#14

39 3 0
                                    

সুবর্ণলতা
- মেহেরুন নেছা হিতৈষী

পর্ব ১৪

সুবর্ণার যখন জ্ঞান ফিরলো তখন সে নিজেকে হাসপাতালের বেডে আবিষ্কার করলো। তার বেড থেকে একটু দূরে দুজন পুলিশের পোশাক পড়া মহিলাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলো। সুবর্ণা চোখ খুলে আশেপাশের পরিবেশ এক নজরে দেখে নিলো। তখনই কানে বাজলো কেউ উচ্চস্বরে বলছে, " স্যার জ্ঞান ফিরেছে।"
সুবর্ণা দেখলো ইন্সপেক্টর রবি সংকর দাস তার কাছে এগিয়ে আসছে। সুবর্ণা মাথা তুলে বসতে চেষ্টা করতেই একজন মহিলা পুলিশ তাকে আস্তে করে ধরে বেডের উপর আধশোয়া করে বসিয়ে দিয়ে চলে গেলো।
রবি সংকর দাস একটা চেয়ার টেনে সুবর্ণার কাছে গিয়ে বসলো।
" এখন কেমন আছো?"
" জি ভালো।" নিম্নস্বরে জবাব দিলো সুবর্ণা।
" আমি কি আমার প্রশ্নত্তর পর্ব শুরু করতে পারি?"
সুবর্ণা মাথা নেড়ে সম্মতি দিতেই ইন্সপেক্টর রবি সংকর দাস পকেট থেকে আবারও সেই ঘড়িটা বের করে সুবর্ণার সামনে ধরলেন।
" ঘড়িটা কার?"
" প্রীতমের।"
" ঘড়িটা ও নিজেই কিনেছিলো?"
" না। রিম্পির বিয়ে উপলক্ষে বাবা আমাকে শপিং করতে পাঠিয়েছিলো। তখন এই ঘড়িটা আমার খুব পছন্দ হয়। তাই এটা কিনে ফেলি। এটা আমি বিয়ের আগেরদিন প্রীতমকে দিয়েছিলাম যেন বিয়ের দিন পরে আসে। কিন্তু..."
" কিন্তু? "
" কিন্তু বিয়ের আগেরদিন রাতে প্রীতমের হাত কেটে যায়। তাই ও ঘড়িটা আর পরতে পারেনি। আপনি চাইলে ছবিগুলো দেখতে পারেন। ছবিগুলোতে প্রীতমের হাতে ব্যান্ডেজও রয়েছে।"
" তাহলে তুমি বলতে চাইছো ঘড়িটা অন্যভাবে স্পটে পৌঁছে গেছে? আচ্ছা বাদ দাও। রাতের ছবিগুলোতে প্রীতম নেই কেনো?"
এবার সুবর্ণা একটু মাথা নিচু করে ফেললো। কারণ এর উত্তর তো ওর নিজেরও জানা নেই।
" আসলে সন্ধ্যায় প্রীতমের একটা কল আসে। প্রীতম আমাকে বলে যে ওর একটা জরুরি কাজ আছে। ফিরে এসে আমাকে বাড়িতে ছেড়ে তারপর যাবে। কিন্তু... "
" কিন্তু এখন পর্যন্ত প্রীতমের কোনো ট্রেস নেই তাই তো?''
" ট্রেস নেই মানে?"
সুবর্ণা ছলছল চোখে ইন্সপেক্টরের দিকে তাকালো।
" সেদিন সন্ধ্যার পর থেকে ওই ছেলেকে আর পাওয়া যাচ্ছে না। না ও কারো ফোন তুলছে না কারো সাথে যোগাযোগ করেছে। ওর বাবা মা এমনকি বোনও এব্যাপারে কিছুই জানে না। ওর ফোন বন্ধ আসছে।
তবে মজার ব্যাপার কি জানো? ওর ফোনের লাস্ট লোকেশন ছিলো তোমাদের বাসার আশেপাশে।  "
এবার সুবর্ণা একটু ধ্বাক্কার মত খেলো।
" কি বলছেন?  প্রীতমকে পাওয়া যাচ্ছে না? কোথায় যেতে পারে প্রীতম?"
" শান্ত হও। এটা আমাদেরও প্রশ্ন। এবার বলো তো সেদিন রাতে প্রীতম আর তার বাবা তোমাদের বাড়িতে কেনো গিয়েছিলেন?"
সুবর্ণা বেডের পাশে থাকা টেবিলের উপর থেকে পানি ভর্তি গ্লাসটা নিলো। পানিটা খেয়ে একটু ধীরস্থির হয়ে বসে বলা শুরু করলো,
