সুবর্ণলতা
- মেহেরুন নেছা হিতৈষীপর্ব ২৯
★
রহিমা খালাকে ফিরে পেয়ে সুবর্ণা ভীষণ খুশি। তার প্রথম থেকেই মনে হয়েছিলো, রহিমা খালা এভাবে তাদের ফেলে চলে যেতে পারে না। সকলের আবেগঘন মুহুর্ত শেষ হলে কাশফিয়া রহমান আবারও নিজের কথাগুলো বলতে শুরু করলেন,
" আমি যখন হাসপাতালের, একদিন রহিমা আমার সাথে দেখা করতে এলো। যদিও রহিমা জানতো আমি তখন কোমায়। কিন্তু এতবড় ঘটনা রহিমা আর মেনে নিতে পারছিলো না। সবটা আমার কাছে এসে বলেছিলো।"
সুবর্ণা একটু অবাক হলো। " কোন কথা মা?"
" প্রীতমের বাবা যে তোর কাছে এসে তোর বাবাকে খুনের কথা স্বীকার করে গেছে সেই সবকিছুই। জানি এখন তোর মনে এটা প্রশ্ন আসবে যে রহিমা এসব কিভাবে জানলো। বলছি তবে শোন।
সুবর্ণা! একটু ভালো করে মনে করে দেখ, সেই সময় প্রায়ই ফুলি তোর কাছে গিয়ে থাকতো। ফুলিকে বেশিরভাগ সময় ফুলির বাবাই আমাদের বাড়িতে নিয়ে যেতো। তাই রহিমার সাথে কেউ ফুলিকে দেখেনি। সেবার টানা তিনদিন ফুলি আমাদের বাড়িতেই ছিলো। প্রীতমের বাবা তোকে ওইসব কথা বলতে যাওয়ার একদিন আগে থেকে আমাদের বাড়ির উপর নজর রাখলেও ফুলিকে তাই দেখেনি। রহিমাকে বাড়ি থেকে বেড়িয়ে যেতে দেখেই বাশার হক আমাদের বাড়িরে যায় আর তোকে সবটা বলে। ঠিক সেই মুহূর্তে ফুলি সবটাই শুনেছিলো।"
ইন্সপেক্টর কৌশিক আহমেদ এতক্ষণ একদম চুপচাপ ছিলেন। একটা কথাও বলেননি। এবার তিনি নিজে থেকেই মুখ খুললেন।
" তার মানে তুই বলতে চাইছিস, ফুলি ঘটনার আই উইটনেস? কিন্তু ও যদি আদালতে সাক্ষী দেয়ও, ও যে সত্যি বলছে তার প্রমাণ কোথায়? তাছাড়া চার বছর আগে ও আরো ছোট ছিলো৷ বিপক্ষের উকিল সহজেই আমাদের হারিয়ে দেবে।"
" না কৌশিক। এত সহযে বোধহয় এবার আমরা হারবো না। ফুলি তখন আরো ছোট ছিলো বলেই মজার একটা ব্যাপার ঘটেছে বুঝলি।
ফুলি সেদিন সুবর্ণার মোবাইল ফোন দিয়ে ভিডিও ভিডিও খেলছিলো। আর যখন বাশার হক বাড়িতে ঢোকে, শুরুর কথাগুলোতে ফুলির ছবি থাকলেও বাশার হকের গলা স্পষ্ট। এরপর ফুলি কিছুদূর কথা শুনে বুঝতে পারে ঘটনা কোন দিকে এগোচ্ছে। খুব সাবধানে মোবাইলটা দরজার ভেতর থেকে এমন ভাবে ধরে রাখে যেন বাশার হককে ফ্রেমে আনা যায় আর ফুলিকেও বাশার হক না দেখে।''
কৌশিক আহমেদ উচ্ছাসের সাথে বলে উঠলেন, " ব্রিলিয়ান্ট। এইটুকু বাচ্চা মেয়ে এত্ত বড় কাজ করে ফেলেছে? ব্রিলিয়ান্ট। "
সুবর্ণা প্রচন্ড অবাক হয়ে সবটা শুনছিলো। এসবের ব্যাপারে তার কোনো ধারণাই ছিলো না।
" কিন্তু মা...."
