সুবর্ণলতা
- মেহেরুন নেছা হিতৈষীপর্ব ৩১
★
" মাই ডিয়ার বিউটিফুল লেডি,
তোমাকে আমি ঠিক কতটা ভালোবাসি সেটা হয়ত কখনো চাইলেও বুঝিয়ে বলতে পারবো না। সত্যি বলতে ভালোবাসা কি সেটা বোঝার আগেই আমি তোমাকে ভালোবেসে ফেলেছি। ঠিক ভালোবাসা বলবো না। সেই ছোট্টবেলা থেকেই তোমাকে আমার ভীষণ ভালো লাগতো। এই ভালোলাগা কখন কিভাবে যেন ফুলে ফেঁপে ভালোবাসায় রূপ নিলো। তুমি জেনে হয়ত অবাক হবে।
সেই ছোট্টবেলায় তুমিই ছিলে আমার একমাত্র খেলার সাথী। এরপর বাবা মা চলে গেলে আমি চলে গেলাম তোমাদের বাড়িতে। রোজ তোমার যত বায়না আবদার সবকিছু আমার মনে এবং মস্তিষ্কে গেঁথে যেতো। এরপর আমি চলে এলাম দেশের বাইরে।
তোমার থেকে যতটা দূরে গেছি, মনে মনে যেন ঠিক তারচেয়েও কয়েক গুণ বেশি করে ভালোবেসে ফেলেছি। নিজেকে তৈরি করেছি তোমার জন্যে। তোমার সাথে আমার প্রথম দেখা থেকে শুরু করে এই আজকে এই চিঠি লেখা পর্যন্ত, এমন একটা মুহূর্ত নেই যখন আমি তোমাকে নিয়ে ভাবিনি। তুমি যেন আমার অস্তিত্বের সাথে গিয়েছো। তোমাকে ছাড়া যেন আমি আমাকে কল্পনাও করতে পারি না।
অথচ দেখো, ভাগ্যের এমনই পরিহাস! আমি তোমাকে ভালোবাসলেও তোমার ভালোবাসা পাওয়ার মত ভাগ্যবান আমি নই। আমি দেশ থেকে চলে যাবার পর তুমি তোমার জীবনে প্রীতমকে খুঁজে পেলে। আর এই এতবড় কথাটা তুমি এমন একজনের কাছ থেকে লুকিয়ে গেছে যে কিনা প্রতিটা দিন, প্রতিটা মুহুর্ত তোমাকে ভালোবেসে কাটিয়ে দিচ্ছে। তুমি যদি সেদিন তোমার আর প্রীতমের সম্পর্কের কথা অন্তত আমাকে একটুও জানাতে, তাহলে হয়ত আজ আমার এতটা কষ্ট হত না। চোখের সামনে নিজের জীবনের একটা অংশকে অন্যের হতে দেখার মত কষ্ট বোধহয় আর কিছুতে নেই।
আমি তোমাকে ভালোবাসলেও কখনো আগ বাড়িয়ে কিছু বলতে পারিনি। কিন্তু যেদিন জানলাম তোমার এবং আমার বাবার একটা ইচ্ছে আমাদের এক করে দেওয়া। সেদিন থেকে তোমাকে নিয়ে আমি ঘর বাঁধার স্বপ্ন দেখতে শুরু করলাম। দেশে ফিরে তোমাকে যখন রক্তাক্ত অবস্থায় রাস্তায় পরে থাকতে দেখেছিলাম। বিশ্বাস করো, আমার মরে গিয়ে হলেও তোমাকে বাঁচাতে ইচ্ছে করছিলো।
