সুবর্ণলতা
- মেহেরুন নেছা হিতৈষীপর্ব ৩৫
★
ইন্সপেক্টর কৌশিক আহমেদ বসার ঘরে বসে আছেন। বাড়িতে ঢুকতেই একজন কাজের লোক এসে তাকে চা নাস্তা দিয়ে গেছে। কৌশিক আহমেদ বুঝলেন, উপরমহল থেকে বোধহয় আগেই নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে যে তিনি আসবেন।
চায়ের কাপটা হাতে নিয়ে বসার ঘরটা ঘুরেফিরে দেখছিলেন কৌশিক আহমেদ। ঢাকা শহরে আজকাল থাকার জন্য এত বড় বাড়ি দেখাই যায় না। যিনি এই বাড়িটা করেছিলেন তিনি যে ভীষণ টাকাওয়ালা মানুষ ছিলেন এবং ভীষণ শৌখিন ছিলেন তা বাড়িতে পা দেওয়া মাত্রই বোঝা যায়।
এই বাড়িতে এই নিয়ে তৃতীয়বার এলেন তিনি। প্রথমবার এসেছিলেন নিজের পুরোনো বান্ধবী কাশফিয়া রহমানের সাথে দেখা করতে এবং তার স্বামীর মৃত্যুর ব্যাপারে জানতে। দ্বিতীয়বার এসেছিলেন তার পুরোনো দিনের বান্ধবী কাশফিয়া রহমানকে চিরতরে বিদায় জানাতে।
কাশফিয়া রহমান মারা যাবার পর আর এই বাড়িতে আসেননি তিনি। যেন এক প্রকাশ কৌশলে এড়িয়ে গেছেন। আজ অনেকদিন পর এই বাড়িতে তার ডাক পরেছে। আর এই ডাক উপেক্ষা করা যাবে না।
পলাতক বাশার হকের বড় মেয়ে নাকি তার সাথে একটু কথা বলতে চায় এমনটাই জানিয়েছে সুবর্ণা। এই কেসটা তার জন্য ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। তাই ঢাকায় ফিরেই এই বাড়িতে চলে এসেছেন, একটুও সময় নষ্ট করেননি কৌশিক আহমেদ।
আসার আগে সুবর্ণার সাথে তার কথা হয়েছে। সুবর্ণা গেছে মেয়েটাকে আনতে। আর সৌরভ আপাতত অফিসে। যেকোনো মুহূর্তে সেও চলে আসবে।
কৌশিক আহমেদ চা খেতে খেতে একটু হাটাহাটি করছিলেন তখনই সুবর্ণা বাড়িতে ঢুকলো। সাথে থাকা মেয়েটিকে দেখে তিনি আন্দাজ করলেন মেয়েটিই হয়ত বাশার হকের বড় মেয়ে রেহানা। কৌশিক আহমেদ শান্ত হয়ে বসলেন।
সুবর্ণা রেহানাকে নিয়ে এসে ইন্সপেক্টর কৌশিক আহমেদ এর সামনে মুখ করে বসলো।
রেহানা বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলো। সুবর্ণা কিছু একটা বলতে যাবে ওমনি কৌশিক আহমেদ ইশারায় তাকে থামিয়ে দিলো। রেহানা আরো কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে রইলো। এরপর আস্তে করে নিজের মাথাটা তুলে কথা বলতে শুরু করলো,
" আ-আপনিই সেই পুলিশ অফিসার? যে আমার বাবাকে খুঁজছেন?"
" হ্যাঁ। ইন্সপেক্টক কৌশিক আহমেদ। "
" আ-আপনি আমার বাবাকে খুঁজে পাননি তাই না?"
" না। গত ছয়মাস ধরে আমার টিম তোমার বাবাকে খুঁজছে। কিন্তু পাচ্ছে না। "
" উহু! আপনারা মোটেও ঠিকভাবে খোঁজেননি। খুঁজলে ঠিক পেতেন। আসলে আমার ভাই আবার সুবর্ণার সাথে সব ঠিকঠাক করে নিয়েছে তো, তাই সুবর্ণা সব ভুলে গেছে। আর ওর সাথে সাথে আপনারাও সব ভুলে গেছেন। আপনারা ঠিকভাবে খোঁজেনই নি।"
সুবর্ণার চোখমুখ ভীষণ শক্ত হলো এবার। গলার স্বর যতটা সম্ভব দৃঢ় করলো সে,
" তুমি জানো তোমার বাবা কোথায় আছে?"