" বলছি থাম তুই। আমার কথা শেষ হলেই তোর সব উত্তর পেয়ে যাবি।
বাশার হক চলে যাবার পর যখন রহিমা আসে, ফুলি সবটা রহিমাকে জানায়। ফুলি প্রথমে তোকেই জানাতে চেয়েছিলো। কিন্তু তুই ওইসব শুনে এতটা ভেঙে পড়েছিলি, ভয়েই আর তোকে জানায়নি। রহিমা সবটা জানার পর ছুটে হাসপাতালে আসে। আমি কোমায় আছি জেনে কাঁদতে কাঁদতে সবটা বলে আমাকে৷ এরপর আমি রহিমাকে জানাই আমি সুস্থ আছি। এবং ও যেন ওর মেয়েকে নিয়ে যতদ্রুত সম্ভব এই শহর ছেড়ে দূরে চলে যায়। কারণ আমি জানি, এই মুহূর্তে আমার পক্ষে একা এই কেস টেনে নেওয়া সম্ভব না।
বাড়ি ফিরে প্রথমেই আমি তোর ফোন থেকে ভিডিওটা আমার ফোনে নেই আর তোর ফোন থেকে ডিলিট করে দেই। এরপর আমার ফোন থেকেই কয়েকটি কপি করে আমার ল্যাপটপ, তোর বাবার ল্যাপটপ, গুগল ড্রাইভসহ আরো কিছু সিক্রেট ফাইলে রেখে দেই। আর কৌশিককে জানাই যেন দেশে ফিরেই আমার সাথে যোগাযোগ করে। কেসটা হয়ত তখনও সলভ হত যদি ইন্সপেক্টর রবি সংকর দাস আমাদের একটু অভয় দিতেন। যখন উনিও পিছুটানের জন্য সড়ে গেলেন, আমি আর সেই মুহুর্তে সাহস করতে পারিনি। আর এরপরেই তো তোর এক্সিডেন্ট। আমার বুঝতে বাকি নেই যে ওই এক্সিডেন্ট বাশার হকই করিয়েছেন। নিজের ছেলেকে দেশ থেকে সড়িয়ে দিয়ে তোকে আর আমাকে চিরদিনের মত সড়িয়ে দেওয়ার বুদ্ধি।"
কাশফিয়া রহমান দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।
সৌরভ এসে কাশফিয়া রহমানের কাঁধে হাত রাখলেন।
" অথচ এতকিছু হয়ে গেলো আর আমাকে তোমরা কিচ্ছুটি জানালে না। আমি কি এতটাই পর? "
" না রে বাবা। আসলে তোকে জানানোর মত সময়টাই পাইনি। সবকিছু এত দ্রুত ঘটে গেছে। তাছাড়া তুই আসবি সেটা তো বলেছিলি। এরপরই এতসব ঘটে গেলো যে কি রেখে কি করবো কিচ্ছু বুঝতে পারছিলাম না। "
কৌশিক আহমেদ এক নজরে সবাইকে দেখে নিলেন। এরপর কাশফিয়া রহমানের দিকে তাকালেন,
" তাহলে তুই এই কেসটা রি ওপেন করতে চাচ্ছিস? "
" আমি সরাসরি বাশার হকের বিরুদ্ধেই কেস করতে চাই।"
" ঠিক আছে। আমি ব্যাবস্থা করছি যত দ্রুত সম্ভব। তুই টেনশন করিস না। অপরাধীকে এবার শাস্তি পেতেই হবে। আমি যত দ্রুত সম্ভব কেস ফাইল করছি আর উকিল নিয়েও তোদের কাউকে ভাবতে হবে না। আমি সবটা দেখছি৷ আর আজ তাহলে আমি উঠি বুঝলি কাশফি "
" ওমা এখনই চলে যাবি?"
