#34

33 5 0
                                    

সুবর্ণলতা
- মেহেরুন নেছা হিতৈষী

পর্ব ৩৪

সুবর্ণা এতগুলো বছর পর প্রীতমকে কাছে পেয়ে যেন সব হুশ হারিয়ে ফেলেছে। সেই আগের মতন কান্নাকাটি করে অস্থির। প্রীতম সময় দিলো সুবর্ণাকে সামলে ওঠার। সুবর্ণা নিজেকে সামলে নিতেই প্রীতম হাত ধরে সুবর্ণাকে গোলাপের পাপড়ি দিয়ে তৈরি করা রাস্তার উপর দিয়ে হাটিয়ে নৌকার উপরে উঠে বসলো।
নৌকায় উঠতেই সুবর্ণা দ্বিতীয় বারের মতন অবাক হলো। কারণ নৌকায় খুব সুন্দর করে একটা ছোট্ট টেবিলের মতন দেওয়া আছে। তার উপরে সুবর্ণার প্রিয় রেড ভেলভেট কেক। কেকের আশেপাশে বেলুন এবং ফুল রাখা।
সুবর্ণা নৌকায় উঠে পুরো নৌকা ঘুরেফিরে দেখছিলো।
নৌকাটা বেশ বড় আর খুব সুন্দর করে সাজানো।
আর প্রীতম আগ্রহ নিয়ে সুবর্ণাকে দেখে যাচ্ছিলো।
সুবর্ণা হঠাৎ প্রীতমকে কিছু বলতে যাবে ওমনি প্রীতম সুবর্ণাকে থামিয়ে দিলো।
" সবই ঠিক আছে বাট তুমি এই রঙের শাড়িটা কেনো পরেছো? "
সুবর্ণার আনন্দে যেন ভাটা পরলো।
" কেনো? কি হয়েছে?"
" না আসলে লাল রঙ তো আমার পছন্দ না। তুমি আজ এত সুন্দর করে সেজেছো কিন্তু লাল সাদা শাড়ি পরেছো তাই আর কি। যেন মনে হচ্ছে তুমি আমার জন্য না অন্য কারো জন্য সেজেছো।"
সুবর্ণা একটু ইতস্তত করতে লাগলো। প্রীতমের কথা শুনেই তার খেয়াল হলো, প্রীতম লাল নয় নীল রঙ ভালোবাসে। কিন্তু এতবড় কথাটা সে কিভাবে ভুলে গেলো?
" সরি। আসলে ওই বাসায় তো আমার তেমন শাড়ি নেই। আলমারিতে এটা ছিলো। তাই আজ পরে ফেলেছি। শাড়িটা দেখে ভীষণ লোভ হচ্ছিলো।"
" আরে ধুর পাগলি। এতে মন খারাপ করার কি আছে? আমি তো মজা করছিলাম। চলো কেক কাটি।"
প্রীতম সুবর্ণাকে নিয়ে কেক কাটতে বসিয়ে দিলো। কিন্তু সুবর্ণা মন থেকে খুশি হতে পারছে না। সে জানে প্রীতম কষ্ট পেয়েছে।