সেদিন যখন রিম্পির বাসার গিয়ে প্রথমবারের মত তোমার আর প্রীতমের সম্পর্কের কথা জানতে পারলাম, আমি শেষ হয়ে যাচ্ছিলাম। এত যন্ত্রণা আমার কখনো হয়নি। সত্যি বলতে, যেদিন তুমি প্রীতমকে চিনেও না চেনার ভান করেছিলে আমার কি যে আনন্দ লাগছিলো। মনে হচ্ছিলো পৃথিবীর সব রঙ বুঝি আবার আমার জীবনে ফিরে আসবে। কিন্তু কাল যখন প্রীতম তোমাকে অমন একটা মেসেজ পাঠালো, আমি আর নিজেকে ঠিক রাখতে পারলাম না।
আসলে কি করব বলো তো, আমি তো অসহায়। আমি কখনো তোমাকে এটাও বলতে পারবো না যে প্রীতম তোমার শুধুই আবেগ। কারণ আমি নিজেও তো তোমাকে আরো বেশি ছোটবেলা থেকে ভালোবাসি।
আবার অন্যদিকে আমি কখনো তোমাকে তোমার কিংবা আমার বাবার শেষ ইচ্ছের দোহাইও দিতে পারবো না। কারণ প্রথমত আমার কাছে কোনো প্রমাণ নেই আর দ্বিতীয়ত আমি তোমাকে ভালোবাসি।
আমি তোমাকে ভালোবাসি বলেই কখনো কষ্ট দেওয়ার মত কাজ ভাবতেও পারি না। অথচ যেই মানুষটা তোমার দুঃখ কষ্টের কথা ঠিকমতো ভাবেই না তুমি তাকেই ভালোবাসো, তার জন্যে কষ্ট পাও।
তোমার আর প্রীতমের মাঝে কতগুলো দেশের দূরত্ব। তবুও তোমরা একে অপরকে নিয়ে কষ্ট পাচ্ছো। অথচ তোমার আর আমার মাঝে একটা মাত্র ছোট রুমের দূরত্ব। তবুও কি আমার এত কষ্টের এতটুকুও তোমাকে স্পষ্ট করে না? তুমি কি একটুও বুঝতে পারো না সুবর্ণা?
আই রিয়েলি রিয়েলি লাভ ইউ সো মাচ বিউটিফুল লেডি। আই রিয়েলি লাভ ইউ এ লট।"
এই পর্যন্ত লিখে সৌরভ পুরো লেখাটাকে একবার পড়ে নিলো। এরপর ব্যাক স্পেস দিয়ে পুরো লেখাটা কেটে দিয়ে ল্যাপটপ অফ করে রেখে দিলো।
এই কাজটা সৌরভের অন্যতম একটা কাজ। কোনো বিষয় নিয়ে খুব কষ্ট পেলে সেসব নিয়ে এলোমেলো কিছু কথা লিখে এরপর সব মুছে ফেলে। সৌরভের ধারণা, লেখার মাধ্যমে মনের দুঃখগুলো বেড়িয়ে আসে। আর লেখাগুলো ডিলিট করে দেওয়ার ফলে দুঃখগুলোকেও তাড়িয়ে দেওয়া যায়।
সৌরভ নিজের ল্যাপটপটা রেখে রুম থেকে বেড়িয়ে ছাদে গেলো। এখন প্রায় মাঝরাত৷ সবাই ঘুমুচ্ছে।
সৌরভ ছাদে গিয়ে সুবর্ণাকে দেখে খানিকটা ভরকে গেলো। এত রাতে একটা মেয়েকে একা এভাবে আশা করেনি সৌরভ।
সুবর্ণা উল্টোদিকে ঘুরে রয়েছে। হালকা বাতাসে সুবর্ণার চুলগুলো এলোমেলো ভঙ্গিতে উড়ছে। আবছা আলোতে পেছন থেকে সৌরভের মনে হল যেন কোনো অপ্সরীর দেখা পেয়েছে সে।
কতক্ষণ এভাবে তাকিয়ে ছিলো সৌরভ জানে না। সুবর্ণা উলটো ঘুরতে সৌরভের হুশ ফিরলো। আলতো পায়ে এগিয়ে যেতেই সৌরভ লক্ষ্য করলো সুবর্ণা কাঁদছে।
" কি হয়েছে সুবর্ণা? এনিথিং রং? এত রাতে এভাবে না ঘুমিয়ে এখানে দাঁড়িয়ে কাঁদছো যে তুমি?"
