#10

46 4 0
                                    

সুবর্ণলতা
- মেহেরুন নেছা হিতৈষী

পর্ব ১০

প্রীতম তাড়াহুড়ো করে মাঝরাতে বাড়িতে ঢুকলো। বাড়িতে পা দিয়েই বুঝতে পারলো বাড়ির পরিবেশ থমথমে। বাবার চামচা জাতীয় লোকগুলো আর কাজের লোকগুলো সবাই বাড়ির দরজায় দাঁড়িয়ে। প্রীতম সবাইকে পাশ কাটিয়ে বাড়ির ভেতরে ঢুকতেই চারিপাশে আলো জ্বলে উঠলো। সবাই হৈহৈ করে উঠলো। প্রীতম তার বোনের গলা শুনতে পেলো। চিৎকার করে সবাই বলছে "হ্যাপি বার্থডে, শুভ জন্মদিন। " কিছু বুঝে ওঠার আগেই প্রীতমের মাথার উপরে পার্টি স্প্রে দেওয়া হলো। প্রীতম বুঝলো এইসব বাবা আর তার আপুর প্ল্যান। এত টেনশন আর ঝামেলার ভিতরে আজকের ডেটটা মাথা থেকে একদম বেড়িয়ে গেছিলো। আজকে ওর জন্মদিন আর তাই বাবা ওকে মিথ্যে বলে নিয়ে এসে সারপ্রাইজ দিলো। সবাই হৈহৈ করে প্রীতমকে জায়গা করে দিতেই প্রীতম দেখতে পেলো বাবা মা একটা ছোট টেবিলে কেক নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। প্রীতম দৌড়ে মায়ের কাছে ছুটে গেলো।
" মা তুমি ঠিক আছো তো? আমি কত ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম তুমি জানো? "
" বুঝেছি আব্বা। টেনশন নিও না। আমরা সবাই ভালোই আছি৷ তোমার আব্বা আর রেহানা মা-ই তো এইসব করলো। এতসব ফন্দি কি আর আমার মাথায় আসে কউ তো।"
প্রীতমের ফোনে কল আসছে। প্রীতম বুঝতে পারলো ওর ফ্রেন্ডরা উইশ করার জন্য কল করছে। কাধ থেকে ব্যাগটা একটা কাজের লোক এসে নিয়ে গেলো। ফোনটা পকেট থেকে হাতে নিতেই রেহানা দৌড়ে এসে ফোনটা নিজের হাতে নিয়ে নিলো।
" আজ কোনো ফোন কল না ভাই। আজকের দিনটা তুই আমাদের সাথে কাটাবি। আর বিকেলে আমাকে নিয়ে একসাথে ভার্সিটিতে ফিরবি। তোর জন্য আমি ক্লাস মিস দিয়ে আসছি বুঝতেছিস?"
প্রীতম কিছু বলার সুযোগই পেলো না। তার আগেই সবাই আবারও তাকে ঘিরে ধরলো। বাশার হক ছেলের হাতে একটা ছুড়ি দিয়ে ইশারায় কেকটা কাটতে বললেন। প্রীতম কেক কেটে বাবা মা এবং বোনকে খাইয়ে দিলো।