সৌরভ অফিসে নিজের কাজ করছিলো। আজ হঠাৎই কাজের খুব প্রেশার পরেছে। সৌরভ বাড়িতে কল করেছিলো সুবর্ণাকে জানানোর জন্য কিন্তু ততক্ষণে সুবর্ণা নাকি বেড়িয়ে গেছে। ইচ্ছে করেই আর সুবর্ণার ফোনে কল করে ডিস্টার্ব করতে চায়নি সৌরভ।
এখন লাঞ্চ আওয়ার। স্টাফরা মোটামুটি সবাই ক্যান্টিনে খেতে চলে গেছে। কিন্তু সৌরভের যেন আজ কিছুতেই মন নেই। কাজেও মন বসছে না ঠিক করে।
সকাল থেকে নিজের কাজে বেশ কিছু ভুলও করে ফেলেছে সে। সৌরভ শাহরিয়ারের কাছ থেকে যা একেবারেই কাম্য নয়।
সৌরভ বুঝতে পারছিলো সে ধীরে ধীরে সুবর্ণার প্রতি অনেক বেশি দুর্বল হয়ে পরছে। আর এই দুর্বলতা এমন, যে কাটানোর কোনো উপায় নেই।
সৌরভ ক্যান্টিনে কল করে নিজের জন্য এক কাপ কফি আর একটা স্যান্ডউইচ অর্ডার করে নিলো।
খেতে না ইচ্ছে করলেও খালি পেটে থাকা যাবে না। অনিয়ম করার অভ্যাস নেই তার। ছোটবেলা থেকেই নিয়মের ভেতরে বড় হয়েছে। আর দেশের বাইরে যাওয়ার পর বাধ্য হয়েই নিয়মের ভেতরে থাকতে হয়েছে। তাই নিয়মের ভেতরে চলাটাই এখন অভ্যাস হয়ে দাঁড়িয়েছে।
খাবার চলে আসতেই প্রীতম খাবারের ট্রেটার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো।
" বুঝলেন মি. স্যান্ডউইচ! আপনারা হলেন আমার অভ্যাস। এই যে দেখুন, শত কষ্টেও আপনাদের ছাড়তে পারছি না। কি করবো বলুন, নিয়মের ভেতরে চলাটা যে অভ্যাস হয়ে গেছে। আর অন্যদিকে দেখুন, আমার ভালোবাসা সুবর্ণা। মাই বিউটিফুল লেডি। যে কি না এখন তার ভালোবাসার মানুষের সাথে কোয়ালিটি টাইম স্পেন্ড করছে। কি সুন্দর ভাবে আমি সবটা মেনে নিয়েছি। কারণ মেয়েটা যে আমার ভালোবাসা। আর ভালোবাসার উপর তো কোনো জোর চলে না "
সৌরভ নিজের কথা শেষে নিজেই কিছুক্ষণ হাসলো। এরপর স্যান্ডউইচে বড় বড় কামড় দিয়ে স্যান্ডউইচটা শেষ করে কফির মগে চুমুক দিলো।
কফি খেতে খেতেই নিজের ল্যাপটপটা অন করলো। আর সকালে লিখে রাখা উড়ো চিঠিটার পর থেকে আবার নতুন করে লিখতে শুরু করলো,
" ডিয়ার বিউটিফুল লেডি,
দেশে ফিরে যখন প্রথম তোমাকে রক্তাক্ত অবস্থায় পাই, আমার কি যে ভালো লাগছিলো আর কি দারুণ কষ্ট হচ্ছিলো তোমাকে বোঝাতে পারবো না। কষ্ট হচ্ছিলো কারণ এতগুলো বছর পর তোমাকে এই অবস্থায় দেখবো স্বপ্নেও ভাবিনি। আর ভালো লাগছিলো কারণ তোমাকে আমি পেয়েছি আর ঠিক সময়ে পেয়েছি।
আমি দেশে ফিরেছিলাম শুধুমাত্র তোমার জন্যে। আমার তোমার বাবা চাইতো আমার আর তোমার যেন একটা সুন্দর রঙিন সংসার হয়। আমার বাবাও নাকি তাই চাইতো।
তোমাকে যখন হাসপাতালে ভর্তি করা হলো, তখন তুমি কোমায়। আশেপাশের অনেকেই আশা ছেড়ে দিয়েছিলো কিন্তু আমি আশা ছাড়িনি। আমি জানতাম তুমি ফিরবে। তোমাকে ফিরতেই হবে। তোমার জন্যে যে আমি এক পৃথিবী ভালোবাসা নিয়ে অপেক্ষায় আছি।
আমার খুব শখ ছিলো তোমাকে শাড়িতে দেখবো। দেশ থেকে ফেরার পথে তাই তোমার জন্য খুঁজে খুঁজে অনেকগুলো শাড়ি কিনে এনেছিলাম।
তুমি যখন হাসপাতালে, সবাই হোপলেস তোমাকে নিয়ে। আর আমি তখন তোমার জন্য আমার বাড়ি, আমার ঘর, তোমার ঘর, তোমার প্রিয় স্ন্যাকস রুম, বাড়ির ছাদ সব সাজিয়ে গুছিয়ে তুলছিলাম। হুট করে যদি তুমি চোখ খোলো আর সব এলোমেলো দেখো তখন?
তোমার ঘরের আলমারিতে আমিই শাড়িগুলো চুপিচুপি রেখেছিলাম। ঠিক চুপিচুপি না, আন্টি জানতো। দেখতো কিন্তু কিছু বলতো না।
আজ যখন তোমায় লাল সাদা শাড়িটায় দেখলাম, আমি যেন চাঁদ হাতে পেলাম। তোমার প্রিয় সাদা আর আমার প্রিয় তোমাতে লাল। তাই লাল সাদা শাড়িটা কিনেছিলাম। এতগুলো দিনে তুমি আলমারিতে রাখা শাড়িগুলো ছুঁয়েও দেখোনি। আর আজ যখন শাড়ি পরলে, আমার সবচেয়ে প্রিয় শাড়িটাই পরলে।
বিশ্বাস করো সুবর্ণা! তোমাকে দেখে আমার মন চাইছিলো ছুটে গিয়ে তোমাকে বলি, আমার নয়ন জোড়া স্বার্থক। সৃষ্টিকর্তা বুঝি এই দিনটা দেখার জন্যেই আমাকে এতগুলো দিন পৃথিবীতে রেখেছে। কিন্তু যখন জানলাম তোমার এই সাজ আমার জন্যে নয়। আমার বুকেএ ভেতরটায় কি দারুণ যন্ত্রণা হতে লাগলো, তোমাকে বোঝাতে পারবো না। তোমার চোখের সামনে একটা মানুষ তোমার জন্য ছটফট করে একটু একটু করে শেষ হয়ে যাচ্ছে। অথচ তুমি কিচ্ছুটি বুঝতে পারছো না? এ কেমন বিচার সুবর্ণা?"
এই পর্যন্ত লিখে সৌরভ থামলো। ফোনে এলার্ম বাজছে। সৌরভ এলার্ম বন্ধ করে ল্যাপটপটা বন্ধ করে নিজের কেবিন থেকে বেড়িয়ে এলো। একটু পরেই তার একটা মিটিং শুরু হবে।

