সুবর্ণলতা
- মেহেরুন নেছা হিতৈষীপর্ব ১৬
★
সুবর্ণা নিজের ঘরের এক কোণে বসে কাঁদছিলো। হঠাৎই কলিং বেলের আওয়াজ পেলো কিন্তু উঠতে ইচ্ছা করছে না। সুবর্ণা কিছু না শোনার ভান করে কিছুক্ষণ বসে থাকলো। কিন্তু তবুও কলিং বেলের আওয়াজ কমলো না। সুবর্ণা নিজেই বিরক্ত হয়ে ঘর থেকে বেড়িয়ে দরজা খুলে দিলো। দরজার ওপাশে বাশার হককে দেখে কিছুটা চমকে গেলো। মনের কোণে অদ্ভুত এক ভয় জমাট বাঁধছিলো তার মনে৷ কোনো কথা না বলে বাশার হককে সালাম জানিয়ে বসার ঘরে বসতে দিলো সুবর্ণা।
" আংকেল আপনি এখানে? এই সময়ে? প্রীতমের কোনো খোঁজ পাওয়া গেছে? প্রী-প্রীতমের কিছু হয়নি তো আংকেল? "
বাশার হক আশেপাশে পুরো ঘরটা দেখে নিলেন চোখ বুলিয়ে। তারপর পায়ের উপর পা তুলে পকেট থেকে একটা সিগারেট বের করলেন। তাতে আগুন জ্বালিয়ে জ্বলন্ত সিগারেটটা এক টানে শেষ করে দিলেন।
" তোমাদের বাসায় এশট্রে নেই তাই না মা?"
সুবর্ণা একটু অবাক হলো। বাশার হকের এই আচরণ তার অচেনা। একটু ভয় ভয় কন্ঠেই বললো,
" ন-না আংকেল। আসলে বাসায় তো কেউ সিগারেট খায় না৷ "
" হ্যাঁ তাও তো কথা। তোমার বাপরে বহুবার এইসব হাবিজাবি জিনিস দিতে চাইছি। উনি নেন নাই। অনেক বেশিই ভালো মানুষ ছিলেন তোমার বাবা। "
সুবর্ণা বাশার হকের কথায় এবার অবাক হলো। লোকটা কি বলছে এসব?
" ওহ কি যেন কইছিলা? প্রীতম? আমার আব্বাজানের আবার কি হইবো। ও তো ভালো আছে। "
" প-প্রীতম! ও কোথায় আংকেল? পুলিশ তো.... "
" সব জানি মা সব জানি। এইসব নিয়াই তো আজ তোমার বাড়িতে আসছি৷ তোমার সাথে আলাপ আছে। "
বাশার হক সুবর্ণার দিকে কিছুটা ঝুঁকে গেলেন।
" তোমার বাপরে আমি খুন করাইছি। "
কথাটা শুনেই সুবর্ণা লাফিয়ে উঠলো।
" কি বলছেন এসব আংকেল? "
" আহহা! চেতলে হবে? বসো মা বসো। এখনো তো বহুত কথা বাকি। সবে তো শুরু করলাম"
সুবর্ণা প্রচন্ড ঘাবড়ে গেলো। তবুও কোনোমতে নিজেকে শান্ত করে বসে পড়লো।
" শোনো মা। তোমার বাপরে আমিই খুন করাইছি। আমার লোকজন দিয়াই খুনটা করাইছি। অবশ্য তোমার মায়েরে মারার আমার কোনো প্ল্যান ছিলো না বললেই চলে। ওইযে কথায় আছে না, মহিমা মানুষের বুদ্দি কম। তোমার বাপেরে মারার সময় তোমার মা মাঝে আইসা পরলো। আমার ছেলেপুলেগুলার আর কি দোষ কউ। মাইরা দিলো..."
সুবর্ণা এবার কাঁদতে শুরু করে দিয়েছে। তার বিশ্বাসই হচ্ছে না এই কথাগুলো। মনে হচ্ছে যেন এই লোকটা সব বানিয়ে বানিয়ে বলছে। কিন্তু কেনোই বা বলছে এসব? সুবর্ণা কাঁদতে কাঁদতে মুখ খুললো,
" কেনো করেছেন এসব আপনি? আমি প্রীতমকে বিয়ে করিনি বলে? নাকি আমার বাবা ওর গায়ে হাত তুলেছিলো বলে? আংকেল? আ-আপনি!"
