সুবর্ণলতা
- মেহেরুন নেছা হিতৈষীপর্ব ১৯
★
সুবর্ণা কান্নাকাটি থামিয়ে নিজেকে কিছুটা সামলে নিতেই প্রীতম একটু নড়েচড়ে বসলো।
" কি হয়েছে তোমার? এত কান্নাকাটির মত কি হয়েছে? আমাকে বলো প্লিজ। "
" তুমি সেদিন আমাকে ছেড়ে কোথায় চলে গিয়েছিলে?"
" আর বলো না। বাবা আমাকে একটা এড্রেস দিয়ে বললো ওখানে যেতে, মাত্র এক ঘন্টার ভেতরেই কাজ হয়ে যাবে। গিয়ে দেখি একটা আর্ট ক্যাম্পেইন হবে। বাবা আমাকে পাঠাবে। বাবাও সেখানে উপস্থিত। কি আর করবো বলো গেলাম। এদিকে ওদের রুলসে কোনো ফোন ল্যাপটপ এলাউ না। কিন্তু বাবা তো বলেছিলো তোমাকে বলে দেবে। বলেনি বাবা?"
সুবর্ণা আস্তে করে মাথা নাড়ালো এবং বুঝতে পারলো লোকটা ঠিকই বলেছিলো সেদিন। বাবার খুন থেকে শুরু করে এই কয়েকদিনে যা যা ঘটেছে সেসবের কিছুই প্রীতম জানে না। কিন্তু সে এখন কি করবে? সবটা প্রীতমকে জানাবে?
সুবর্ণা এক পলক পুরো রেস্টুরেন্টটা দেখে নিলো। এরপর প্রীতমের দিকে তাকিয়ে কিছু একটা বলতে যাবে ওমনি সুবর্ণার ফোন বাজতে শুরু করলো। সুবর্ণা চমকে উঠে ফোনটা রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে ভেসে এলো,
" আম্মাজান কেমন আছো? আমি তোমার আংকেল। শুনলাম আমার আব্বাজান নাকি সোজা তোমার ওইখানে গেছে? আমার আব্বাজানকে বলো রেস্টুরেন্টের বাইরে গাড়ি দাঁড়ায়ে আছে। কথাবার্তা শেষ হইলে আমার আব্বাজানকে বলবা তার মা তার জন্য অপেক্ষায় আছে। ঠিক আছে আম্মাজান? "
সুবর্ণা কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে ফোনটা রেখে দিলো। চোখ বন্ধ করে বড় বড় কয়েকটা নিঃশ্বাস নিলো। তখনই তার মনে পড়লো বাসায় মাকে একা ফেলে এসেছে।
" প্রীতম আমাকে যেতে হবে। বাড়িতে মা একা আছে। আর তোমার বাবা কল করেছিলেন। বাইরে তাএ গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। তোমার মা তোমার জন্য অপেক্ষা করছে।"
" কিন্তু সুবর্ণা তোমার সাথে আমার কথা আছে তো। আচ্ছা তুমি কি বলবে বলছিলে?"
সুবর্ণা ভীষণ উসখুস করতে লাগলো।
" তুমি আগে বলো। "
প্রীতম ভীষণ উল্লাসীত কণ্ঠে ব্যাগ থেকে কিছু কাগজ বের করতে করতে বলতে শুরু করলো,
" আমি হাফ স্কলারশিপ নিয়ে ইউএসএ তে যাচ্ছি। "
" কিহ?"
সুবর্ণা অনেক বেশিই অবাক হয়ে গেছে কথাটা শুনে।
" হ্যাঁ। বাবাই সব ব্যাবস্থা করে দিলো। অনেকদিন ধরেই চিন্তাভাবনা চলছিলো। এইতো আমার পাসপোর্ট আর ভিসা। আর দশদিন পরেই ফ্লাইট।"
" এতবড় একটা কথা অথচ আমাকে একটাবারও জানাবার প্রয়োজন মনে করলে না তুমি?"
সুবর্ণার চোখদুটো ছলছল করে উঠলো।
" আরে বাবা আমি তো তোমাকে সারপ্রাইজ দিতে চেয়েছিলাম। তাই তো আগে থেকে কিছু বলিনি। সবকিছু রেডি করে আজকে বলছি। তুমি খুশি হওনি বলো?"
