সকালে মনজুরের ফোনে আইলানের ঘুম ভেঙে গেল | ফোন ধরতেই মনজুর খরখরে গলায় অভিযোগ করলেন, "কিরে কি ব্যাপার কি তোর ? একটা দায়িত্ব তো তোর আছে এখানে নাকি ? সেই যে গেলি আর তো নামও নিলিনা আসার ! এখানে কিছু কাজ তো তোর আছে নাকি !"
আইলান উঠে বসে বলল, "কি হয়েছেটা বাবা ? এমন করছো কেন ?"
"তোদের তো অতটা জ্ঞানবুদ্ধি আল্লাহতায়ালা দেয় নাই কাজেই বলে তো লাভ নেই | সব মানুষেরই একটা নির্দিষ্ট কর্তব্য আছে | তাদের একটা দায়িত্ববোধ তো থাকতে হয় | পৃথিবীতে সব মানুষের একটা নির্দিষ্ট কাজ.........''
আইলান বিরক্ত হয়ে মনজুরকে থামিয়ে দিয়ে বলল, "বাবা নসিয়ত না দিয়ে হয়েছেটা কি সেটা বল ! আমি তো গতকাল বললামই যে আমি আসবো আজ তো এত কথা কেন বলছো ?"
মনজুর একটু মিইয়ে গেলেন ছেলের জবাবে, বললেন, "না মানে কালকে তো আসলিনা তুই তাই |"
"কাল গিয়ে করতামটা কি আমি ? দরকার কি ছিল কোন ? আমি তো টাকা দিয়েই এসেছিলাম তোমাকে |"
মনজুর বেশ নরম হয়ে বললেন, "তাও আসতে হয় | এরকম কিছু হয়েছে আসা উচিত ছিল তোদের | তুই না আসলেও আলিজা তো এসে পড়তে পারত | সবাই বলছিল বারবার |"
"সবাই বললে আমার তাতে কিছুই না বাবা | আর আলিজা গিয়ে করবেটা কি ওখানে ?"
"কি বলিস কত কাজ এখানে আজকে | ওকে তো থাকতে হয় এখানে নাকি ! আর শোন তোর মেজোচাচা আসবে আজ, সাথে ওর মেয়েজামাইটাও আসবে হয়ত | তুই রেখে যাস আজ আলিজাকে | রান্নাটান্না করতে হবে তো জামাই আসবে যেহেতু |"
আইলান বেশ অপ্রসন্ন হয়ে বলল, "আলিজা বুয়া না কোন যে মিলাদের বিরিয়ানি রান্নার মসলা বাটবে, মাংস কাটবে, আর ঘন্টায় ঘন্টায় পঞ্চাশজন লোকের চা বানাবে ওখানে গিয়ে | আর তোমার মেহমানের মেহমানদারী তুমিই করো | ওর কোন দায় পড়েনি যে ও গিয়ে এদের রেঁধেবেড়ে খাওয়াবে আর আজেবাজে কথা শুনবে !"
মনজুর আহতস্বরে বলল, "আত্মীয়স্বজনদের সেবা যত্ন করবে এটা তো কর্তব্য | এতে দায়ের কি হল ? দ্যাখ অনেক বড়বড় আলেমরা বলে ......"
আইলান রাগ হয়ে বলল, "বাবা আমার এখন এত জ্ঞানের কথা শুনতে ইচ্ছা করছে না | আমি আসবো আজ | কিন্তু আলিজা যাবে না | ওকে আমি কাল মিলাদের সময় নিয়ে আসবো |"
আইলান ফোন রেখে দিল |আইলান জিজ্ঞাসা করল, "এরিক ওঠেনি এখনো ?"
আলিজা টোস্টে মাখন লাগাতে লাগাতে বলল, "না | এত সকালে ওঠে না ও |"
আইলান একটু অবাক হয়ে বলল, "তাই নাকি ! ওকে তো খুব হেলথ কনশাস ( স্বাস্থ্য সচেতন ) মনে হয় |"
"তাই ? এত হেলথ কনশাস যে গতরাতে প্রায় একাই একটা একলিটারের বাটারস্কচ জেলাটো খেয়ে ফেলেছে !"
