সুবর্ণলতা
- মেহেরুন নেছা হিতৈষীপর্ব ৩৩
★
প্রীতম দেশে ফিরেছে আগেরদিন রাতেই। কিন্তু সুবর্ণাকে ইচ্ছে করেই সেটা জানায়নি। এমনকি এখন পর্যন্ত নিজের বাড়িতেও যায়নি সে। দেশে ফেরার আগেই মোটামুটি খোঁজ নিয়ে সুবর্ণার বাড়ি থেকে কাছে হয় এমন একটা রিসর্ট বুক করেছে। সেখানে ছোট করে সুবর্ণার জন্য কিছু সারপ্রাইজ প্ল্যান করেছে প্রীতম। সে জানে সুবর্ণা তার আসার খবর শুনে অনেক কিছু প্ল্যান করেছে।
রাতে ফেরার পর বেশ লম্বা একটা ঘুম দিয়েছিলো প্রীতম। সকাল গড়িয়ে দুপুরে উঠে ফ্রেশ হয়ে নাস্তা খেয়েই নিজের কাজে লেগে পরলো।
প্রীতম যে রিসর্টটা ভাড়া নিয়েছে, সেখানে সুন্দর একটা ঘাট বাঁধানো পুকুর আছে। আর পুকুরে একটা নৌকার ব্যাবস্থাও করে ফেলেছে সে।
প্রীতম নিজের রুম থেকে বেড়িয়ে পুকুরের কাছে গিয়ে কয়েকজনকে কল করলো এবং দ্রুত নিজের কাজে লেগে পরলো।রেহানা অনেকক্ষণ হলো এসেছে। সুবর্ণা এর মধ্যেই নিজ হাতে চা বানিয়ে তাকে খাইয়েছে। রেহানা অনেকক্ষণ ধরে সেই চায়ের প্রসংশাও করেছে। কিন্তু রেহানার এই বাড়িতে আসা এমনকি এই বাড়িতে যে সুবর্ণা থাকে সেটার তথ্য জানা পুরোটাই এখন রহস্য লাগছে সুবর্ণার।
সুবর্ণা নিজে থেকেই রেহানাকে প্রশ্ন করে ফেললো,
" বললে না তো কিভাবে জানলে আমি যে এখানে থাকি।"
" গত ছয়মাস ধরে তো শুধু তোমাকেই খুঁজে যাচ্ছি। ভাগ্য খারাপ, এত লম্বা সময় নিয়ে ফেলেছি। তা না হলে হয়ত আরো আগেই সব মিটে যেত।"
রেহানা কেমন যেন ইতস্তত করছিলো কথা বলার সময়। সুবর্ণা বুঝতে পারলো রেহানার কোনো সমস্যা হয়েছে।
রেহানার কাছে গিয়ে বসে তার হাতদুটো নিজের হাতের ভেতরে নিয়ে নিলো সুবর্ণা।
" আমাকে বলতে পারো আপু। আমি সব রকম চেষ্টা করবো তোমাকে সাহায্য করার। বলো আমাকে, কি হয়েছে তোমার? এমন অসুস্থ লাগছে কেনো? দেখে মনে হচ্ছে কতগুলো রাত শান্তিতে ঘুমোওনি।"
রেহানা চট করে নিজের হাতদুটো সড়িয়ে নিয়ে দাঁড়িয়ে গেলো। আবার একাই শান্ত হয়ে নিজের জায়গায় বসে পরলো।
সুবর্ণা এবার কিছুক্ষণ সময় দিলো। কিছু জিজ্ঞাসা করলো না আর।
একটু সময় নিয়ে রেহানাই মুখ খুললো,
" তোমার সুবর্ণলতার অনেক নাম শুনেছি। সেখানে আমায় একটা থাকার জায়গা দেবে? আর একটা কাজ। ছোট হলেও চলবে। দেবে প্লিজ?"
রেহানার এমন মিনতি শুনে সুবর্ণার চোখে পানি চলে এলো। মনে মনে ভীষণ কষ্ট হলো সামনে থাকা মেয়েটার জন্য।
" হ্যাঁ হবে কিন্তু...."