রেহানা বাচ্চাদের মতন করে মাথা দুলালো।
" জানি তো। শুধু আমি না, প্রীতমও জানে। আমি জানি বলেই তো গত ছয়টা মাস ধরে তোমাকে খুঁজে বেড়াচ্ছি। কিন্তু খুঁজতে খুঁজতে দেরিই হয়ে গেলো।"
" প্রীতম জানে মানে? কী বলছো তুমি আপু?"
সুবর্ণা যেন নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না।
রেহানা মুচকি মুচকি হাসছিলো।
" আমি জানি ওই লোকটা কোথায় আছে। ওই লোকটা একটা খুনি। না না শুধু তোমার বাবাকে খুন করেনি। ওই লোকটা আমার...."
বলতে বলতে রেহানা নিজের পেটে হাত দিয়ে ঝরঝর করে কাঁদতে লাগলো।
" ছোট্ট একটা সংসার পেতেছিলাম আমি আর মিনার। মিনারের বাবা মা কেউ নেই। অনাথ একটা ছেলেকে ভালোবাসার ফল স্বরুপ শাস্তি হলো বন্দী জীবন। আমার মা আমাকে বন্দি দশায় দেখে সারাদিন রাত কান্নাকাটি করতো। একদিন অনেক সাহস করে মা আমাকে বন্দি দশা থেকে মুক্তি দিলো। হায়, মা যদি জানতো মেয়েকে মুক্ত করতে গিয়ে নিজে চিরকালের মত বন্দী হয়ে যাবে।"
রেহানা ডুকরে ডুকরে কাঁদছে।
কৌশিক আহমেদ বিচক্ষণ দৃষ্টিতে রেহানার মুখের দিকে তাকিয়ে আছেন।
রেহানা একাই বলে যাচ্ছে,
" আমি তখন পালিয়ে এসে মিনারকে বিয়ে করি। দুবছরের মাথায় আমি জানতে পারি আমাদের দুজনের সংসার এবার তিনজন হবে। কি যে খুশি ছিলাম আমরা। কিন্তু ওই বাশার হকের সেই সুখ সহ্য হলো না।"
শেষ কথাটায় যেন রেহানার গলা দিয়ে আগুন বেড়োলো।
" ওই লোকটা মানুষ নয়। ওই লোকটা পিচাশ। মিনারকে পুরো পৃথিবী থেকেই সড়িয়ে দিলো। আর আমার বাচ্চাটাকেও। আর আমাকে ধরে বেঁধে এনে ওই ছোটলোক চামচা কিরণের গলায় ঝুলিয়ে দিলো আমার বাবা নামক পিশাচ লোকটি।
আর আমার মা....
বাবা আমাকে কি বলে জানো? বলে যে, তোর মাকে জানে মারতে চাইনি রে। ধ্বাক্কা সামলাতে না পারলে আমার কি দোষ।
সব শেষ হয়ে গেলো আমাদের। ওই একটা লোকের জন্য। দাদী শুধু আমার মুখের দিকে চেয়ে বেঁচে ছিলো। সেই মানুষটাও এত যন্ত্রণা না সহ্য করতে পেরে পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করলো। করে দিয়ে গেলো আমাকে একা। একদম একা।"
কৌশিক আহমেদ লক্ষ্য করলেন রেহানার সাথে সাথে সুবর্ণাও কাঁদছে। তিনি দুহাত দিয়ে দুই মেয়ের মাথায় আস্তে করে হাত বুলালেন।
রেহানা কিছুক্ষণ সময় নিলো যেন বাকিটুকু গুছিয়ে নিতে। এরপর আবার বলতে লাগলো,
" অথচ এই সবকিছুই আমার ভাইয়ের জানা। আমি ভাইকে অনেক বলেছি আমাদের মায়ের মৃত্যু স্বাভাবিক নয়। ভাই শোনেনি আমার কথা। শোনেনি বললে ভুল হবে। শুনতে চায়নি। আমার এমন বাজে একটা ছেলের সাথে বিয়ের খবর শুনেও আমার ভাইয়ের এতটুকু কষ্ট হয়নি। কারণ ও জানে, কষ্ট পেলে দিন শেষে ওরই ক্ষতি। সম্পত্তির ভাগ তো কম হয়ে যাবে কি না। এতকিছুর পরেও আমার ভাই বাবার পাচাটা কুকুর হয়ে রয়েছে। কারণ ও ভালো করেই জানে বাবার বিরুদ্ধে গেলে ওর বিদেশে থাকা খাওয়া, লেখাপড়া সব গুডবাই হয়ে যাবে।