"না মানে মনে হয়না ও ঠিক ডায়েট পার্সন ! কিন্তু ফিটনেস মেন্টেন করে তো অবশ্যই | অনেক ফিট |"
"হুম | কিন্তু ওর সব ফিটনেস রুটিন ও নিজেরমত পালন করে | কোন বাঁধাধরা রুটিনে নয় |"
আলিজা হাতের টোস্টটা আইলানকে দিয়ে বলল, "আস্তে খাতো ! কেমন গপগপ করে গিলছিস !"
"তুই খাচ্ছিস না কেন ?"
"আগে খেয়ে নে তুই |"
"না | খা তুই আমার সাথে |"
আইলান একটা টোস্টেড স্যান্ডউইচ আলিজার মুখের সামনে ধরে বলল, "খা নইলে নইলে আমি খাবোনা |"
আলিজা এককামড় খেয়ে বলল, "কোথাও কি যাচ্ছিস এখন ?"
আইলান স্যান্ডউইচটায় কামড় বসিয়ে বলল, "হুমম | একটু এটিএম বুথে যাবো আগে | ওখান থেকে নয়াপল্টন যেতে হবে | কালকের মিলাদের জন্য যেয়ে কথা বলতে হবে |''
"তাহলেতো আমাকেও যেতে বলেছে হয়ত |"
"হুমম | কিন্তু তুই যাচ্ছিস না | তুই থাক ঘরে | আমি যাই দেখি কি কি ওরা বাবাকে কবুল করিয়েছে !"
"ভাইয়া আমিও যাই চল | আমাকেও তো থাকতে হবে |"
আইলান আলিজার গালে হাত রেখে বলল, "না লক্ষ্মী আমার | তুই যাচ্ছিস না আজ ওখানে | তুই গেলেই হারামিগুলো নানান বাহানায় আটকে দেবে তোকে আর শতেক ফুটফরমাশ করবে | আমার বুকের মধ্যে জ্বালা করে ওরা তোর সাথে এমন করলে | তুই থাক | আমি একাই যাবো | কাল নিয়ে যাবো তোকে | সাথে নিয়ে যাবো আবার নিয়ে চলে আসবো | এখন থেকে শুধু আমার কাছে থাকবি তুই |"
"কিন্তু কাজকর্মও তো আছে ওখানে |"
"বুয়াকে অতিরিক্ত মানুষ আনতে বলব | টাকা দিয়ে আসবো আলাদা | তোর কাজ নয় এসব | শোন আমি বাবা নই | বাবা আর শাহানার ওসব চিন্তা থাকতে পারে যে ঘরের মেয়েমানুষের দুটোই প্রয়োজন; হয় ঘরের সব কাজ করো ও বাচ্চা দ্যাখো বুয়া আর আয়ার মত নয়ত টাকা রোজগার করো | আমি এই ধারণাই মানিনা |"
আলিজা একটু হেসে বলল, "তো ?"
আইলান আলিজার হাতটা ধরে বলল, "তুই আমার সব জোরের উৎস | আমার মনের শান্তি | আমার সব আশ্রয় তুই | তুই যখন দূরে গেলি তখন বুঝলাম যে তুই না থাকলে কতটা অসহায় আমি | ওরা বুঝবেনা কোনদিন আর বোঝার দরকারও নেই ওদের | আমি বুঝতে পেরেছি তাই আমার নিজের স্বার্থেই তোর সব দায়িত্ব আমার |"
আলিজা ক্যারামেল পুডিংটা স্লাইস করে একটা বড় টুকরো নিয়ে আইলানকে চামচে করে মুখে তুলে দিয়ে বলল, "তুই কি বুঝতে পারছিস যে তোর আমাকে নিয়ে এই অবসেশন তোকে কতটা সমস্যায় ফেলতে পারে ?"
"কি সমস্যা ? এই আলিজা খুব সুস্বাদু হয়েছে এটা | খেয়ে দ্যাখ একটু |"
"আমি পরে খাবো | তুই আগে খা | বাইরে যাবি তুই |"
আইলান আলিজার হাত থেকে চামচটা নিয়ে একটু পুডিং আলিজার মুখে তুলে দিয়ে বলল, "কি সমস্যার কথা বলছিস ?"
