সুবর্ণলতা
- মেহেরুন নেছা হিতৈষীপর্ব ৩২
★
দেখতে দেখতে পেরিয়ে গেছে আরো ছয়টি মাস। এই ছয়মাসে ঘটে গেছে অনেক অপ্রত্যাশিত ঘটনা। স্বামীর মৃত্যুর পর খুনিকে শাস্তি দিতে যে লড়াইতে নাম লিখিয়েছিলেন, সেই লড়াইয়ের শেষ দেখার আগেই পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে চলে গেলেন কাশফিয়া রহমান। সুবর্ণা তাতে ভীষণ ভেঙে পরলেও আবার উঠে দাঁড়িয়ে নিজের কাজে মন দিয়েছে।
প্রীতম নিজের ভুল যেন সত্যিই বুঝতে পেরেছে। তাই আবার এক হয়েছে সুবর্ণার সাথে।
সুবর্ণা প্রীতমকে ফিরে পেয়ে ভীষণ খুশি। কিন্তু তবুও কোথাও একটা যেন খামতি আজও টের পায়। হয়ত প্রীতম তার বাবার খুনি এটা আজও মেনে নিতে পারেনি সে। তবুও চেষ্টা করে যাচ্ছে সব ভুলে গিয়ে নতুন করে গুছিয়ে নেবার।
সৌরভ নিজের কাজ নিয়ে ভীষণ ব্যস্ত। সুবর্ণাকে তার সুবর্ণলতা ফাউন্ডেশনের সমস্ত দ্বায়িত্ব দিয়ে নিজের ব্যাবসা নিয়ে কাটিয়ে দিচ্ছে দিন।
অন্যদিকে কাশফিয়া রহমান মারা যাবার পরপরই ইন্সপেক্টর কৌশিক আহমেদ জানান, বাশার হক মিসিং। তাকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।
ফলাফল কেসটা ধীরে ধীরে ধুলোর নিচে চাপা পরলে লাগলো। ইন্সপেক্টর কৌশিক আহমেদের হাতে অন্যান্য নতুন কেস আসতে লাগলো।
সবাই নিজেদের মত করে নিজের জীবন যেন গুছিয়েই নিয়েছিলো।সুবর্ণা আজ সকাল থেকে ভীষণ খুশি। অনেকগুলো দিন পর আজ প্রীতম আবার দেশে ফিরছে। যদিও খুব কম দিনের জন্যে, কিন্তু খুশির খবর এটাই যে এবার প্রীতম শুধুমাত্র তার জন্যেই দেশে ফিরছে। শুধুমাত্র তার সাথে সময় কাটানোর জন্যেই। সুবর্ণা আজ বেশ সকাল সকাল উঠেছে। ঘুম থেকে উঠেই নিজ হাতে রান্নাবান্না করেছে এবং শাড়ি পরেছে।
সৌরভ অফিসে যাবার আগে খাবার টেবিলের দিকে এসেই রীতিমতো অবাক হলো। সুবর্ণা লাল সাদা মিলিয়ে কাজ করা একটা জরজেট শাড়ি পরেছে। হাতে লাল এবং সাদা কাচের চুড়িগুলো একটু পরপর টুংটাং শব্দ করছে। সুবর্ণার চুলগুলো খুব বেশি বড় না। কোমড়ের উপরে। তবুও খোলা চুলে সুবর্ণাকে দারুণ লাগছিলো।
কতক্ষণ সৌরভ সুবর্ণার দিকে তাকিয়ে ছিলো সে জানে না। সুবর্ণার ডাকে হুশ ফিরলো সৌরভের।
" বাহ তুমি নেমে এসেছো? আজ আমি নিজের হাতে রান্না করেছি। "
" সিরিয়াসলি? ওয়াও। তা আজকের মেনু কি?"
" শাহী রোস্ট, ডিম কোরমা, ঝরঝরে পোলাও, বুটের ডালের খিচুড়ি, নারিকেল দিয়ে হাসের মাংস আর সালাদ।"
" ওরে বাস। এত্ত কিছু কখন করলে?"
