সুবর্ণলতা
- মেহেরুন নেছা হিতৈষীপর্ব ৩৬
★
চারিদিকে ভীষণ অন্ধকার। এতটাই অন্ধকার যে আশেপাশের কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। এমন অন্ধকারের মাঝেই হঠাৎ এলো এক চিলতে আলো। কিন্তু আলোটা যেন সেই অন্ধকারকে আরো গাঢ় করে দিচ্ছিলো।
চারিদিকে ভীষণ শব্দ হচ্ছে। কিসের শব্দ ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। একবার মনে হচ্ছে বৃষ্টি পরার শব্দ, তো আবার মনে হচ্ছে জোরে বাজ পরার শব্দ। আবার হুট করেই সব নিশ্চুপ।
অন্ধকারটা যেন ক্রমশ পরিবেশটাকে গুমোট করে দিচ্ছিলো। ধীরে ধীরে সব শব্দ কোথায় যেন মিলিয়ে গেলো। অন্ধকার যেন একটু কমছে, আলো দেখা যাচ্ছে। হ্যাঁ আলো....সুবর্ণা চোখ খুললো। চোখ খুলে তাকাতেই আলোর ঝটকা চোখে লাগলো আর ওমনি সুবর্ণা চোখদুটো আবার বন্ধ করে ফেললো।
চোখ বন্ধ অবস্থায় শুনতে পেলো কেউ বলছে, " আস্তে আস্তে। কিচ্ছু হয়নি মা। রিল্যাক্স। আস্তে আস্তে চোখ খোলো।"
সুবর্ণা গলার স্বরটা চিনতে পারলো না। আস্তে করে আবারও চোখ খুললো। হ্যাঁ এবারে সব পরিষ্কার হচ্ছে।
চোখ খুলে আশেপাশে তাকিয়ে দেখলো পরিবেশটা। তার কাছেই সৌরভ দাঁড়িয়ে আছে। অন্যদিকে একজন এপ্রোণ পরা বয়স্ক মানুষ। লোকটি সম্ভবত ডাক্তার। তার সাথেই দাঁড়িয়ে রয়েছেন নার্সের ড্রেসে একজন ভদ্রমহিলা।
সুবর্ণা উঠে বসার চেষ্টা করতেই পরে যাচ্ছিলো ওমনি সৌরভ তাকে ধরে আস্তেধীরে বসিয়ে দিলো।
সুবর্ণা আশেপাশে তাকিয়ে বুঝলো ঝড় বৃষ্টি আলো আঁধার সবটাই তার মস্তিষ্কে হচ্ছিলো।
সুবর্ণা লক্ষ্য করলো সৌরভের চোখমুখ বেশ অস্বাভাবিক। এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখলো সে এখন তার ঘরেই আছে। অবশ্য এখন এটাকে ঘর কম, হাসপাতালের কেবিন বেশি মনে হচ্ছে। সে দেখলো কিছুক্ষণ পর ডাক্তার নার্সকে নিয়ে রুমের বাইরে চলে গেলো এবং যাওয়ার আগে সৌরভের দিকে তাকিয়ে ইশারায় কিছু বললো।
ব্যাপারটা সুবর্ণার চোখ এড়ালো না। সুবর্ণা সৌরভের দিকে চোখ মেলে তাকাতেই সৌরভ সুবর্ণার কাছে এসে বসলো।
" এখন কেমন আছো তুমি? ভীষণ ভয় পেয়ে গেছিলাম"
" তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে না। " সুবর্ণা কথাটা যেন ইচ্ছে করেই বললো সৌরভের অস্বাভাবিক চাহনির কারণ বোঝার জন্যে। সে ভালোমতোই জানে সরাসরি জিজ্ঞাসা করলে সৌরভ এর উত্তর কখনোই দেবে না।
সৌরভ সুবর্ণার কথায় হেসে দিলো।
" না মনে হওয়াটাই স্বাভাবিক। কারণ যখন তুমি পরে গেছিলে তখন প্রচন্ড ঘাবড়ে গেছিলাম। এরপর ডাক্তার জানালো গুরুতর কিছু হয়নি। আর তাছাড়া এই দুদিনে এমন কিছু মন ভালো করে দেওয়া ঘটনা ঘটেছে, ভালো না থেকে উপায় নেই।"
" দু-দিন?"
