#30

40 5 0
                                    

সুবর্ণলতা
- মেহেরুন নেছা হিতৈষী

পর্ব ৩০

সকালে ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হয়েই এক মগ কফি না হলে প্রীতমের চলেই না। আজও তার ব্যাতিক্রম হলো না। আজ তার হলিডে। তাই আজ ঘুম ভাঙলেও কিছুক্ষণ বিছানায় গড়াগড়ি করে নিলো। সেদিনের পর প্রীতম আর সুবর্ণার প্রতি কোনো ইন্টারেস্ট দেখায়নি। পেইন্টিং নিয়ে নিজের দারুণ এক ভবিষ্যত সামনে দেখতে পাচ্ছিলো প্রীতম। নিজের এমন সুন্দর ভবিষ্যতে সুবর্ণাকে এনে বাঁধা তৈরি করতে একদমই ইচ্ছুক নয় সে। এই চারটা বছর নিজের ক্যারিয়ার নিয়ে খুব মনোযোগী ছিলো প্রীতম। এতটুকু সময়ও উল্টোপাল্টা দিকে নষ্ট করেনি। পুরোটা সময় নিজের কাজ এবং লেখাপড়ার দিকে ফোকাসড ছিলো। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে খুব দ্রুতই প্রীতমের একটা পার্মানেন্ট জবও হয়ে যাবে। আর পাশাপাশি বিভিন্ন এক্সিবিশনে নিজের আকা পেইন্টিংগুলোর ভালো ভালো রেসপন্স তো পাচ্ছেই। আর ছয় মাস কিংবা একটা বছর এভাবেই সব ঠিকঠাক চললেই প্রীতম জিনিয়াকে বিয়ে করবে। এখন পর্যন্ত সব সেভাবেই এগোচ্ছে।
বিছানা ছেড়ে ওঠার আগেই অভ্যাসবশত নিজের ফোনটা হাতে নিয়ে গত রাতের সব মেসেজ এবং নোটিফিকেশনগুলো চেক করা শুরু করলো প্রীতম। যেহেতু আজকে হলিডে, তাই এই কাজটা আজ জরুরি।
ফোনটা অন করতেই নিজের বাবার মেসেজ সামনে এলো। মেসেজটা পড়েই প্রীতম বেশ চমকে উঠলো। এমন কিছুই যেন তার প্ল্যানে ছিলোই না।

