#9

50 4 0
                                    

সুবর্ণলতা
- মেহেরুন নেছা হিতৈষী

পর্ব ৯

প্রীতমের সাথে দেখা হওয়ার পর থেকেই সুবর্ণা অনবরত কান্না করছে। প্রীতম কোনোমতে রাস্তা থেকে সড়িয়ে সুবর্ণাকে নিয়ে হাসপাতালের পাশেই ছোটখাটো একটা ক্যাফেতে ঢুকলো। সুবর্ণাকে একটা চেয়ারে বসতে দিয়ে নিজে ঠিক উলটোদিকের চেয়ারটায় মুখোমুখি বসলো প্রীতম। সুবর্ণা একটু পরপর আলুথালু ভঙ্গিতে চোখ থেকে গড়িয়ে আসা পানিটুকু মুছে ফেলছে। প্রীতমের এই দৃশ্য চেনা। এই মেয়েটার সাথে তার কিছু স্বভাবের বড্ড মিল। একই রকম জিদ, একই রকম রাগ, একই রকম অভিমান। কখনোবা দুজনের অভিযোগগুলোও একইরকম হয়। প্রীতম কিছুক্ষণ সুবর্ণার দিকে তাকিয়ে সুবর্ণাকে ভালো করে দেখে নিলো। এরপর নিজের চেয়ার ছেড়ে উঠতেই সুবর্ণা চমকে তাকালো।
" কোথায় যাচ্ছো তুমি?"
" একটু আসছি। তুমি বোসো। ভয় নেই। পালাবো না আমি।"
সুবর্ণা শেষ কথায় আজ আর হাসতে পারলো না। প্রীতমকে দেখার পর থেকেই সুবর্ণার মনটা বেশিই দুর্বল হয়ে পড়েছে। একেরপর এক সব কথাগুলো মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। সবটা সে প্রীতমকে জানাতে চায়। কিন্তু কিভাবে কি বলবে, কোথা থেকে সবটা বলবে কিছুই বুঝতে পারছিলো না।
একটু পরেই প্রীতম একটা বড় ট্রেতে করে কিছু খাবার নিয়ে ওদের টেবিলে এলো। সুবর্ণার এই ব্যাপারটায় আবারও চোখে পানি চলে এলো।
এই মানুষটা তাকে এত ভালো কিভাবে বোঝে? মানুষটা কাউন্টারে গিয়েছিলো খাবার আনতে। কিভাবে বুঝে গেলো যে ও ভীষণ ক্ষুদার্ত?  এই মানুষটা মাঝেমধ্যে ওর না বলা কথাগুলোও কি দারুণভাবে বুঝে যায়। অথচ কখনো কখনো এই মানুষটাকেই কোনো কথা বুঝিয়ে বললেও সে বুঝতে চায় না।
প্রীতম এবার খাবারের ট্রে টা টেবিলে রেখে সুবর্ণার পাশে গিয়ে বসলো। নিজের হাত দুটো দিয়ে সুবর্ণার চোখের পানিটুকু আলতো হাতে মুছে দিলো।
" আমি যেই একটু দূরে গেছি ওমনি খাওয়াদাওয়া ভুলে গেছো তাইনা? এত শুকিয়ে গেছো কিভাবে? বাতাস এলেই তো উড়ে যাবে"
" যাবো না। তুমি ধরে ফেলবে তো।"
সুবর্ণা কথাটা বলেই হেসে ফেললো। প্রীতমও হেসে ফেললো।
" যাক বাবা। রাণীর মুখে হাসি ফুটেছে। অত দূর থেকে কি এই কান্নাকাটি দেখতে এসেছি নাকি আমি?"
" কিন্তু তুমি হাসপাতালে কিভাবে এলে? কিভাবে জানলে আমি এখানে?"
সুবর্ণার মুখে কৌতূহলের ছাপ।
" আর বলো না। গ্রাম থেকে বেড়িয়েই তোমার ফোনে অনেকবার কল করেছি। কিন্তু তোমার ফোন বন্ধ আসছিলো। প্রচন্ড টেনশন হচ্ছিলো তাই ট্রেন থেকে নেমেই তোমার বাসায় গেছিলাম। রহিমা খালা বললো আংকেলের এক্সিডেন্টের কথা। আর তুমি হাসপাতালে সেটাও বললো।"
প্রীতমের কথা শুনে খেয়াল হলো, বাবার এক্সিডেন্ট এর খবর পেয়ে তাড়াতাড়ি করতে গিয়ে ফোনটা বাসাতেই ফেলে এসেছিলো। আর এরমধ্যে নিশ্চয়ই চার্জ শেষ হয়ে বন্ধ হয়ে গেছে। এরমধ্যে ওর আর বাসায় যাওয়াও হয়নি। আর এত দৌড়াদৌড়ির মাঝে ফোনের ব্যাপারটা একদম মাথা থেকে বেড়িয়ে গেছে।
" আসলে ফোনটা বাসায় ফেলে এসেছিলাম প্রথমদিনই। আর বাড়ি যাওয়া হয়নি তো। বন্ধ হয়ে গেছে হয়ত৷ জানোই তো রহিমা খালা এসব ব্যাপারে অত নজর দেয় না। ফোনের ব্যাপারে তার কোনো আগ্রহ নেই।"