সুবর্ণা চমকে উঠলো।
" মানে আমি গত দুইদিন ধরে এখানে জ্ঞান হারিয়ে আছি?"
" উমমম... ঠিক সেন্সলেস বলা যাবে না। সেন্স ছিলো বাট ডাক্তার বললেন তুমি একটু ঘোরের মাঝে আছো। আর তাছাড়া তোমার রেস্টের ভীষণ প্রয়োজন ছিলো। ডাক্তার তোমাকে ঘুমের ইঞ্জেকশন দিয়েছিলেন। এছাড়া তোমার স্যালাইন চলছিলো। "
" আমার কি হয়েছিলো?"
" তেমন কিছু না। আসলে.... "
" আসলে? না ওয়েইট ওয়েইট।
আমার যতদূর মনে পরে..."
" আচ্ছা বাদ দাও এখন এসব। মাত্র তোমার জ্ঞান ফিরেছে। আগে কিছু খেয়ে নাও। তারপর না হয় এসব কথা হবে।"
সুবর্ণা আরো কিছু বলতে চাইছিলো কিন্তু সৌরভ তার সুযোগ না দিয়ে রুম থেকে বেড়িয়ে গেলো। কিছুক্ষণ পরেই একটা ট্রে হাতে নিয়ে ঢুকলো।
ট্রেতে দুই পিছ স্যান্ডউইচ আর এক গ্লাস জুস।
সৌরভ কাছে আসতেই সুবর্ণা লক্ষ্মী মেয়েদের মত চুপচাপ পুরোটা খেয়ে নিলো। এরপর সৌরভ একটা ঔষধ বাড়িয়ে দিতেই সেটাও খেয়ে নিলো।
সৌরভ রুম থেকে বেরিয়ে যাবে তখনই সুবর্ণা তাকে ডাকলো,
" সৌরভ! বাশার হক কি সত্যিই ধরা পরেছে?''
সৌরভ একটু থেমে পেছনে ঘুরে সুবর্ণার কাছে এসে বসলো। সুবর্ণা লক্ষ্য করলো সৌরভের চোখমুখ শক্ত।
" তোমাকে কিছু জানানোর আছে। "
" হ্যাঁ বলো..."
সুবর্ণার ভীষণ ভয় হতে লাগলো।
সৌরভ একটু এদিক ওদিক তাকিয়ে কিছু একটা দেখলো। তারপর সুবর্ণার দিকে মুখ ঘুরিয়ে বলতে শুরু করলো,
" এই দুদিনে কিছু ঘটনা ঘটেছে। এরমধ্যে কোনোটায় তুমি ভীষণ আনন্দ পাবে, কোনোটায় তুমি ভীষণ কষ্ট পাবে। আজ হোক বা কাল সত্যিগুলো তুমি জানবেই। কিন্তু আমার মনে হয় কথাগুলো তোমার আজই জানা দরকার। এতে হয়ত...."
সৌরভ একটু থামলো। যেন নিজেকে প্রস্তুত করে নিচ্ছে।
" মিস রেহানা ঠিকই বলেছিলেন। তিনি জানতেন বাশার হক কোথায়। এবং তার সাহায্যেই কৌশিক আংকেল বাশার হক এবং তার দলের সদস্যদের ধরতে সক্ষম হয়েছেন।
শুধু তাই নয়, উনি উনার সব দোষ স্বীকারও করেছেন। আগামীকাল কোর্টে বাশার হকের রায় ঘোষণা করা হবে।
আর..."
" আর?"
" তুমি সেন্সলেস হয়ে যাওয়ার পর আমি ডাক্তারকে নিয়ে আসি। উনি তোমাকে দেখে অন্য দুজন ডাক্তারকে নিয়ে আসেন। তারা তোমার কিছু টেস্ট করান, যেগুলো থেকে বোঝা যায় যে তুমি.... "
" আমি?"
" আসলে তোমার যখন এক্সিডেন্টটা হয় তখন তোমার শরীরের ভেতরে অনেক ইন্টার্ণাল ড্যামেজ হয়ে যায়। "
" হ্যাঁ তো?"