" সেদিন রিম্পির বাড়িতে আমার দাওয়াত ছিলো। আমি মায়ের অফিসের গাড়ি নিয়ে সেখানে যাই আর রাতে বাবা আমাকে নিয়ে আসে। বাবা মা খেয়ে ঘুমিয়ে পড়লেও আমি ফ্রেশ হয়ে সব গুছিয়ে বিছানায় শুতে শুতে অনেক দেরি হয়ে যায়। মোটামুটি ভোরের দিকে আমি আমাদের বসার ঘর থেকে কিছু মানুষের আওয়াজ পেয়ে বাইরে যাই। তখন দেখি যে আমার বাবা কেমন যেন করছেন সোফায় বসে৷ আর পাশে প্রীতম এবং প্রীতমের বাবা। আমি বাইরে যেতেই প্রীতম রাগে গজগজ করতে করতে বেরিয়ে যায়। আর প্রীতমের বাবা আমার বাবার কাছ থেকে ক্ষমা চেয়ে চলে যায়। তারপর আমি বাবাকে পানি খাওয়াই। বাবা একটু শান্ত হয়ে নিজের ঘরে চলে যান। এরপরদিন আমি বাবাকে জিজ্ঞাসা করি যে কি হয়েছিলো। বাবা শুধু বলে যে ওরা বাবা ছেলে কেউ সুবিধার না। দুজনেই ক্ষতিকর। এটুকু বলে আর কিছু বলে না আমাকে। আমি অনেক জোর করি তবুও বলেনি। এমনকি রিম্পির বিয়ের দিনও বাবা প্রীতমকে দেখে রাগারাগি করেন। "
"প্রীতমকে জিজ্ঞাসা করোনি? কেন সেদিন?"
" করেছিলাম। ও বলেছিলো আমার বাবা নাকি ওর পরিচিত কোনো আংকেলের ছেলের সাথে আমার বিয়ের কথাবার্তা বলেছে। আর ওর বাবা নাকি সে বিষয়ে আমার বাবাকে কল দিলে আমার বাবা নাকি ওর বাবাকে অপমান করেছে। এসব শুনেই মাঝরাতে প্রীতম আমাদের বাড়িতে এসে ঝামেলা করেছিলো সেদিন। আর তার পেছনে পেছনে ওর বাবা ওকে থামাতেই এসেছিলো। আমি এর বাইরে কিছুই জানি না বিশ্বাস করুন।"
" আচ্ছা তোমার মা সেদিন কোথায় ছিলেন? উনি এসব জানতেন না?"
" সেই ঘটনার কিছুদিন আগে আমার বাবার একটা এক্সিডেন্ট হয়েছিলো। তখন আমি আর মা রাত জেগে বাবার দেখাশোনা করতাম। এরপর মা কেমন যেনো ইনসোমেনিয়ার রুগী হয়ে যাচ্ছিলো। পরে ডাক্তার মাকে ঘুমের ঔষধ দেয়। মা ঘুমের ঔষধ খেয়ে ঘুমাচ্ছিলো। তবে পরেরদিন আমাকে বলেছিলো যে মা আমাকে কিছু বলতে চায়। খুব দ্রুতই বলতে চায়।"
এতটুকু বলেই সুবর্ণা মুখ চেপে কাঁদতে শুরু করলো।
" আমার মা কেমন আছে এখন একটু বলবেন? আমার মায়ের জ্ঞান ফিরেছে?"
সুবর্ণা কাঁদতে কাঁদতেই ইন্সপেক্টরকে প্রশ্ন করলেন।
" তোমার মায়ের জ্ঞান এখনো ফেরেনি। আচ্ছা তুমি রেস্ট করো। বিকেলে আমার দুইজন কন্সটেবল এসে তোমাকে বাড়ি দিয়ে আসবে। এরমাঝে কোথাও যাওয়ার চেষ্টা করো না। আর যদি চেষ্টা করো তার ফল কিন্তু ভালো হবে না বুঝতেই পারছো। "
সুবর্ণা মাথা নিচু করে ফেললো। ইন্সপেক্টর কিছুদূর যেতেই আবার ফিরে তাকালো,
" আর হ্যাঁ মিস সুবর্ণা। যদি তোমার বয়ফ্রেন্ড তোমার সাথে যোগাযোগ করে, পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা না করে আমাদের জানাবে এটাই সাজেশন দেবো।"
ইন্সপেক্টর নিজের কথাগুলো শেষ করেই চলে গেলো। সুবর্ণা মুখ চেপে কিছুক্ষণ কাঁদলো।