সুবর্ণা নিজের কাজ নিয়ে ভীষণই ব্যাস্ত হয়ে পড়েছে। মহিলাদের নিয়ে কাজ করে এমন বেশ কিছু সংস্থাও সুবর্ণলতার প্রতি ইন্টারেস্টেড। নানা ভাবে তারা সুবর্ণাকে সাহায্য সহযোগীতা করে যাচ্ছে। সুবর্ণা এবং সৌরভ খুব সুন্দর করে তাদের সুবর্ণলতার অফিসটাকে সাজিয়েছে। এছাড়াও একটা বড় এপার্টমেন্ট নিয়েছে সুবর্ণলতার মহিলাদের জন্যে। যাদের নিজস্ব কোনো ঘর বাড়ি নেই কিংবা শুধুমাত্র কোথায় যাবে ভেবেই স্বামীর সব অত্যাচার, নির্যাতন সহ্য করে শ্বশুর বাড়িতে পরে থাকে, তারা যেন সাহস পায়, থাকার জায়গা পায় এর জন্যেই এপার্টমেন্ট নেওয়া।
অল্প সময়ের ভেতরেই ভীষণ সাড়া পাচ্ছে সুবর্ণা। সৌরভও সুবর্ণার কাজে খুব খুশি। ব্যাস্ততম জীবনেই যেন সুবর্ণা ভালো আছে।
সুবর্ণা নিজের অফিসে বসে কাজ করছিলো, এমন সময়েই সুবর্ণার ফোনে একটা কল এলো।
সুবর্ণা দ্রুত অফিস বেড়িয়ে গাড়িতে উঠে বসলো আর সৌরভকে কল দিলো।
" হ্যালো! বাড়ি থেকে কল এসেছিলো৷ আম্মুর শরীরটা নাকি ভালো না। আমি বাসায় যাচ্ছি। তুমিও আসবে প্লিজ। আমার কিচ্ছু ভালো লাগছে না।"
কল কেটে সুবর্ণা গাড়ির ভেতরেই অস্থির অস্থির করতে লাগলো। গাড়িটা বাড়ির ভেতরে ঢুকতেই প্রায় দৌড়ে মায়ের ঘরে ঢুকলো সুবর্ণা।
" রহিমা খালা! আম্মুর কি হয়েছে?
আম্মু! তুমি ঠিক আছো তো?"
কাশফিয়া রহমানের দেহটা যেন বিছানার সাথে প্রায় মিশে গেছে। সুবর্ণা মায়ের কাছে বসতেই কাশফিয়া রহমান মেয়ের হাত ধরে কাঁপা কাঁপা গলায় বললেন,
" আ-আমার বুঝি তোর বাবার কাছে যাওয়ার সময় ঘনিয়ে আসছে মা। নিজের খেয়াল রাখিস। আর তোর বাবার খুনিকে শাস্তি দিস। "
সুবর্ণা মায়ের এসব কথা শুনে কেঁদে ফেললো।
" সকাল থিকা এইসব কইতাছে। অনেক না করছি, শুনে না। খালি কয় আমার মাইয়াডারে ডাকো রহিমা। ওর লগে আমার কথা আছে। এইগুলা আমি আর নিতে পারতেছি না।"
রহিমা খালা মুখে আঁচল চেপে কাঁদতে কাঁদতে বেড়িয়ে গেলেন।
" ওর কথা বাদ দে সুবা। আমার কথা শোন। প্রীতম ছেলেটা ভালো নয় মা। ও তোকে কখনোই ভালো রাখতে পারবে না। ও তোর ভালোবাসা নয়। ছেলেবেলার আবেগ মাত্র৷ এমন নয় যে ছোটবেলায় মানুষ কাউকে ভালোবাসতে পারে না। সত্যি তো এটাই যে তোরা একে অপরকে ভালোবাসতে পারিস নি। তোদের দুজনের জীবনে তোদের গুরুত্ব কতটুকু সেটা বোধহয় আর আমাকে বলে বুঝিয়ে দিতে হবে না। পুরোনো আবেগকে মুছে সামনে এগিয়ে যা মা। চোখের সামনে সৌরভ ছেলেটা তোকে পাগলের মত ভালোবাসে। ওর ভালোবাসার একটু মূল্য দে মা। একটু মর্যাদা দে।"
কাশফিয়া রহমান এক নাগাড়ে কথাগুলো বলছিলেন। সুবর্ণা সবকিছু শুনে কিছু বলতে যাবে ওমনি সৌরভ কাউকে একটা সাথে নিয়ে ঘরে ঢুকলো। লোকটা ঘরে ঢুকতেই সুবর্ণা বুঝতে পারলো ইনি হয়ত কোনো ডাক্তার। তাই আর কথা বাড়ালো না।
লোকটা কাশফিয়া রহমানের কাছে বসে তাকে দেখতে লাগলো।
" ইনি ডাক্তার কবির। আমার ভাগ্য ভালো আজ ইনি চেম্বারেই ছিলেন। ডিরেক্ট নিয়ে এলাম৷ "
ডাক্তার কবির সময় নিয়ে কাশফিয়া রহমানকে দেখে একটা ইনজেকশন দিয়ে দিলেন।
" আপনারা আমার সাথে বাইরে চলুন। উনাকে এখন একটু রেস্ট নিতে দিন।"
সবাই মিলে গ্রাউন্ড ফ্লোরে এসে সোফায় বসতেই ডাক্তার কবির বললেন,
" আসলে উনার এখন যে সমস্যা সেটা কিছুটা বার্ধক্য, আর কিছুটা রোগও বটে। আমি প্রাথমিক চেকাপ করলাম তবে আমার মতে, উনাকে হাসপাতালে এডমিট করানো উচিত। আমার মতে, উনাকে কিছু টেস্ট করাতে হবে তারপর চিকিৎসা করা বেটার। "
ডাক্তার কবির উঠে দাঁড়াতেই সৌরভ উঠে পরলো ডাক্তারকে এগিয়ে দিতে। দরজার কাছে গিয়ে ডাক্তার একটু থামলেন।
" উনাকে টেনশন করতে নিষেধ করবেন। আমার ধারণা উনি কোনো বিষয় নিয়ে প্রচন্ড রকমের দুঃশ্চিন্তা করছেন। যেটা ওনার নার্ভের উপর খুব বাজে ভাবে চাপ দিচ্ছে। ওনার দিকে একটু খেয়াল রাখুন আর হাসপাতালে এডমিট এর ব্যাপারটা নিয়ে ভাবুন।"