বাশার হক সুবর্ণার কথাগুলো শুনে হো হো করে হেসে দিলেন যেন খুব মজার কথা শুনলেন।
" তুমি বড্ড নরম মনের। পুরাই আমার মোহর মতন। মাইয়া মানুষের এই এক দোষ। আবেগ দিয়া কাজ বেশি করে। তোমার এখনো মনে সন্দেহ হইতাছে যে আমি মিথ্যা বলতেছি? মন দিয়া আমার কথা শোনো আমিই খুনটা করাইছি। ইচ্ছা ছিলো নিজ হাতে খুনটা করার। কিন্তু আমি আবার রক্ত ভয় পাই বুঝলা। চাইলেও শেষ পর্যন্ত কোনো খুনই নিজ হাতে করতে পারি না।"
সুবর্ণার চোখ বেয়ে পানি পড়ছে। সে চোখের সামনে তার বাবার খুনিকে দেখছে। যে কিনা তার সবচেয়ে ভালোবাসার মানুষের বাবা হয়। সুবর্ণার মাথা কাজ করছে না।
সুবর্ণাকে চুপ থাকতে দেখে বাশার হক নিজে থেকেই বলতে শুরু করলেন,
" শোনো মা। আমার নিজের ঘরেও মেয়ে আছে। কোনো ছেলে যদি আমার মেয়েরেও এমন বয়সে এমন ভাবে বিয়ে করতে চায়, আমি নিজেই তো সেই বিয়ে ভেঙে দিতাম। আর রইলো বাকি গায়ে হাত! আমার সামনে যদি আমার মেয়েরে কেউ গায়ে হাত তোলার চেষ্টা করে, জোর জবরদস্তি করে তারে তো আমি খুনই করে দিতাম। তোমার বাপ তো আমার আব্বাজানরে শুধু একটা থাপ্পড় দিয়া ছাইড়া দিছে। এইসব কারণে কেন এতবড় কাজ করতে যাবো বলো মা।"
সুবর্ণা মনোযোগ দিয়ে কথাগুলো শুনে যাচ্ছে। মুখে কিছু বলার মতন শক্তিও পাচ্ছে না। শুধু মনে হচ্ছে এই সব স্বপ্ন। এক্ষুনি সব ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু না, বাশার হক বলতেই থাকলেন,
" তোমার বাবারে আমি চিনি বহু আগে থেকে। আমার যত দুই নম্বরি ব্যাবসা আছে তার বেশিরভাগ জিনিসের জন্য তোমার বাপরে আমার দরকার ছিলো। তোমার বাপরে আমি বহুবার লোকজন দিয়া বুঝাইছি যেন আমার পথের কাটা না হয়। বরং যেন আমার দেওয়া ছোটখাটো উপহার গ্রহণ করে আর আমার কাজগুলা কইরা দেয়। কিন্তু ওইযে তোমার বাপ মানুষটা একটু বেশিই ভালো মানুষ ছিলেন। যতই বুঝাই, ওইযে ভালো মানুষি! আমার উপহারগুলা নাকি তার কাছে ঘুষ লাগে। আমার বেয়াইনি কাজ কর্ম নাকি দেশের ক্ষতি করে আরো কত কি। এরপর হঠাৎ একদিন জানলাম আমার জানের টুকরা পোলাটা যেই মাইয়ারে পছন্দ করে সেই মাইয়া তুমি। ব্যাস! সব মাইনা নিলাম। চিন্তা করলাম তোমারে দিয়াই তোমার আব্বার ব্যাবস্থা নিবো। এর মধ্যেই আমার পোলাডা তোমারে বিয়ার জন্য পাগল হয়ে গেলো আর তোমার বাপ আমারে চিনার পর তোমারে আটকানো শুরু করলো। কয়দিন আগে তোমাদের বিয়ার ব্যাপারে আমিই পোলারে বুঝাইছিলাম। তোমার বাপটা রাজিও হইলো কারণ আমি তারে বুঝাইছিলাম যে আমি আমার বেয়াইনি কাজ ছাড়তেছি। তোমার বাপটাও আমার কথায় সব মাইনা নিলো কিন্তু..... কিন্তু আম্মাজান তুমি তখন বিয়াতে বাগড়া দিলা। তারপর আর কি করার, তোমার বাপ আবারও জানতে পারলো যে আমি আমার কাজ চালাইয়া যাইতাছি। সে আবার আমার পিছে লাগলো। কি আর করা। ছোটখাটো একটা এক্সিডেন্ট করায় দিলাম। তোমার বাপটা তাতেও লাইনে আসলো না।"
সুবর্ণা এবার মুখ খুললো,
" বাবার এক্সিডেন্টটাও?"