সুবর্ণা গিন্নিদের মতন করে পেছনের আচলটা সামনে ঘুরিয়ে এনে কোমরের একপাশে গুজে নিলো।
" ভোরে উঠেছিলাম। না হলে কি আর এত রান্না শেষ হয় বলো তো। অবশ্য আমাকে ফুলি অনেক হেল্প করেছে। ও না থাকলে এত সহজ হত না।"
সৌরভ আগ্রহ নিয়ে ঝটপট খাবার টেবিলে খেতে বসলো। সাথে সাথে সুবর্ণাও আগ্রহ নিয়ে তার প্লেটে খাবার বাড়ছিলো।
সৌরভ কিছুটা পোলাও সাথে ডিম কোরমার ঝোল আর ডিম একসাথে নিয়ে মুখে দিতেই চোখ বন্ধ করে ফেললো।
" উম্মম্মম্ম.... বিউটিফুল লেডি! এত জোস রান্না তুমি করেছো? একদম আন্টির হাতের রান্নার মত হয়েছে ট্রাস্ট মি। "
মায়ের কথা শুনতেই সুবর্ণা যেন একটু নিভে গেলো। সৌরভের ব্যপারটা নজর এড়ালো না
" তা আজ হঠাৎ এত আয়োজন যে? কোনো বিশেষ দিন বা কোনো বিশেষ কারণ? আমি কি ভুলে গেলাম নাকি কিছু।"
সুবর্ণা এবারে মাথা নিচু করে ফেললো।
" আসলে আজ একটা স্পেশাল দিন। অবশ্য তুমি জানো না। মানে তোমাকে জানানো হয়নি। আজ প্রীতম দেশে আসছে। ওর জন্যেই এত রান্নাবান্না। অনেকদিন ওকে নিজের হাতে খাওয়াইনি তো তাই।"
সুবর্ণার কথা শুনে সৌরভ এতটাই অবাক হলো যে হেঁচকি উঠে গেলো। কোনোমতে পানি খেয়ে সামাল দিলো নিজেকে।
" আসলে তুমি হঠাৎ মায়ের কথা বললে তো। মা কখনোই চায়নি আমি আর প্রীতম এক হই। আমি জানি প্রীতমের বাবা একটা ভুল করেছে। কিন্তু তার জন্য প্রীতমকে শাস্তি দেওয়াটাও তো ভুল তাই না সৌরভ?"
সৌরভ শুনলো কি না কে জানে। বিড়বিড় করে নিজেই নিজেকে বলতে লাগলো,
" তাই তো বলি আজ কেনো তোমার এত সাজ। প্রীতম ছেলেটা কত লাকি। এতদূরে থেকেও তুমি ওর জন্য সাজো। অথচ এতটা কাছে থেকেও কোনোদিনও আমি তোমার সাজের কারণ হতে পারবো না। হায়রে হতভাগা সৌরভ।"
" কিছু বলছো?"
সৌরভ সচকিত হয়ে সুবর্ণার দিকে তাকালো।
" না না কিছু না। তুমি ঠিকই বলেছো। কিন্তু তোমায় এমন আপসেট লাগছে কেনো?"
" আসলে কেমন যেন একটা বাধোবাধো ঠেকছে। যেন মনে হচ্ছে মা দূর থেকে আমার এসব দেখে ভীষণ কষ্ট পাচ্ছেন।"
" তোমার মন কি চায়? তুমি প্রীতমের সাথে থাকতে চাও? সুবর্ণা মন যা চায় তাই করো। না হলে সারাজীবন হয়ত পস্তাতে হবে।"
" থ্যাংকস সৌরভ। "
সুবর্ণা কৃতজ্ঞতার চোখে তাকালো সৌরভের দিকে।
" কিন্তু কথার জন্য তুমি তো কিছুই খেলে না। উঠছো যে?"
" আমার জরুরি একটা মিটিং আছে। প্লিজ ডোন্ট মাইন্ড। বাট ট্রাস্ট মি খাবার অনেক মজা হয়েছে। সব প্রীতমকে না খাইয়ে আমার জন্যেও কিছু রেখো কেমন। এসে খাবো। হা হা।"
প্রীতম দ্রুত হাত ধুয়ে হাসতে হাসতে বেড়িয়ে গেলো।
সুবর্ণাও হাসতে হাসতে সব গুছিয়ে নিজে খেতে বসে গেলো। আর মনে মনে সৌরভকে ধন্যবাদ জানালো।