"তোকে কি নিজের লাইফ নিয়ে ভাবতে হবে নারে ?"
"তোর অবস্থানটা বিনাবাক্যে মেনে নিয়ে যে আমার জীবনে আসতে পারবে সেই শুধু আসবে | দ্যাখ কি বলবি আমি জানি | কিন্তু আমি তোকে নিজের অভিজ্ঞতা থেকেই বলতে পারি, অনেককিছু দেখেছি আর সহ্যও করেছি আর সেজন্যই সত্যিটা জানতে পেরেছি | সেজন্যই জানি যে মনের শান্তিটা কতটা জরুরি | মনের শান্তিটা আসে একেবারে আত্মাথেকে তৈরী নিঃস্বার্থ ভালোবাসায়, ওটা ফিজিক্যাল নিড থেকে পাওয়া যায়না |"
"আচ্ছা ঠিক আছে | এ নিয়ে এখন না ভাবলেও হবে | তুই আরেকটা স্যান্ডউইচ খা | ওখানে গিয়ে কত দেরি হয় কে জানে |"
খাওয়া শেষে আলিজা বলল, "তুই গিয়ে রেডি হ | আমি চা আনি তোর |"
"তোর জন্যও আন | একসাথে চা খেয়ে যাই |"
আলিজা ঘরে ট্রে নিয়ে ঢুকে আইলানকে বলল, "শার্টটা বদলা ভাইয়া |"
"কেন ? কি হয়েছে ?"
"এতক্ষন এটা ঘরে পরে ছিলি | বাইরে এই কাপড় পড়ে কেন যাবি ?"
আইলান হেসে বলল, "আচ্ছা আমি কি তোর ড. মারলেইয়ের মত বিশেষ ব্যক্তি নাকি যে আমাকে সবসময় পা থেকে মাথা পর্যন্ত ফিট থাকতেই হবে !"
"ড.মারলেই তার স্থানে আলাদা | কিন্তু আমার জীবনের সবচেয়ে স্পেশাল মানুষটার জায়গায় সবসময় তুইই থাকবি |"
আলিজা আইলানের আলমারি থেকে গাঢ় চকলেট রঙের শার্ট, নেভি ব্লু রঙা কার্ডিগানটা বের করে দিলো | এরপর একটা পাঞ্জাবি-পাজামা বের করে বিছানায় রেখে বলল, "কাল তো তোকে পড়তে হবে আজ ধুয়ে ইস্ত্রি করে রাখি |"
দুজনে বসে চা খাচ্ছে তখন কলিংবেল বাজল |
আইলান একটু বিরক্তভাবে বলল, "এখন কে এলো ?"
আলিজা বলল, "তুই শার্ট বদল কর | আমি দেখি কে |"
আলিজা লিভিংরুমে গিয়ে দেখল গতকালের আগত আইলানের সেই কলিগ আর তার বোন আবার এসেছে আর আজ হাতে দুটো টিফিন ক্যারিয়ার এনেছে | আলিজা হাসিমুখে তাদের অভ্যর্থনা জানিয়ে বসালো |
আইলান "কে এসেছে বানি ?" বলে লিভিংরুমে এসে দেখল সাগর আর প্রীতি বসে রয়েছে | আলিজা রান্নাঘরে গিয়েছে বুয়াকে চায়ের কথা বলতে |
আইলান হেসে বলল, "এসব কি করেছেন ভাই ? এতসব কেন এনেছেন ? আমি আমার বোন দুজনেই খাওয়াদাওয়া একটু কমই করি | এত খাবার কেন এনেছেন ?"