" হ্যাঁ রে। এখন হাতে অনেক কাজ। কাজ শেষ করে একদিন জমিয়ে আড্ডা দেবো। তোর ভাবীকেও নিয়ে আসবো৷ আজ যাই।"
কৌশিক আহমেদ চলে যেতেই সৌরভ ফুলিকে কাছে ডাকলো।
" তুমি নিজেও জানো না তুমি কি করেছো। ব্রিলিয়ান্ট ফুলি। "
ফুলি মুচকি হাসলো।
" তখন ছোট ছিলাম আর বাশার হক কি জিনিস বুঝতে পারিনি বলেই হয়ত মজার ছলে কাজটা করে ফেলেছি। এখনো ভাবতে ভয় লাগে যদি সেদিন ধরা পরে যেতাম, আমার আর সুবন্নাপুর যে কি হত।"
কথাবার্তার এই পর্যায়ে সুবর্ণা হেসে উঠলো।
" ফুলিবানু রে, এখনো তুই আমাকে ঠিকঠাক ভাবে সুবর্ণা বলতে শিখলি না। এত লেখাপড়া করছিস অথচ সেই সুবন্নাপুই ডাকিস। আমার তো মাঝে মধ্যে মনে হয় তুই ইচ্ছে করেই ডাকিস এভাবে।"
এবারে ফুলি খিলখিল করে হেসে দিলো। আর ফুলির হাসির শব্দে বাকিরাও হেসে দিলো।★
বাশার হক ভীষণ চিন্তায় পরে গেছেন। বিশ্বস্ত সূত্রে খবর পেয়েছেন তার পুরোনো অপরাধ কেউ খুঁচিয়ে বের করছে। কোনো এক বিদেশ থেকে আসা পুলিশ নাকি তাকে হাজতে ঢুকানোর জন্য উঠে পরে লেগেছে।
বাশার হক বেশ ভালোই বুঝতে পারছেন এবার তাকে কিছু সময়ের জন্যে হাওয়া বদলে যেতে হবে। প্রথমে তিনি খুব বেশি চিন্তিত ছিলেন না। কিন্তু পরে জানতে পেরেছেন সেই চার বছর আগে উধাও হয়ে যাওয়া মা মেয়ে নাকি ফিরে এসেছে। এসেছে তো এসেছে, সাথে প্রমাণ নিয়ে এসেছে। কিন্তু ঠিক কি প্রমাণ বাশার হক ফেলে এসেছেন এটাই ধরতে পারছেন না। আগেরবার তাও পুলিশকে ধামকি দিয়ে ভুলিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু এবারে পুলিশ নাকি সেই মহিলার বন্ধু।
বাশার হক কিরণকে ডেকে পাঠালেন। এই মুহূর্তে তার আলোচনা করা দরকার।
" সাহেব ডাকছিলেন নাকি?"
" কিরণ! কয়দিনের জন্যে হাওয়া বদলে যাওয়া লাগবে। বুঝলা কিছু?"
" হালকা হালকা বুঝতেছি সাহেব। এখনাকার হাওয়া ভালো ঠেকতাছে না।"
" নয়া পুলিশ আইছে ঢাকায়। আমারে খোঁজে। তয় আমার ভয় সেইখানে না। কারণ খুনডা আমি নিজ হাতে করি নাই। যারা করছে তাদের খুইজ্জা বাইর করতে কষ্ট আছে। ভয় আমার অন্যখানে। কেঁচো খুড়তে যাইয়া পুলিশ ব্যাটায় যদি আবার কেউটে খুইজ্জা পায় তখন তো সমিস্যা। জীবনে তো কুকাম কম করি নাই। "
" তাইলে এখন কি করবেন সাহেব?"
" কিছুদিনের জন্যে গর্তে ঢোকা লাগবে। ব্যাবস্থা করো। আর শুনো। কাক পক্ষিতেও জানি টের না পায় এইসব বিষয়ে৷ "
" জ্বি আচ্ছা হুজুর।"
" আর শুনো। অভ্যাসখানা বদলাও। আমারে আর কত সাহেব সাহেব ডাকবা। আমি যে সম্পর্কে অখন তোমার শ্বশুর আব্বায় হই সেইটা কি মনে থাকে না?"
কিরণ মাথা ঝুঁকে বাশার হককে সালাম করলেন।
" আব্বাজান! মনে রাগ নিয়েন না। আপনেই আমার সাহেব, আপনেই আমার আব্বা। আমি যাই, ব্যাবস্থা করি আপনার হাওয়া বদলের। বিকালে আইসা আপনারে জানাইতাছি।"
কিরণ চলে যেতেই বাশার হক নিজের ফোন হাতে নিয়ে নিজের ছেলেকে মেসেজ করলেন। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা খুব বেশি না থাকলেও স্মার্ট ফোন বেশ ভালোই চালাতে পারেন তিনি। ছেলেকে মেসেজ পাঠিয়ে হাত পা ছড়িয়ে একটা নিঃশ্বাস নিলেন।
তিনি জানেন, এই মুহূর্তে তাকে তার ছেলেই বাঁচাতে পারবে। আর কেউ না।(চলবে...)