আমার বাবা এক পিশাচ আর ওই কিরণ! রোজ রাতে মদ খেয়ে মাতলামি আর... "
রেহানা আর বলতে পারলো না। রেহানা কাঁদতে কাঁদতে সুবর্ণার দিকে তাকিয়ে দেখলো সুবর্ণাও কাঁদছে৷
সুবর্ণার কান্না দেখে রেহানা নিজের চোখের পানিটুকু মুছে সুবর্ণার চোখের পানি মুছিয়ে দিলো।
" কেঁদো না। তুমি কেনো কাঁদছো? "
" আমি এসবের কিছুই জানতাম না আপু। আমি কল্পনাও করতে পারছি না প্রীতম এতটা স্বার্থপর। আমার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে আপু। আমি... "
সুবর্ণা রেহানাকে ধরে কান্না জুড়ে দিলো। সে যেন মেনেই নিতে পারছে না প্রীতম এমন কিছু করতে পারে। এইতো আজ বিকেলেই তো প্রীতমের সাথে তার দেখা করার কথা ছিলো। আজ তাদের বিয়ের ব্যাপারে কথা বলবে মনে মনে ভেবেও নিয়েছিলো সুবর্ণা। কিন্তু এখন এসব কি শুনলো সে? এমন একটা মানুষকে নিয়ে সারাজীবন কিভাবে চলবে? এতটা স্বার্থপর মানুষকে সে কিভাবে মেনে নেবে?
রেহানা সুবর্ণাকে ছেড়ে দিয়ে উঠে দাঁড়ালো।
" ইন্সপেক্টর সাহেব! আমরা মূল বিষয় থেকে সড়ে যাচ্ছি। আমি জানি আমার বাবা কোথায় লুকিয়ে আছে। চলুন আমার সাথে। আমি আপনাকে নিয়ে যাচ্ছি সেখানে।"
রেহানার কথা শুনে দ্রুত উঠে দাঁড়ালেন ইন্সপেক্টর কৌশিক আহমেদ। তিনি এক মুহূর্তও যেন আর অপেক্ষা করতে চাচ্ছেন না। দ্রুত রেহানাকে নিয়ে বেড়িয়ে পরলেন।সুবর্ণা নিজের জায়গায় বসেই রয়েছে। উঠে দাঁড়ানোর ক্ষমতাটুকুও যেন তার নেই। মাথাটা ভীষণ দপদপ করছে তার। হালকা ভাবে কিছুর আওয়াজ তার কানে আসছে। এদিক ওদিক তাকিয়ে আবিষ্কার করলো তার ফোন বাজছে। ফোনের স্ক্রীনে প্রীতমের নাম ভাসছে। কিন্তু এই মুহূর্তে কলটা একদমই রিসিভ করতে ইচ্ছে করছে না তার। পুরো শরীর জুড়ে কেমন অদ্ভুত যন্ত্রণা হচ্ছিলো সুবর্ণার। যেন কেউ জেনেশুনে তাকে বিষ দিয়েছে এবং বিষটা পুরো শরীরে ছড়িয়ে যাচ্ছে। সুবর্ণা এই যন্ত্রণা আর সহ্য করতে পারলো না। সোফা থেকে কোনোমতে গড়িয়ে নেমে মেঝেতে লুটিয়ে পরলো। মাথাটা যেন ছিড়ে যাচ্ছে, সাথে সাথে পুরো শরীর যেন জ্বলে যাচ্ছে।
সুবর্ণা চোখ খুলে আশেপাশে কাউকে ডাকার চেষ্টা করলো কিন্তু তার চারিদিক ক্রমশ অন্ধকার হয়ে আসছিলো আর গলা দিয়েও কোনো আওয়াজ বের হচ্ছিলো না। সুবর্ণার মনে হচ্ছিলো যে যে ক্রমশই মৃত্যুর কোলে ঢোলে পরছে।( চলবে...)