" হ্যাঁ মা। ওইটাও আমিই করাইছিলাম। কিন্তু কি আর করার। তোমার বাপের মরার বড়ই শখ হইছিলো।"
সুবর্ণার মাথাটা ঘুরছে। সে জানে না কি বলবে কি করবে। কোনোমতে চোখমুখ মুছে একটু পানি খেয়ে নিলো।
" আ-আপনি? কিন্তু কেনো? আ-আর আমাকে এসব কেনো জানাচ্ছেন? আমি যদি পুলিশকে সব বলে দেই তখন?"
বাশার হক সুবর্ণার কথাগুলো শুনে উচ্চস্বরে হেসে দিলো।
" বাচ্চা মেয়ে তুমি। কাকে কি বলবে? কোনো প্রমাণ আছে তোমার কাছে আমার বিরুদ্ধে? তবে হ্যাঁ! যদি পুলিশকে তদন্ত করতে বলো, তখন কে ফেসে যাবে জানো?"
"কে?" সুবর্ণা কাঁপা কাঁপা গলায় প্রশ্ন করলো।
" আমার ছেলে প্রীতম।"
"কিহ? আপনি কি বলছেন এসব? "
সুবর্ণার যেন অবাক হওয়ার শক্তিও হারিয়ে ফেলেছে।
" যেই গাড়িতে তোমার বাবার প্রথম এক্সিডেন্ট হয় সেই গাড়ির সব কাগজপত্র আমার আব্বাজানের নামে। অবশ্য আমার পোলাডা সেইসবের কিচ্ছুই জানে না। এইটুকুই না, সেইদিন ভোরে যে আমার পোলা তোমাদের বাড়িতে আসছিলো? আমিই তো উস্কায়ে পাঠাইছিলা। যেন ওর বিরুদ্ধে কেস পাকা হয়। আর পোলাডার ঘড়িও তো আমার ছেলেপুলেদের দিয়েই রাখা। "
সুবর্ণা যেন নিজের কানকেও বিশ্বাস করতে পারছে না। একজন বাবা শুধুমাত্র নিজের কাজ হাসিল করার জন্য এতটা নিচে নামতে পারে?
" শোনো মা। তোমারে একটা কথা বলি। পুলিশরে বলো এই কেসটা নিয়া এত মাথা না ঘামাইতে। বেশি মাথা ঘামাইতে গেলেই বিপদ। আমারে তুমি কখনোই ছুইতে পারবা না। মাঝখান থেকে আমার ছেলেডা কয়েকটা দিন পুলিশের চক্করে ঘুরতো। তয় আমি ঠিকই ওরে ছাড়াইতাম। যতই হোক, পোলা তো। তবে অসুবিধা যেইটা হবে সেইটা হলো আমার পোলার পর পুলিশ তোমারে ধরবে। টাকা দিয়া হইলেও আমি তোমারে ফাসায়ে দিবো। আর তোমার মায়ের জানটা তো...."
" নাহ....."
সুবর্ণা চিৎকার করে উঠলো।
" আ-আমার মাকে কিছু করবেন না প্লিজ। আ-আমার মাকে কিছু করবেন না..."
বাশার হক উঠে দাঁড়ালেন।
" শোনো মা। নিজের ভালো পাগলেও বুঝে। এইসব ঝামেলা বাদ দিয়া নিজের পড়াশোনায় মন দাও। আর আমার পোলারে নিয়া চিন্তা কইরো না। ওরে আমিই দূরে পাঠাইছি। যাতে দরকার পড়লে ওরে ফাসায়ে দেওয়া যায়।
ও এইসবের কিছুই জানে না। আর আমার পোলারে এইসব জানানোর চেষ্টাও কইরো না। লাভ কিছুই হইবো না। আসলে শয়তানের পোলা তো। সেও কিন্তু শয়তানই হইবো। ভালো থাকো মা। আজ আসি।
আর হ্যাঁ! আমার পোলা কয়েকদিনের মধ্যেই তোমার লগে যোগাযোগ করবে। তুমি চাইলে সব মানায়ে নিয়া চলতে পারো। পুত্রবধূ হিসাবে তোমারে মাইনা নিতে আমার কোনোই আপত্তি নাই।
থাকো আম্মাজান। আসি।"(চলবে....)