সুবর্ণার কথা শুনে প্রীতম যেন একটু রেগে গেলো।
" তুমি দুদিন ধরে টানা হাসপাতালে?  কি বলছো টা কি? এটা কিভাবে সম্ভব? মেয়ে মানুষ একা কিভাবে থাকছো? আর তোমার খাওয়া ঘুম এসবেরই বা কি হবে? এত কেয়ারলেস কেনো তুমি সুবর্ণা?"
" প্রীতম আমার বাবা হাসপাতালে। আর আমি বাসায় গিয়ে রেস্ট করবো?"
" বাবা হাসপাতালে বলে তুমিও হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার প্ল্যান করবে নাকি? নিজের দিকে নজর দেবে না একটুও? এটা কোনো কথা?"
সুবর্ণা আর কথা বাড়ালো না। ও জানে এখন কথা বলেও কোনো লাভ নেই। কিছু বিষয়ে প্রীতম ভীষণ অন্ধ স্বভাবের। নিজে যা বুঝবে সেটাই ঠিক বাকি সব ভুল। সুবর্ণা চুপ করে গেলো।
প্রীতম হয়ত কিছু বুঝলো। হাত বাড়িয়ে খাবারের ট্রে থেকে একটা স্যান্ডউইচ তুলে নিয়ে সুবর্ণার মুখের সামনে ধরলো।
" আচ্ছা বাদ দাও। আজকে এখন অন্তত কিছু খেয়ে নাও প্লিজ। তোমাকে এভাবে দেখতে আমার একদম ভালো লাগে না। আমি খাইয়ে দিচ্ছি। প্লিজ খেয়ে নাও। এই দেখো আমি নিজেও কিন্তু সারাদিন না খাওয়া। খেয়ে নাও না জান প্লিজ।"
সুবর্ণা একটু চোখ রাঙিয়ে তাকালো প্রীতমের দিকে।
" আমার দিকে এত নজর আর নিজে সারাদিন না খাওয়া? "
" ইশ রে। ধরা পরে গেলাম আচ্ছা ধুর। খাওনা জান প্লিজ। আমিও খাই তুমিও খাও প্লিজ প্লিজ।"
সুবর্ণা প্রীতমের হাত থেকে স্যান্ডউইচটায় কামড় দিয়ে খেতে শুরু করলো। আর প্রীতম অন্য হাতস নিজের জন্য একটা জুতের ক্যান নিয়ে খেতে শুরু করলো।
" প্রীতম আমার তোমাকে কিছু কথা বলার আছে।"
" আগে খাওয়া শেষ করো। খাওয়ার সময় কোনো কথা শুনছি না। যা বলার সব পরে। আজ সারারাত তোমার সাথে থাকবো হাসপাতালে। আংকেলের দেখাশোনা কি শুধু তুমি একাই করবে নাক? আমি জামাই মানুষ। আমারও তো কিছু দ্বায়িত্ব আছে নাকি।"
প্রীতম কলার ঝাকিয়ে নিজের কথাগুলো বললো। কিন্তু সুবর্ণার মনটা ভীষণ খচখচ করছে।
"তুমি আজ রাতে আমার সাথে হাসপাতালে থাকবে? সত্যিই? তোমার তো পরশু থেকে ভার্সিটি খোলা। "
" হ্যাঁ তো?  কাল বিকেলে কিংবা নাইটে চলে যাবো। গিয়ে ফার্স্ট ক্লাসটা এটেন্ড করবো। তাই বলে বউকে একা ফেলে চলে যাবো নাকি? তাছাড়া তোমারও তো কাল থেকে ক্লাস। "
" হ্যাঁ। আমার তো ক্লাস। আমি তো এখান থেকেই চলে যাবো। কিন্তু প্লিজ আমার কথাগুলো একটু শোনো একবার।"
" উফ!  তুমি বড্ড বেশিই কথা বলো৷ চুপচাপ খাওয়া শেষ করবে আগে৷ তারপর যা বলার আমি সব শুনবো। প্রমিস "
" তুমি শুনবে তো? সত্যিই? কিন্তু পরে যদি সময় না পাই বলার?"
এবার প্রীতম কিছুটা বিরক্ত সুরেই বলে ফেললো,
" পরে না সময় পেলে আরো পরে বলো। সময় কেনো পাবো না বলো তো। ধুর। কিসব যে ভাবো তুমি আল্লাহই ভালো জানেন। এখন চুপচাপ খাও তো।"
সুবর্ণা আর কথা বাড়ালো না। চুপচাপ খেতে লাগলো। কিন্তু ওর মনের ভেতরটা ভীষণ তোলপাড় হচ্ছে।
হাসপাতালে গিয়ে ওর সাথে দেখা না করতে দেওয়া, এমন ভাবে সুইসাইড করতে যাওয়া, হুট করে গ্রামে চলে যাওয়া।  এই বিষয়গুলো একদমই স্পষ্ট না সুবর্ণার কাছে। বিষয়গুলো স্পষ্ট করে নেওয়া খুব দরকার। কিন্তু প্রীতম তো কোনো কথাই শুনছে না। সুবর্ণার শুধু মনে হচ্ছে আজ না বলা হলে কথাগুলো হয়ত আজীবন না বলাই থেকে যাবে। কিন্তু কি করবে সে?