সবাই চলে যেতেই সুবর্ণা ছাদের এক কোণে গিয়ে দাঁড়ালো। খুব সুন্দর ঝিরিঝিরি বাতাস বইছে। সুবর্ণা খেয়াল করলো তার চুলগুলো সুন্দরভাবে বাতাসে উড়ছে। চোখ বন্ধ করে বাতাসটা অনুভব করতে চেষ্টা করলো সে।
" চিন্তা করো না সুবর্ণা। আন্টি ঠিক হয়ে যাবে।"
সৌরভের গলা পেয়ে সুবর্ণা দীর্ঘশ্বাস ফেলে পেছনে ফিরে তাকালো।
" বাবার চলে যাওয়ার পর মা অনেক ডিপ্রেশনে ছিলো। মা যতই দাবী করুক যে সে সুস্থ ছিলো, আসলে যে ভেতর থেকে কখনোই সুস্থ ছিলো না। মা আসলে আমাকে নিয়ে এতটাই চিন্তিত ছিলো যে নিজের দিকে তাকানোর সময়ই খুঁজে পায়নি। আর এখন যখন সবকিছু ঠিকঠাক হচ্ছে, মা যেন ধীরে ধীরে নিজের সেই অসুস্থতার দিকে চলে যাচ্ছে। বাবার ঘটনাটা মায়ের চোখের সামনে ঘটেছিলো। মা কিভাবে নিজেকে সামলেছে বলোতো।"
সৌরভ চুপচাপ সুবর্ণার পাশে গিয়ে দাঁড়ালো।
" চিন্তা করো না। সব ঠিক হয়ে যাবে।"
সুবর্ণা এবং সৌরভ দুজনেই কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকলো। হঠাৎ মেসেজের টোনে সুবর্ণা নিজের ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে হতবাক হয়ে রইলো।
" কিছু হয়েছে?"
সুবর্ণা নিজের ফোনটা সৌরভের দিকে বাড়িয়ে দিতেই সৌরভ ফোনটা হাতে নিয়ে স্ক্রিনে থাকা মেসেজটা পড়লো।
" সুবর্ণা তুমি জানো আমি একটু রাগী আর কোনোকিছু ভেবেচিন্তে কাজ করি না। আমি সেদিন তোমাকে যা বলেছিলাম সব অভিমান থেকে আর নিজের উপর রাগ থেকে বলেছিলাম। তুমি যে সময়টার ভেতর দিয়ে গেছো, আমার উচিত ছিলো সে সময় তোমার পাশে থাকা। তা না করে আমি তোমার উপর অভিমান করে এত দূরে কাটিয়ে দিয়েছি সেই সময়গুলো। আমাকে তুমি ক্ষমা করে দাও জান। আমি সত্যিই তোমাকে ভীষণ ভালোবাসি। আর আমি এও জানি তুমিও আমাকে ভীষণ ভালোবাসো। প্লিজ আমার উপর রাগ করে থেকো না। আমরা কি আবার নতুন করে সবটা শুরু করতে পারি না? আমি কি আর একটা সুযোগ পেতে পারি না? একটা শেষ সুযোগ?  "

( চলবে...)

সুবর্ণলতা [Completed✔️]Dove le storie prendono vita. Scoprilo ora