সাগর গলে গিয়ে বলল, "না মানে আমার আম্মা রান্না কইরে দিলেন সব শুইনে আরকি | বললেন যে এখন তো মনটন খারাপ দেখা যাবে খাচ্ছেন না ঠিকমত তাই আরকি রান্না কইরে পাঠায়ে দিল |"
সাগর বোনকে সূক্ষ্মভাবে চোখের ইশারা করল |
প্রীতি গদগদ হয়ে বলল, "এখন কে না কে রান্না করবে তাই ভাইয়া সব আম্মা করে দিল | আমার আম্মা অনেক পছন্দ করে আপনাকে |"
আইলান ঠোঁটের কোনে হাসির অভ্যাস এনে বলল, "না ! খাওয়াদাওয়া না করে উপায় নেই | আমার বোন না খেয়ে থাকতে দেয়না আমাকে | ও না থাকলে সত্যিই অবস্থা খারাপ হয়ে যেত |"
সাগর কোনরকমে বলল, "হ্যা ঠিক ঠিক |"
"খুশি হলাম খুব আপনার আম্মার উপর | কিন্তু একটু অসময়েই এসে পড়লেন আপনি | আমাকে এখনই বেরুতে হবে | আমার মায়ের মিলাদ কাল | সেজন্য ও বাসায় যেতে হবে | তো সমস্যা নেই বসুন আপনারা |"
সাগর বিনয়ে বিগলিত হয়ে বলল, "তো ভাই চলেন আমিও যাই আপনার সাথে | যদি কোন সাহায্য লাগে তো |"
আইলান অবাক আর একটু বিব্রত হয়ে গেল সাগরের কথায় | আলিজা বুয়ার হাতে পুশিং ট্রলিতে চা আর নাশতা এনে রাখল |
আলিজা দুজনের দিকে স্যান্ডউইচের প্লেট এগিয়ে দিয়ে একটু হেসে বলল, "ভাইয়া আপনি সত্যিই অনেক হেল্পফুল | আসলে কি ভাইয়া শুধু ফ্যামিলি মেম্বারদের থাকতে হবে | এজন্যই একা যাচ্ছে ভাইয়া | নয়ত একজন সাথে গেলে খুবই হেল্প হত ভাইয়ার জন্য |"
সাগরের মুখ শুকিয়ে গেল আলিজার এই চমৎকার বুদ্ধিদীপ্ত উত্তরে | সে অনেক কষ্টে হেসে বলল, "ও | না না ঠিক আছে |''
আলিজা আইলানকে বলল, "ভাইয়া তুই চা-টা উনাদের সাথে বসে খেয়ে যা |"
আলিজা ভাইয়ের জন্য চা ঢেলে ঘরে গেল | আইলান ডাকায় ঘর থেকে বলল, "তুই খা আমি পরে খাবো |"
আইলান সাগরের সাথে কথা বলতে লাগল | আলিজা ঘর থেকে এসে আইলানের পাশে বসে ওয়ালেট, ফোন, রুমাল এগিয়ে দিল | আইলানের হাতটা নিয়ে তাতে ঘড়ি পরিয়ে দিয়ে আঁচলে মুছে চশমাটা পরিয়ে দিয়ে চলে গেল ভেতরে |
আইলান অর্ধেককাপ চা খেয়ে রেখে উঠে পড়ল, সাগরকে বলল, "আপনারা বসুন তাহলে | আমি কিছুক্ষন পরেই ফিরব | কিছু মনে করবেন না |"
সাগর কৃত্তিমহাসি দিয়ে বলল, "না না মনে করার কি আছে ! যান ভাই |"
"স্যরি | আসল দরকার এমন যাওয়াই লাগবে |" বলে আইলান ভেতরে গেল |
প্রীতি ভেতরের ঘরের দিকে গিয়ে দূর থেকে উঁকি দিয়ে দেখল আইলান আলিজার গালে হাত রেখে কিযেন বলছে | প্রীতি চলে এল লিভিং রুমে |
আইলান কার্ডিগানটা গায়ে দিয়ে এসেছে |
সে আবার বিদায় নিয়ে যাবার সময় সাগর বলল, "ভাই আপনার বোনটা দারুন |"
আইলান সুন্দর একটা হাসি দিয়ে বলল, "আলিজা আমার এন্জেল ! বললাম না ও থাকলে আর কিছুই চাইনা আমার |"
আইলান চলে গেলে সাগর আর প্রীতি বেজার হয়ে বসে রইল |