শাহরিয়ার কবিরকে কেবিনে শিফট করা হয়েছে। কেবিনটা বেশ বড়। দুটো বেড, একটা বাথরুম। একটা ছোট্ট ব্যালকনি। সুবর্ণা খালি বেডটাতে পা তুলে বসে বসেই ঝিমাচ্ছিলো। হঠাৎ বাইরে থেকে মেঘের শব্দে জেগে উঠলো। বর্ষার এই সময়টা বড্ড মন খারাপ করিয়ে দেয়। হুটহাট বৃষ্টি নামে আবার হুটহাট রোদ। কখনো মাঝরাতে বৃষ্টি আবার কখনোবা বৃষ্টি ছাড়াই শুধু মেঘের হাকডাক। সুবর্ণা নিজের বেড থেকে নেমে বাবার মাথার কাছে গিয়ে বসলো। বাবা কেমন বাচ্চাদের মতন ঘুমিয়ে আছে। সুবর্ণা একা বলে ডাক্তার তাকে বাবার কাছে থাকার অনুমতি দিয়েছে। বাবার মাথায় একটু হাত বুলিয়ে দেয়ালে থাকা বড় ঘড়িটার দিকে চোখ গেলো সুবর্ণার। রাত তিনটা বাজে। এতক্ষণে প্রীতমের বাড়িতে পৌঁছে যাওয়ার কথা। কিন্তু যোগাযোগ করার উপায় নেই এই মুহূর্তে। কারণ তার ফোনটা সে বাসাতেই ফেলে এসেছে। ধীর পায়ে ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়ালো সুবর্ণা। হঠাৎ ঝমঝম করে বৃষ্টি নামা শুরু হতেই সুবর্ণার যেনো কিছু একটা মনে হলো। দৌড়ে কেবিন থেকে বেড়িয়ে রিসেপশনে চলে গেলো সে। রিসেপশনে থাকা মাঝ বয়সী মহিলাটিকে জিজ্ঞাসা করলো,
" আজকে কত তারিখ? আসলে বাবাকে নিয়ে কয়েকদি৷ যা গেছে আমার উপর দিয়ে। তারিখ একদম খেয়াল নেই।"
" ১ জুন।"
ডেট বলেই ঘটাঘট নিজের কাজে মন দিলো রিসেপশনিস্ট।
তারিখটা শুনেই চমকে উঠলো সুবর্ণা। নিজেকেই নিজে কিছুক্ষণ গালি দিতে থাকলো মনে মনে।
আজ ফার্স্ট জুন। প্রীতমের জন্মদিন।  আজ ওর ভার্সিটি খুলবে। অথচ প্রীতম যখন ওকে ভার্সিটি খোলার কথা বলেছিলো ওর একদমই মনে ছিলো না তারিখটা। সুবর্ণা লক্ষ্য করলো সে হাটতে হাটতে রিসেপশন ছেড়ে যাচ্ছে। দৌড়ে আবার রিসেপশনের দিকে চলে গেলো।
" এক্সকিউজ মি। আমি কি এই টেলিফোন থেকে একটা কল করতে পারি? আসলে আমার ফোনটা বাড়িতে ফেলে এসেছি।"
" ইয়েস। ইউ ক্যান।"
মহিলার থমথমে গলাকে এবার আর পাত্তা দিলো না সুবর্ণা। ঝটপট প্রীতমের নাম্বারে ডায়াল করলো। কিন্তু ওপাশ থেকে কল কেটে গেলো। সুবর্ণা ভাবলো হয়ত চাপ লেগে কেটে গেছে।
সুবর্ণা বেশ কয়েকবার চেষ্টা করলো কিন্তু বারবারই কেউ কলটা যেনো কেটে দিচ্ছে। সুবর্ণার মাথায় কিছুই ঢুকছে না। সুবর্ণা আবার প্রীতমের নাম্বারে কল করতেই ওপাশ থেকে ফোনটা বন্ধ পেলো।
ফোনটা ছেড়ে বাবার কেবিনের দিকে হাটা দিলো সুবর্ণা।
গ্রামের বাড়িতে গেলেই কেমন অদ্ভুত আচরণ করতে শুরু করে প্রীতম। এর আগেও যতবার ওদের মাঝে ঝামেলা হয়েছে তখনও ও গ্রামেই ছিলো। সুবর্ণা মন খারাপ করে আবারও বাবার কেবিনের ব্যালকনিতে এসে দাঁড়ালো।
বাইরে ভীষণ জোরে বৃষ্টি পরছে। ঢাকাশহর ভাসিয়ে দেওয়ার মত বৃষ্টি। এত বৃষ্টির মাঝে নিজের চোখের পানিটুকুকে ভীষণ তুচ্ছ মনে হলো সুবর্ণার।
প্রতি বছর ওরা প্ল্যান করতো কে কিভাবে একে অপরের জন্মদিনটাকে আরো একটু বেশি স্পেশাল করতে পারে। প্রতিবার ঠিক রাত বারোটায় একে অপরকে উইশ করতেই হবে। এর মাঝেই একবার সুবর্ণার বাসায় ওদের সম্পর্কের কথা জানাজানি হলো। সুবর্ণার বাবা মা ওর ফোনটা নিয়ে নিলো। তখন প্রীতম নিজের টাকা জমিয়ে একটা ফোন কিনে দিয়েছিলো ওকে। সুযোগ পেলেই চুপিচুপি বাথরুমে গিয়ে একে অপরের সাথে কথা বলতো। স্কুল কলেজের ছুটিগুলো যেন তখন ওদের জীবনের সবচেয়ে কঠিন সময় ছিলো। একে অপরকে না দেখে থাকাটা কি দারুণ জ্বালার, হারে হারে টের পেতো দুজনে। কত স্বপ্ন ছিলো ওদের, বিয়ের পর একে অপরের সাথে সারা রাত গল্প করবে। আর একে অপরের জন্মদিনে অনেক মজা করবে অনেক সারপ্রাইজ দেবে।
অথচ আজ সুযোগ পেয়েও সবটা কেমন এলোমেলো হয়ে গেলো। সুবর্ণা মনে মনে ভাবলো, হয়ত প্রীতমকে সারপ্রাইজ দেওয়ার জন্যই ওর বাবা মা এভাবে নিয়ে গেলো। আবার ওর মা অসুস্থও হতে পারে৷ মনে মনে আল্লাহর কাছে দোয়া করলো যেন প্রীতম এবং তার বাড়ির সবাই ঠিকঠাক থাকে।
হঠাৎ আজানের শব্দে সুবর্ণার হুশ ফিরলো। আশেপাশে বৃষ্টি কমে এসেছে। সুবর্ণা নিজের চোখের পানিটুকু মুখে বাথরুমে গিয়ে হাতমুখ ধুয়ে অজু করে নিলো। ওদের কেবিনটাতে একটা ছোট আলনাও রয়েছে। আলনায় রাখা জায়নামাজটা নিয়ে ঝটপট ফজরের নামাজ পড়ে নিলো সে।

