিজার থুতনিতে হাত রেখে বলল, "লিজ ! তাকাও তো আমার দিকে |"
আলিজা মাথা তুলে তাকালো | এরিক অবাক হয়ে দেখল আলিজার মুখটা হাসিহাসি কিন্তু চোখে টলমল করছে অশ্রু যেন যেকোন সময় বাধঁছাপিয়ে উপচে পড়বে |
এরিক আলিজাকে বুকের কাছে টেনে জড়িয়ে ধরে বলল, "মন কেন খারাপ করছো ? আমি যখন পারবো যোগাযোগ করবোই তোমার সঙ্গে | আর ছুটি পেলেই এসে পড়বো |"
আলিজা কিছু বললনা, শুধু মাথা নেড়ে সায় দিলো |
এরিক ট্যাক্সি ডাকতে গেলে রজার বলল, "আমি রেখে আসবো | আর এলিজের জন্য হ্যানিবল আছে |"
হ্যানিবল রজারের বিশাল ডোবারম্যান কুকুর |
রজার হ্যানিবলকে আলিজাকে দেখিয়ে বলল, "ওকে দেখে রাখবে |"
এরিক তাও আলিজাকে বলল, "ও যথেষ্টই শক্তিশালী তাও যদি কোন এমার্জেন্সি হয় তো জানোই তো কিচেনের চারনম্বর ড্রয়ারে হিডেন কম্পার্টমেন্টে স্পুনভল্টের নিচে লোডেড হ্যান্ডগান আছে একটা | ড্রয়ার কিভাবে খুলতে হবে আমি বলেছিলাম মনে আছে তো ?"
"হ্যা |"
"আর ওটা ৯এমএম হ্যান্ডগান | সেফটি ক্যাচ খুলতে হয় কিকরে খেয়াল আছে তো ?"
আলিজা একটু হেসে বলল, "সব মনে আছে | এরিক চিন্তা করোনা | কোনকিছুই হবে না | আমাকে অনন্ত কেউ কিডন্যাপ করতে কি মারতে আসবে না ! এত ভেবোনা তো |"
এরিক যাবার আগে আলিজাকে আদর করে আবারো বলল, "লিজ সাবধানে থেকো কেমন ?"
আলিজা হেসে মাথা নাড়ল |
রজার এরিককে নিয়ে গাড়িতে উঠল |
আলিজা জানালায় নক করল |
এরিক দ্রুত কাঁচ নামিয়ে বলল, "কি লিজ ?"
এরিক দরজা খুলে বেরুতে গেলে আলিজা বাধা দিয়ে বলল, "প্লিজ বের হতে হবে না |"
আলিজা এরিকের সার্ভিস হ্যাটটা এগিয়ে দিলো, এরিক সোফার উপর রেখে চলে এসেছিলো | এরিক হ্যাটটা হাতে নিলো | এই হ্যাটের জন্যই আবার দেখা হয়েছিল আলিজার সাথে তার |
এরিক আলিজার দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসল | আলিজা হেসে বিদায় দিলো |
ঘরে এসে সোফায় বসল আলিজা | সব হঠাৎ কেমন অপরিচিত লাগছে তার | এমন কেন হচ্ছে ! হঠাৎ ঝরঝর করে কান্না শুরু করল সে | এতকষ্ট কেন হচ্ছে বুকের মাঝে তার !
আলিজা জুতাসহই সোফার উপর দুইপা তুলে জড়সড় হয়ে বসে কাঁদতে লাগল | তার কান্না দেখে হ্যানিবল এদিক ওদিক লাফিয়ে চেষ্টা করতে লাগল কান্না থামাবার | আলিজা একটু পর উঠে ট্যারেসে গিয়ে বসল চোখবন্ধ করে |
.
.
.
গাড়িতে একদম চুপচাপ এরিক |
রজার একবার শুধু জিজ্ঞাসা করলেন , "কি হয়েছে এরিক ?"
এরিক একটু হাসার চেষ্টা করে বলল, "কিছু না ড্যাড !"
কিছুক্ষণ পর এরিক হঠাৎ রজারকে বলল, "ড্যাড গাড়ি ঘোরাও !"
"কেন ?"
"প্রশ্ন করোনা ড্যাড গাড়ি ঘোরাও |"
রজার হেসে ইউটার্ন করলেন আর স্পিড ৭০কিমি তুলে দ্রুত চালাতে লাগলেন |
ড্রাইভওয়েতে এসে পৌঁছাতেই গাড়ি পুরোপুরি থামার আগেই এরিক নেমে গেল দরজা খুলে |
রজার পেছনথেকে ডেকে বললেন, "তোমার তো আটটায় ফ্লাইট | এখান থেকে সাতটায় বেরুলেই হবে |"
এরিক পেছনে তাকিয়ে একটু হাসল |
দ্রুতপায়ে ঘরে ঢুকে গেল এরিক | এরিক প্রায় দৌড়ে বেডরুমে ঢুকে দেখল ট্যারেসের দরজা খোলা |
এরিক এবার ধীরপায়ে ট্যারেসে গিয়ে দেখল আলিজা হাঁটুমুড়ে মেঝেতে বসে আর হ্যানিবল পাশে বসা | এরিককে দেখে হ্যানিবল ডেকে উঠল আর আলিজা চমকে পিছনে তাকালো |
আলিজার বিস্ময়ের ঘোর যেন কাটলোনা ! এরিক দাঁড়িয়ে |
এরিক আলিজার সামনে এসে ঝুঁকে বসে আলিজার হাতটা ধরে তাকে ধরে তুলল |
আলিজা কোনরকমে বলল, "তুমি যাওনি ?"
এরিক আর্দ্রস্বরে বলল, "তোমার কাছে বিদায় না নিয়ে কিকরে যেতাম !"
এরিক মুহূর্তেরমধ্যে দুহাতে শক্তকরে জড়িয়ে ধরে অধরবন্দী করল আলিজাকে |
এরিক আলিজাকে অধরমুক্ত করে বুকের মাঝে টেনে জড়িয়ে ধরে বলল, "বলেছিলাম না তোমাকে ! এবার অনেক কষ্ট হবে আমার |"
.
সন্ধ্যা পেরুনোর পর এরিকের হাতের বন্ধন থেকে নিজেকে মুক্ত করে আলিজা বলল, "এবার যেতে হবে তোমাকে |"
এরিক বলল, "আমি হ্যাঙ্গারে ফোন করে নিষেধ করে দিচ্ছি |"
"না | যাও |"
"তুমি আবার কাঁদো যদি তো ?"
আলিজা এরিকের হাতটা ধরে বলল, "আর কাঁদবনা |"
এরিক আবার আলিজার ঠোঁটের উপর আদরকরে বলল, "কাঁদবেনা তুমি আর |"
আলিজা বলল, "না | আর কাঁদবনা |"