" তুমি কখনো মা হতে পারবে না সুবর্ণা। "
সৌরভ কথাটা শেষ করেই মাথা নিচু করে ফেললো। সুবর্ণা যেন অবাক হতেও ভুলে গেছে। তার জীবনে এতবড় একটা ঝড় আসবে সে স্বপ্নেও ভাবেনি।
সুবর্ণা লক্ষ্য করলো সৌরভ কাঁদছে।
সুবর্ণা এখন সৌরভের সেই অস্বাভাবিক চাহনির কারণ খুঁজে পেলো।
সৌরভ মাথা নিচু করেই রয়েছে। সুবর্ণা কি বলবে ঠিক বুঝতেই পারছে না। কোনোমতে ধরা গলায় সৌরভকে ডাকলো,
" সৌরভ! তাকাও আমার দিকে।
প্রীতম জানে? আ-আজ কয় তারিখ? ওর তো চলে যাওয়ার কথা ছিলো। কিছু বলছো না কেনো সৌরভ? "
সৌরভ কিছু বলার আগেই পেছন থেকে কারো গলার আওয়াজ পাওয়া গেলো।
সুবর্ণা এবং সৌরভ দুজনেই তাকিয়ে দেখলো রেহানা ঘরে ঢুকছে।
" ও চলে গেছে সুবর্ণা। আমার ভাই চলে গেছে। ও খুব ভালো মতই জানে ও একটা মেরুদণ্ডহীন কাপুরষ। ও জেনে গেছে যে আমি এখানে আছি। শুধু তাই নয়, বাবা ধরা পরে যাবার পর তো ওর এখানে থাকার আর কোনো মানেই নেই। তবুও শেষ চেষ্টা করতে এসেছিলো এখানে। তোমাকে দেখতে। চেয়েছিলো তোমার অসুস্থতার সুযোগ নিয়ে ইনিয়েবিনিয়ে বাবার উপর যে কেস তুমি দিয়েছো তা যেন সড়িয়ে দিতে পারে।
কিন্তু এখানে এসে যখন ও জানতে পারলো, তুমি কখনো মা হতে পারবে না। ও এক মুহূর্ত আর দাঁড়ায়নি। তুমি একটা ভুল মানুষকে ভালোবেসেছো সুবর্ণা।"
সুবর্ণা যেন রেহানার কোনো কথা কানেই তোলেনি। কথাগুলো যেন তার কান পর্যন্ত পৌঁছায়ই নি।
" এসব কি বলছো আপু? প্রীতম কেন এমনটা করতে যাবে? তোমরা কিচ্ছু জানো না। ওর তো এমনিতেও চলে যাওয়ার ডেট ছিলো। তাই চলে গেছে। ধুর।"
সৌরভ এবার কিছুটা বিরক্ত হলো,
" রিম্পি বারবার তোমার সাথে কথা বলতে চাইছিলো। সময় পেলে কথা বলে নিও। আমি এখন আসছি। কিছু লাগলে ডেকো।"
সৌরভের পিছুপিছু রেহানাও চলে গেলো।সবাই সবার মতন সবটা ভেবে নিয়েছে। কিন্তু সুবর্ণা কিছুতেই যেন এসব মেনে নিতে পারছে না। সে তো শেষ বারের মতন প্রীতমকে সুযোগ দিয়েছিলো। সেই সুযোগ নিয়ে একটা মানুষ এতটা নীচে নামতে পারে না। সুবর্ণা নিজের ফোনটা হাতে নিয়ে ডাটা অন করে রিম্পিকে কল করলো।
কলটা কিছুক্ষণ রিং হয়ে কেটে গেলো। সুবর্ণা খেয়াল করলো রিম্পি অনলাইনে নেই। তাই দ্রুত একটা ভয়েস মেসেজ পাঠিয়ে দিলো রিম্পিকে।
সুবর্ণা এত সহজে তার প্রীতমকে অবিশ্বাস করতে পারবে না। আর যাই হোক, সত্যিটা না জেনে তো কখনোই না।
সুবর্ণা বিড়বিড় করতে করতে দীর্ঘশ্বাস ফেললো।( চলবে...)