সুবর্ণা ঘড়িতে দেখলো ভোর ছয়টা বাজে। কেবিনের দরজায় কে যেনো হালকা হাতে কড়া নাড়ছে। সুবর্ণা বুঝলো মা এসেছে। এই মানুষটার সবদিকে খেয়াল। আজ তার ক্লাস আছে এত ঝামেলা আর টেনশনের মাঝেও সেটা ভুলে যায়নি।
সুবর্ণা দরজাটা খুলতেই নিজের মাকে দেখতে পেলো।
" এত তাড়াতাড়ি চলে এসেছো মা? "
" বাড়িতে একা ভালো লাগে না। এখানে তাও তোর বাবা আছে। আমি এসেছি, তুই এবার বাড়িতে যা। তোর না ক্লাস দশটায়?  বাড়ি গিয়ে একটু ফ্রেশ হয়ে কিছু খেয়ে নে। আমি রহিমাকে সব বলে এসেছি।"
" কিন্তু মা..."
" কোনো কিন্তু নয়। তোর বাবার কাছে আমি আছি তো। তাছাড়া আজও আমি অফিস ছুটি নিয়েছি। একেবারে দুই দিন পরেই জয়েন করবো। আর শোন, তোর বাবা এখন আগের থেকে ভালো আছে। ক্লাস বাদ দেওয়ার কোনো মানেই হয়না তোর। আমি চাই না আমাদের জন্য তোর ক্যারিয়ারের কোনো ক্ষতি হোক। তুই না হয় ক্লাস শেষ করে চলে আসিস।  "
সুবর্ণা এবার আর না করলো না। তাছাড়া বাড়ি গেলে অন্তত প্রীতমের সাথেও কথা বলার একটা সুযোগ পাওয়া যাবে। মায়ের  কথায় আর না করলো না সুবর্ণা। মাকে রেখে নিজে বাসায় চলে গেলো।

বাড়িতে এসেই সুবর্ণা দৌড়ে নিজের ঘরে গিয়ে ফোনটা চার্জে দিলো। আর এই সুযোগে নিজে বাথরুমে ঢুকে গেলো গোসল করে নিতে। শাওয়ারের নিতে দাঁড়াতেই যেনো গত দুই তিন দিনের ক্লান্তি জেকে বসলো তার শরীরে। লম্বা সময় নিয়ে গোসল করলো সুবর্ণা। বাথরুম থেকে বেড়িয়ে ফোনটা অন করেই প্রীতমের নাম্বারে ডায়াল করলো। কিন্তু এবারেও ওপাশ থেকে এক তরুণীর গলা ভেসে এলো,
" আপনি যে নাম্বারে ডায়াল করেছেন, সেটি এই মুহুর্তে বন্ধ আছে।"

( চলবে...)

সুবর্ণলতা [Completed✔️]Donde viven las historias. Descúbrelo ahora