" প্রীতমের সাথে কথা হলো।"
প্রীতম নামটা শুনেই ভেতরটা কেমন হাহাকার করে উঠলো সৌরভের। নিজেকে সামলে নিয়ে কথাবার্তা এগোলো সে,
" ওহ গ্রেইট। তা কি কথা হলো?"
" প্রীতম আমার বাবার এক্সিডেন্টের ঘটনায় খুব আপসেট। ইভেন ও নিজেও ভীষণ শকড যে ওর বাবার এইসবে হাত রয়েছে। ও এসবের কিছুই জানতো না। প্রীতম আমার কাছে ক্ষমা চেয়েছে সৌরভ। ওর বাবার করা দোষের জন্য যেন ওকে আমি ভুল না বুঝি...."
সুবর্ণা থেমে দীর্ঘশ্বাস ফেললো।
সৌরভ চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। সে জানে না প্রীতম ছেলেটা কেমন। আদোও ভালো নাকি খারাপ। কিন্তু এতটুকু বুঝলো, তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটি এখনো আগের মতই সরল আর নরম রয়ে গেছে। চার চারটা বছর যে মানুষটা কোনো খোঁজ নিলো না, আজ একটা ফোনে কিছুক্ষণ কথা বলেই সবটা ভুলিয়ে দিতে সে সক্ষম। এক নিমিষেই তার সব ভুল ক্ষমা করে দিলো এই মেয়েটি।
সৌরভ হেসে সুবর্ণার দিকে তাকালো।
" প্রীতিম সিরিয়াসলি ভীষণ লাকি। "
" কেনো?"
সুবর্ণা অবাক হয়ে প্রশ্ন করলো সৌরভকে।
" এইযে। এতগুলো বছর পর আবার নিজের হারিয়ে যাওয়া ভালোবাসাকে ফিরে পেলো। আর আমি তার সাক্ষী হয়ে রইলাম। সেদিক দিয়ে ধরতে গেলে আমিও লাকি। এমন মিলন সচরাচর দেখা যায় না। কিভাবে হারিয়ে গিয়েও আবার সব ফিরে পেলে তোমরা।"
" সত্যিই! সেদিন তুমি না থাকলে, তুমি সময়মতো না এলে হয়ত আমি বেঁচেই থাকতাম না। প্রীতমও হয়ত কখনো ক্ষমা চাওয়ার সুযোগ পেত না। আমি তোমার প্রতি ভীষণ কৃতজ্ঞ সৌরভ। "
সুবর্ণা মুচকি হেসে নিচে চলে গেলো।সৌরভ তখনো দাঁড়িয়ে। সে জানে আজ আর তার চোখে ঘুম আসবে না। আজ তার রাত কাটবে ভীষণ যন্ত্রণায়।
সৌরভ আকাশের দিকে তাকিয়ে কিছুক্ষণ হাসলো।
" আমি কখনোই ঠিক সময়ে তোমার লাইফে আসতে পারি নি। যদি আসতে পারতাম, তাহলে হয়ত আজ তুমি আমার বিউটিফুল লেডিই হতে। অন্য কারো হতে না।
আমি জানি না প্রীতম তুমি আমার বিউটিফুল লেডিকে ঠিক কতটা ভালোবাসো। তবে ওই মেয়েটাকে আমি ভীষণ ভালোবাসি বুঝলে। তোমার কথা জানার পর থেকে আমার ভীষণ হিংসে হয় তোমাকে নিয়ে। রাগ করো না ভাই। হিংসে হওয়াটাই তো স্বাভাবিক বলো। একদিকে তুমি যে কি না সুবর্ণার কিসে সুখ সেটাও ঠিকমতো বোঝো না। অন্যদিকে আমি, যে কি না সুবর্ণা আ বলার আগেই তার আম লাগবে নাকি আতা ফল আমি বুঝে যাই। অথচ সুবর্ণা ভালোবাসে তোমাকে। আর আমি! আমি হয়ে রইলাম তোমাদের হ্যাপি এন্ডিং এর একটা ছোট্ট ইনভিসিবল স্যাড পার্ট। যেই পার্টের কোনো এন্ডিং নেই। পুরোটাই দুঃস্বপ্নে ঘেরা। কালো মেঘে ঢাকা।"(চলবে...)