খাওয়া শেষ করে প্রীতম বিলটা পে করে দিলো। সুবর্ণা বারবার দিতে চাইলো কিন্তু প্রীতম কিছুতেই রাজি হলো না। দুজনে একসাথে বেড়িয়ে হাটতে শুরু করতেই সুবর্ণা প্রীতমের হাতটা শক্ত করে ধরে হাটা শুরু করলো। সুবর্ণার এই কাজ দেখে প্রীতম হেসে ফেললো।
একটা সময় এই হাত ধরা নিয়ে মেয়েটা কি লজ্জাই না পেতো। অথচ আজ যেনো প্রতিনিয়ত এই হাতিটাই খুঁজে বেড়ায় মেয়েটা।
ক্যাফে থেকে বেড়িয়ে কিছুদূর হাটলেই হাসপাতাল। দোতলায় কেবিনে শিফট করা হয়েছে সুবর্ণার বাবাকে। হাসপাতালের গেট দিয়ে ঢুকতেই প্রীতমের ফোনটা বেজে উঠলো। প্রীতম সুবর্ণার হাতটা ছাড়িয়ে পকেট থেকে ফোনটা বের করে রিসিভ করলো।
ওপাশ থেকে কিছুক্ষণ কথা হলো কিন্তু সেসব সুবর্ণা শুনতে পেলো না। তবে আন্দাজ করতে পারলো খারাপ কিছুই ঘটেছে। কারণ নিমিষেই প্রীতমের হাসিখুশি মুখটা কেমন যেনো থমথমে হয়ে গেলো।
কলটা কেটেই প্রীতম সুবর্ণার দিকে তাকালো,
" আমাকে এক্ষুনি গ্রামে যেতে হবে সুবর্ণা। মায়ের একটা এক্সিডেন্ট হয়েছে। মাথা ফেটে নাকি রক্ত পড়ছে। খুব বাজে অবস্থা। আমাকে এক্ষুনি ফিরতে হবে। "
সুবর্ণা সংবাদটা পেয়ে একটু ঘাবড়ে গেলো। কোনোমতে নিজেকে সামলে প্রীতমকে আশ্বাস দিলো যে সে একা এখানে থাকতে পারবে। সে যেনো মায়ের কাছে যায়। কারণ মায়ের এখন তাকে দরকার।
প্রীতম একটা রিকশা ডেকে দ্রুত চলে গেলো।

প্রীতমদের গ্রামের বাড়িটা ঠিক রাজশাহীতে বললে ভুল হবে৷ রাজশাহীর মেইন শহর পেরিয়ে একদম শেষ দিকের একটা গ্রামে প্রিতমদের গ্রামের বাড়ি। ব্যাবসার কাজে আর সন্তানদের লেখাপড়ার কাজে গ্রাম ছেড়ে দূরে একটা মফস্বল শহরে গিয়ে ওঠে৷ আর সেখান থেকেই প্রীতম এবং সুবর্ণার পরিচয়। এরপর সুবর্ণা চলে আসে ঢাকায় আর প্রীতম রাজশাহী শহরে।

প্রীতমকে বিদায় করে দিয়ে হাসপাতালের সিড়ি বেয়ে উপরে উঠতেই সুবর্ণা আপন মনে খানিকটা হেসে উঠলো।
" বলেছিলে থেকে যাবে৷ কথাও দিয়েছিলে। কথা দেওয়া অনেক সহজ প্রীতম। দূর থেকে টেক কেয়ার করার ভাব ধরাটাও ভীষণ সহজ। কিন্তু সেই পরিস্থিতিতে নিজে দাঁড়িয়ে সবটাকে সামলে উঠে আবারো চলাফেরা করতে পারাটা ভীষণ কঠিন প্রীতম। ভীষণ কঠিন। আমাকে কথা দিয়েও মায়ের জন্যে তুমি চলে গেলে, এটা ভীষণ স্বাভাবিক। তাহলে আমার বাবার জন্যে আমি হাসপাতালে খাওয়া ঘুম ভুলে থাকছি, সেটা তোমার কাছে কেনো অস্বাভাবিক প্রীতম? কেনো?
আফসোস৷ শুধু কথাগুলো আজও তোমায় বলা হলো না৷ কি জানি সত্যিই কখনো আর বলা হবে কি না।"
আপন মনে ভাবতে ভাবতে বাবার কেবিনের সামনে দাঁড়িয়ে এক দীর্ঘ নিশ্বাস ছাড়লো সুবর্ণা।

( চলবে...)

সুবর্ণলতা [Completed✔️]Where stories live. Discover now