সুবর্ণলতা
- মেহেরুন নেছা হিতৈষীপর্ব ১৮
★
চারিদিকে শুনশান নীরবতা। কোথাও কোনো শব্দ নেই। কেমন যেন নিশ্চুপ হয়ে গেছে সবকিছু। এমন রাতগুলো মন খারাপ করে দেয়। প্রীতম বিছানায় কিছুক্ষণ গড়াগড়ি করে উঠে পরলো। আজ আর তার চোখে ঘুম আসবে না। ভোরেই গাড়ি আসবে, তাদের নিয়ে যাবে নিজ নিজে বাসায়। কতগুলো দিন সবাই বাড়ি ছেড়ে এতটা দূরে। প্রীতমের অবশ্য বাড়ির জন্য মন খারাপ করার কোনো কারণ নেই, বাড়ির জন্য মন খারাপ হচ্ছেও না। মনটা খারাপ হয়ে আছে সুবর্ণার জন্য। আসার আগে মেয়েটাকে বলেও আসা হয়নি। আসলে ঠিক বলে আসা হয়নি না, সবকিছু এত দ্রুত হয়ে গেলো যে বলে আসার সুযোগই পায়নি সে।
প্রীতম বিছানা ছেড়ে উঠে আলো জ্বালিয়ে দিলো। পুরো ঘরটা আলো হতেই বিছানার পাশে থাকা টেবিলের উপর থেকে ছোট একটা নোটপ্যাড আর একটা পেন তুলে নিলো।
ডায়েরি লেখার শখ কোনোকালেই ছিলো না প্রীতমের। এখনো নেই। তবে সুবর্ণার জন্য লিখতে ভীষণ ভালো লাগে তার। এই অভ্যাস আর ভালোলাগাটাও সুবর্ণাই তৈরি করে দিয়েছে। প্রীতম নোটপ্যাডটা কোলের ভেতর নিয়ে চোখ বন্ধ করে কিছুক্ষণ বসে রইলো।
ছোটবেলায় যখন ওদের স্কুলে কোনো ছুটি চলতো, দুজনে কেমন পাগল হয়ে যেতো একে অপরকে দেখার জন্য কথা বলার জন্য। প্রীতম হাতের কাছে ফোন পেলেও সুবর্ণার জন্য ফোন পাওয়া আর প্রীতমের সাথে মনের আনন্দে কথা বলাটা সেই সময়ে অসম্ভব ছিলো। আর ততদিনে সুবর্ণার ডায়েরি লেখার ব্যাপারটা নিজের ভেতরে কেমন যেন ঢুকে গিয়েছিলো। তাই একবার সুবর্ণাই প্রীতমকে বলেছিলো, " আচ্ছা আমাদের তো ছুটিতে অনেকগুলো দিন দেখা হয় না কথা হয় না। একটা কাজ করলে কেমন হয়? আমরা এবার থেকে প্রতি ছুটিতে নিজেদের মনের কথাগুলো লিখে রাখবো। "
সুবর্ণার প্রস্তাবে প্রীতম খানিকটা অবাকই হয়েছিলো। কারণ এসব লিখে রাখার ব্যাপার স্যাপার তার মাঝে নেই। প্রীতমের অবস্থা দেখে সুবর্ণা পুরোটা বুঝিয়ে দিয়েছিলো।
" শোনো। ছুটির পর থেকে আমরা কবে কোন সময় কি করলাম, সে সময় আমরা একসাথে থাকলে কি বলতাম কি করতাম এইসব আমরা একটা ডায়েরিতে লিখে রাখবো৷ কোন সময় কোন দিন আমরা কি করছি, কি করতে ইচ্ছে করছে, কি বলতে ইচ্ছে হচ্ছে, কখন আমাদের একে অন্যের কথা মনে পড়ছে আমরা সব লিখে রাখবো। আর এরপর ছুটি শেষ হয়ে গেলে আমরা আমাদের ডায়েরিগুলো এক্সচেঞ্জ করবো এবং অন্যের লেখাগুলো পরে পড়বো। "
আইডিয়াটা দুজনেরই ভীষণ প্রিয় হয়ে গেলো৷ এরপর বেশ কিছুটা সময় এভাবেই কেটে গেলো। একটা সময় সুবর্ণা কলেজে উঠলো, নিজের ফোন পেলো৷ তারপর থেকে ফোনেই কথা হত। কিন্তু আবার যখন বাসায় ধরা পরে যেত, আবার ডায়েরি সিস্টেম শুরু করে দিত তারা।
মনে মনে এসব ভেবে হেসে দিলো প্রীতম। চোখটা খুলে নোটপ্যাডে লেখা শুরু করলো।
" সরি সোনা৷ আমি ভীষণ ভীষণ সরি। সামনে গিয়েই কান ধরবো প্রমিজ। কি করবো বলো, বাবা কল দিয়ে বললো কি একটা জরুরি কাজ। একটা লোকেশন দিয়ে সেখানে যেতে বললো৷ গিয়ে দেখি বাবা হাজির। কি এক আর্ট ক্যাম্পেইন হবে, আমাকেও নাকি যেতেই হবে। বাবার এই আর্টের প্রতি আগে কখনো এতটা আগ্রহ দেখিনি বুঝলে। সবাই এত জোর করলো যে প্রিপারেশন ছাড়াই গাড়িতে উঠে পরলাম আর সোজা এখানে৷ সিলেটের একদম শেষ প্রান্তে একটা রিসর্টে এখন আমরা আছি। কেমন গহীন একটা জায়গা। তোমাকে যে কল করে জানাবো, সে উপায়ও নেই। এই ক্যাম্পেইনে নাকি ফোন ল্যাপটপ এসব কিছুই এলাউ না। এখানে নাকি এসব রাখা রিস্ক, আর এই ক্যাম্প যারা হোস্ট করছে তারা নাকি চায় আমরা এই কয়েকটা দিন প্রকৃতির সাথে মিশে যাই। কি অদ্ভুত তাই না?
এই মানুষগুলোকে আমি চিনিও না। এদের এসোসিয়েশনের নামও কখনো শুনিনি। আর্ট ক্যাম্পেইন তো মনেই হচ্ছে না, মনে হচ্ছে যেন চার পাঁচজন বন্ধু সাথে দুই তিনজন বড়ভাই মিলে পিকনিক করতে এসেছি। এখানকার মানুষগুলোও কেমন যেন অদ্ভুত। দেখা হলে তোমাকে বলবো।
আচ্ছা! আমি তোমাকে না বলে এসেছি বলে তুমি কি রাগ করে আছো আমার উপর? বিশ্বাস করো জান, তোমাকে ছেড়ে থাকতে আমার পাগল পাগল লাগছে। ইভেন আমিই আজ রাতে বাকিদের সাথে অনেক চিল্লাচিল্লি করেছি যে আমি বাড়ি যেতে চাই। এখানে আমার একদম বিরক্ত লাগছে। তুমি একদম রাগ করোনা সোনা, আর মাত্র কয়েকটা ঘন্টা, তারপরেই আমি আসছি তোমার কাছে "
প্রীতম এতটুকু লিখে থামলো। বিছানার পাশে জানাদ দিকে তাকাতেই দেখলো ভোর হয়ে গেছে। প্রীতম দ্রুত নিজের ব্যাগ গুছিয়ে রেডি হয়ে নিলো। বাস আসলে একটুও দেরি করতে চায় না সে।