" কোনো কিন্তু না। প্লিজ। আমার একটা থাকার জায়গা খুব দরকার। দেবে? আর.."
রেহানা কিছু একটা বলতে গিয়ে আবার থেমে গেলো। সুবর্ণা এক গ্লাস পানি এগিয়ে ধরতেই কেমন উদ্ভ্রান্তের মত পানিটুকু খেয়ে আবার চুপসে গেলো রেহানা।
সুবর্ণা আলতো হাতে রেহানার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো।
" আপু! তোমার কি কিছু হয়েছে? আমাকে কিছু বলতে চাও?"
রেহানা হঠাৎ সুবর্ণাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করলো। সুবর্ণা কিছুই বুঝতে পারছিলো না, কি এমন হলো যার জন্য বাশার হকের মেয়ে তার কাছে এসে সাহায্য চাইছে। বাশার হকের কথায় এর আগেও রেহানা তাকে অনেক অপমান করেছে। আজও আবার কোনো চালাকি করতে আসেনি তো সে? সুবর্ণার বুকটা একটু ধ্বক করে উঠলো।
রেহানা বেশ কিছুক্ষণ কাঁদলো। এরপর সুবর্ণাকে ছেড়ে নিজের চোখমুখ মুখে নিলো।
" তোমার বাবার খুনের কেসটা যে পুলিশ হ্যান্ডেল করছেন, উনার সাথে আমাকে একটু দেখা করিয়ে দিতে পারবে? আমার উনাকে কিছু বলার আছে। "
সুবর্ণা এবারে একটু চমকে গেলো। ছয় মাস হয়ে গেছে কেসের। কিন্তু বাশার হককে খুঁজে না পাওয়ায় কেসটা ধুলোর নিচে চাপা পরে গেছে। সুবর্ণাও প্রায় ভুলেই গেছিলো কেসটার কথা। সব ভুলেই তো আবার প্রীতমের সাথে নতুন করে পথ চলতে শুরু করেছিলো। কিন্তু এতদিন পর হঠাৎ এই মেয়েটা কেসের ব্যাপারে বলছে কেনো? সুবর্ণা নিজেকে সামলে নিলো কিছুটা।
" কৌশিক আংকেল? কিন্তু কেনো?"
" প্লিজ সুবর্ণা এত প্রশ্ন আমাকে করো না। আমি সব বলবো তোমাকে। কিন্তু ওই পুলিশ অফিসারের সাথে আমার দেখা করিয়ে দাও প্লিজ। বিশ্বাস করো, আজ আমি তোমার এতটুকু ক্ষতি চাইতেও আসিনি। প্লিজ আমাকে শেষ বারের মত বিশ্বাস করো।"
সুবর্ণা এবার যেন গলে গেলো। একটু দূরে উঠে গিয়ে ইন্সপেক্টর কৌশিক আহমেদকে কল করলো।
সুবর্ণা ফিরে আসতেই রেহানা কেমন যেন করে উঠলো। অসহায়ের মত সুবর্ণার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলো, ''কি হলো, কি বললেন উনি? আমার সাথে দেখা করবেন তো?"
" কৌশিক আংকেল ঢাকার বাইরে আছেন আপু। দুদিন পর ফিরবেন। ফিরেই তোমার সাথে দেখা করবেন। তুমি চাইলে এই দুদিন সুবর্ণলতাতে থাকতে পারো।"
সুবর্ণার কথা শেষ হতেই রেহানা আচমকা সুবর্ণাকে জড়িয়ে ধরলো।
" প্লিজ। আমাকে নিয়ে চলো সেখানেই। না হলে ওরা আমার বাচ্চার মত আমাকেও মেরে ফেলবে। প্লিজ আমাকে নিয়ে চলো।"
" কে মেরে ফেলবে আপু? কি বলছো তুমি? আমাকে বলো?"
সুবর্ণা প্রশ্ন করলো কিন্তু রেহানা আবার কেমন চুপসে গেলো। সুবর্ণা বুঝতে পারলো এই মেয়ের জীবনে বুঝি ভয়ানক কিছু ঘটেছে।