সুবর্ণা আজ ভীষণ খুশি। এত খুশি শেষ কবে হয়েছিলো তার মনেই পরছে না। সুবর্ণা প্রীতমের সাথে লাঞ্চ করে ডিনার করে বাড়ি ফিরছে। প্রীতম চেয়েছিলো ওকে বাড়িতে নামিয়ে দিতে কিন্তু সুবর্ণার সাথে গাড়ি থাকায় আর জোর করেনি। প্রীতম কথা দিয়েছে দেশে থাকার এই সাতদিনের ভেতরে কম করে হলেও তিন চারদিন তার সাথে মানে ঢাকাতেই থাকবে। আর সুবর্ণাও কথা দিয়েছে তারা প্রতিদিন দেখা করবে।
সুবর্ণা বাড়ি ফেরার পথেই সুবর্ণলতার এপার্টমেন্টে নেমে হালকা করে সবার খোঁজ খবর নিয়ে নিয়েছে। এই কাজটা সে প্রায়ই করে। এতে অসহায় মহিলাগুলো যেন আরো একটু বেশি ভরসা পায় তার উপর।
সুবর্ণার বাড়ি ফিরতে ফিরতে রাত দশটা বেজে গেলো। গাড়ি থেকে নামতেই সুবর্ণা খেয়াল করলো সৌরভের গাড়ির ড্রাইভার তাকে ডাকছে।
" স্যার এই ব্যাগটা গাড়িতে ফেলেই চলে গেছেন। "
" সৌরভ কখন এসেছে?"
" একটু আগেই। আজ অনেক বেশি কাজের চাপ ছিলো বোধহয়। একটা কল এসেছিলো স্যারের। কথা বলতে বলতে নেমেছে। তাড়াহুড়োয় ব্যাগটা ফেলে গেছে।"
সুবর্ণা ব্যাগটা হাতে নিতেই ড্রাইভার চলে গেলো।
সুবর্ণা বাড়িতে ঢুকে আগে নিজের ঘরে এলো। বাড়িতে ঢুকেই জানতে পারলো সৌরভ নাকি রাতে খায়নি। সুবর্ণা ফ্রেশ হয়ে সৌরভকে ডাকতে গিয়ে দেখলো দরজা হালকা খোলা এবং ঘরটা অন্ধকার।
সুবর্ণা দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে ডাকলো,
" ঘুমিয়ে পরেছো সৌরভ? খাবে না?"
" আমার মাথাটা ভীষণ ধরেছে সুবর্ণা। এখন আর খাবো না। খেলে আমি উঠে খেয়ে নেবো। তুমি রেস্ট নাও।"
" আমার ল্যাপটপে একটু প্রবলেম হয়েছে। তোমার ল্যাপটপটা নিয়ে একটু কাজ করতে পারি? ড্রাইভার ল্যাপটপটা আমার হাতে দিয়েছে। তুমি গাড়িতে ফেলে এসেছিলে।"
" হ্যাঁ সিওর। আর তোমারটা আবার প্রবলেম করছে? কাল আমাকে দিও। ওর এবার সিরিয়াস চিকিৎসা দরকার। "
সুবর্ণা হেসে নিজের রুমে চলে এলো।
ফ্রেশ হয়ে বিছানায় গড়াগড়ি করে আধ শোয়া হয়ে কোলের ভেতরে সৌরভের ল্যাপটপটা নিয়ে দিলো।
গত দুদিন ধরে তার ল্যাপটপটা ভীষণ সমস্যা করছে। কাজগুলো ঠিকমতো করতেই পারছে না। সুবর্ণা মনে মনে সৌরভকে থ্যাংকস দিলো।
" ভাগ্যিস ছেলেটা ছিলো। তা না হলে এত কাজ কিভাবে সামাল দিতাম কে জানে।"
ল্যাপটপটা ওপেন করতেই স্ক্রিনে কিছু লেখা ভেসে এলো। সুবর্ণা এবার হেসে দিলো। কত কাজ পাগল ছেলে। এত কাজের প্রেশার যে ল্যাপটপটা ঠিকভাবে বন্ধই করেনি।
সুবর্ণা ফাইলটা কাটতে যাবে তখনই যেন কোথাও নিজের নাম দেখতে পেয়ে আটকে গেলো। কৌতুহল বশত লেখাগুলো শুরু থেকে পড়তে লাগলো এবং বেশ বড়সড় একটা ধ্বাক্কা খেলো সে।
তার আশেপাশে কেউ একজন তাকে এতটা ভালোবাসে, তার জন্য এতকিছু করে যাচ্ছে অথচ সুবর্ণা জানেও না। ভাবতেই কান্না পেয়ে গেলো তার।

( চলবে...)

সুবর্ণলতা [Completed✔️]Where stories live. Discover now