" এটাই তাহলে তোমার সারপ্রাইজ? "
সুবর্ণা হাত দিয়ে নিজের চোখের পানিটুকু মুছে ফেলতেই প্রীতম একটু উতলা হয়ে উঠলো,
" আরে বাবা কাঁদছো কেনো? আমি কি চিরদিনের জন্য যাচ্ছি নাকি। আমি তো আসবোই। আর তুমি চাইলে যাওয়ার আগে আমাদের বিয়েটাও হতে পারে। সব তো ঠিকই ছিলো, শুধু তুমিই তো বিয়েটা করলে না। এখন বলো তো....."
" কি বলছো কি তুমি?" সুবর্ণা এবার চেচিয়ে উঠলো।
" কেনো বিয়ে হলে কি তুমি আমাকে নিয়ে যেতে?"
প্রীতম আমতা আমতা করতে থাকলো,
" না মানে... আমি একটু ভরসা পেতাম। এইযে আমি তোমাকে নিয়ে সবসময় ভয়ে থাকি এই ভয়টা আর..."
" বাহ বাহ! তুমি আমাকে নিয়ে ভয়ে থাকো বলে বিয়ে করে আমাকে বউ নামক ট্যাগ লাগিয়ে তুমি বিদেশে যাবে। আর বিদেশে গিয়ে যদি তুমি আমাকে বিট্রে করো তখন? তখন আমার কি হবে প্রীতম?"
" আমি তোমাকে কেনো বিট্রে করবো আজব? কি বলছো এসব? তুমি আমাকে বিশ্বাস করো না?"
" তো তুমি আমাকে বিশ্বাস করো না?" সুবর্ণা চিৎকার করে উঠলো।
" আমাকে বিয়ে করে যাবে কারণ তুমি আমাকে নিয়ে ইনসিকিউরড। অথচ তুমি বিদেশে অতদূর যাবে আর আমি তোমাকে নিয়ে ভাবলেই সেটা অবিশ্বাস? বাহ!
তুমি বললে না একটু আগে যে আমি খুশি কি না? মন থেকে বলো তো, আমার ঢাকা ভার্সিটিতে চান্স পাওয়ার খবর শুনে তুমি খুশি হতে পেরেছিলে? সেদিন তুমি বলেছিলে তোমার কথা আমি ভাবি না৷ তোমাকে ফেলে চলে যাবো তাই অন্য ভার্সিটিতে পড়ছি। আর আজ তো তুমি দেশ ছেড়েই চলে যাচ্ছো। আজ আমি কি বলতে পারি না যে তুমি আমাকে ফেলে যাচ্ছো? সেদিন তুমি আমাকে স্যাক্রিফাইস করতে বলেছিলে কারণ আমি তোমার চেয়ে বেটার জায়গায় চান্স পেয়েছিলাম। আজ যদি আমি তোমাকে বলি দেশে থেকে যেতে তুমি কি সেটা করতে পারবে? পারবে?"