ইইন্সপেক্টর রবি সংকর দাস নিজের চেম্বারে এসে টেবিলে উপরে রাখা ফাইলগুলো একটু দেখে নিলো।
এমন সময় দরজার বাইরে থেকে তার জুনিয়র অফিস্যার তাকে ডাকলেন।
" স্যার আসবো?"
" হ্যাঁ এসো। কোনো খবর?"
" জি স্যার। প্রীতমের ফোনের লাস্ট লোকেশন ছিলো সুবর্ণাদের বাড়ির আশেপাশে এছাড়াও সুবর্ণা যেমন বলেছে প্রীতমের ফোনে একটা কল আসে, কলটা সুবর্ণার বাবার ফোন থেকে করা হয়। "
" কি বলছো তুমি?"
" জি স্যার। এটা থেকে যেমন এটা প্রমাণ করা সহজ যে প্রীতমই খুনি, আবার এটাও প্রমাণ করা সহজ যে প্রীতম নির্দোষ। আর..."
" আর?"
" সুবর্ণার ব্যাকগ্রাউন্ড চেক করেছি স্যার। বাবাকে খুন করে ফেলবে এমনটা নাকি ওই মেয়ের পক্ষে সম্ভবই না। মেয়েটা রাগী ঠিক আছে কিন্তু বাবা মাকে খুব ভালোবাসে। খোঁজ খবর নিয়ে মেয়েটার নেগেটিভ কিছুই পাইনি স্যার।"
" আচ্ছা তুমি যাও।"
ইন্সপেক্টর রবি সংকর দাস ভীষণ চিন্তিত। প্রতিটা প্রমাণ এই ছেলেমেয়ে দুটোর পক্ষে আবার বিপক্ষেও। তিনি কি করবেন কিছুই বুঝতে পারছেন না। এই কেসটা কেমন যেনো ঘোলাটে হয়ে যাচ্ছে। তার মনে হচ্ছে নিশ্চয়ই কোনো বড় মাথা পেছন থেকে খেলাটা খেলেছে। দুটো বাচ্চা বাচ্চা ছেলেমেয়ের পক্ষে এভাবে মার্ডার করে ফেলাটা প্রায় অসম্ভব।
কিন্তু এই ছেলেটাই বা এখন কোথায়। কোথাও গা ঢাকা দিয়েছে নাকি ছেলেটারও কিছু হয়েছে?
ইন্সপেক্টর রবি সংকর দাস মাথায় হাত দিয়ে বসে রইলেন।

(চলবে....)

সুবর্ণলতা [Completed✔️]Where stories live. Discover now