প্রীতম সুবর্ণার কথাগুলো শুনে হঠাৎই চুপ হয়ে গেলো। প্রীতমকে নীরব দেখে সুবর্ণা কাঁদতে শুরু করলো।
" তুমি পারবে না আমি জানি। আমিও পারিনি। কিন্তু সেদিন আমি পারিনি কারণ পুরো ব্যাপারটা আমার বাবা মায়ের হাতে ছিলো৷ অথচ আজ তোমার পুরো বিষয়টা তোমার হাতে থাকা সত্ত্বেও তুমি কিছুই করতে পারবে না। কারণ তুমি কিছু করতেই চাও না। এটাই বুঝি ভালোবাসা? বিশ্বাস করো আমি তোমার যাওয়ার কথা শুনে অনেক বেশি খুশি হতাম যদি তুমি আমাকে আরো আগেই কথাগুলো বলতে। অথচ তুমি চেয়েছো বিয়ে করে একটা বউ নামক ট্যাগ লাগিয়ে তারপর চুপিচুপি পালিয়ে যেতে? আমার খুশিতে যেখানে তুমি খুশি হতে পারো না সেখানে কিভাবে আশা করো যে আমি তোমার খুশিতে খুশি হবো? সেটা তো হতে পারে না তাইনা।"
সুবর্ণা নিজের চোখমুখ মুছে নিজের ব্যাগগুলো নিয়ে উঠে বেড়িয়ে আসতেই প্রীতম পেছন থেকে তাকে টেনে ধরলো।
" এসব কি বলছো তুমি? তোমার কি হয়েছে বলো তো? "
সুবর্ণা প্রীতমের হাত ছাড়িয়ে প্রীতমের চোখের দিকে তাকালো,
" আমাদের ভালো সময়গুলো বোধহয় শেষ হয়ে গেছে। কারণ আমরা আবেগের বয়সটা পেরিয়ে বুঝতে শেখার বয়সে চলে এসেছি। আজকাল আর কম্প্রোমাইজ করে সম্পর্ক টিকে রাখতে ইচ্ছে করে না। বারবার নিজের ভালোবাসার প্রমাণ দিতেই ইচ্ছে করে না। আমি বড্ড ক্লান্ত
ভালো থেকো প্রীতম।"সুবর্ণা একটা রিকশায় উঠে নিজের বাড়িতে চলে এলো। কোনোরকমে ঔষধগুলো মায়ের হাতে দিয়ে নিজের ঘরে এসে দরজা লাগিয়ে চিৎকার করে কিছুক্ষণ কাঁদলো সুবর্ণা।
কাঁদতে কাঁদতেই একসময় উঠে গিয়ে ওর আর প্রীতমের স্মৃতি জড়িয়ে আছে এমন সবকিছু বের করলো। প্রীতমকে নিয়ে লেখা সব ডায়েরিও বের করে মেঝেতে ফেললো। কাঁদতে কাঁদতেই জীবন দিয়ে আগলে রাখা প্রতিটি স্মৃতি জ্বালিয়ে দিলো। চোখের সামনে নিজের সবচেয়ে প্রিয় জিনিসগুলো পুরে ছাই হয়ে যেতে দেখে ডুকরে কেঁদে উঠলো সুবর্ণা।
কতক্ষণ এভাবে ছিলো সুবর্ণা জানে না। বাইরে থেকে মায়ের গলার আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। কোনোমতে শরীরটাকে টেনে নিয়ে রুমের দরজা খুলতেই কাশফিয়া রহমান মেয়ের ঘরে ঢুকলেন। মেঝেতে আধপোড়া ছাই আর আগুন দেখে ভয়ে পেয়ে মেয়ের দিকে তাকাতেই দেখলেন তার মেয়েটা হঠাৎই কেমন যেন কুকড়ে গেছে। মেয়ের মাথায় হাত রাখতেই বাচ্চা মেয়ের মত সুবর্ণা মায়ের কোলে ঝাপিয়ে পড়লো।
" আমাকে তুমি ক্ষমা করে দিও মা। আমাকে তুমি ক্ষমা করে দিও। আমি আর কখনোই নিজের জন্য তোমার বিপদ ডেকে আনবো না। কিন্তু কি করবো বলো, আমি তো সত্যিই ওকে অনেক বেশি ভালোবাসি। ওকে ছাড়া আমি যে আমাকে ভাবতেও পারি না। অথচ আজ ওকে নিয়েও আমি আমাকে ভাবতে চাই না। দিন শেষে ও তো আমার বাবার খুনির ছেলে। আমি কিভাবে ওকে নিজের জীবনে মেনে নেবো মা কিভাবে!"কাশফিয়া রহমান মেয়েকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রয়েছেন। তার মেয়ে কান্না জড়ানো কণ্ঠে কিসব যেন বলছে ঠিক বুঝতে পারছেন না তিনি। শুধু এইটুকু বুঝতে পারছেন মেয়েটার এখন তাকে খুব দরকার।
আরো একটু শক্ত করে মেয়েকে জড়িয়ে ধরলেন তিনি। আর আস্তে করে বলতেন, " আমি আছি সোনা। কিচ্ছু হবে না। আমি আছি তো।"( চলবে...)